মুঠোফোনের হাত ধরে পৃথিবীটা আজ একপ্রকার আমাদের হাতের মুঠোয়। অ্যাপের বন্যায় প্লাবিত ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড। আজ যা ট্রেন্ডিং, কিছুদিন পরেই তা হয়ত আউট অফ ফ্যাশন। বিশ্বায়নের যুগে প্রতিনিয়ত এই ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের দিকে বা দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। পরিবারের সদস্যদের মাঝেই হোক বা একলা ঘরে, তফাত যে খুব বেশি তা নয়। আশেপাশে নজর দিলেই দেখতে পাবেন মুখোমুখী বসে দুজন। কিন্তু চোখ আটকে মুঠোফোনে। যা অল্প-স্বল্প দূরত্ব ছিল তা করোনা এসে যেন এক ধাক্কায় আরও কয়েক ধাপ এই ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের দিকেই এগিয়ে দিল। এখন কথায় কথায় হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টুইটার, লাইকস,কমেন্টস নিয়ে কম বেশি মেতে থাকতে ভালবাসী আমরা সবাই। প্রযুক্তি আশীর্বাদ না অভিশাপ, এই তর্কও এখন আর ট্রেন্ডিং নয়। ইন্টারনেটও এর ব্যতিক্রম নয়। কবে কখন আমরা নিজের অজান্তেই ইন্টারনেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছি বলা মুশকিল।
নতুন প্রজন্মের কাছে সমস্যা
খুব সহজেই ইন্টারনেট আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ছে আজকের এই প্রজন্ম। বিশেষ করে গেম খেলার আসক্তি, ভীষণ ভাবে ক্ষতি করছে আমাদের তরুণ প্রজন্মের।
ইন্টারনেট-গেমিংয়ের আসক্তি
ইন্টারনেট আসক্তির দীর্ঘমেয়াদি কুপ্রভাব পড়ছে ছাত্র-ছাত্রীদের অ্যাকাডেমিক কেরিয়ারের উপর। বিশেষত কমবয়সি ছেলেমেয়েরাই এই আসক্তির কবলে পড়ছে বেশি। কারণ তাদের মধ্যে প্রলোভনে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বয়স্কদের তুলনায় অনেক বেশি।
এখনও পর্যন্ত পাওয়া গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যাচ্ছে, ইন্টারনেট বা ইন্টারনেট গেমের আসক্তি অনেক অংশেই মাদক দ্রব্যের আসক্তির সমান।
ড্রাগ বা মাদক দ্রব্যের প্রতি আসক্ত মানুষ ড্রাগ নেওয়ার পর তাদের মস্তিষ্কের যে অংশ যে পরিমাণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, ঠিক একই ভাবে কাজ করে ইন্টারনেট ও অনলাইন গেমের আসক্তি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইন্টারনেটে আসক্তি আমাদের ওপর বিশেষ স্নায়বিক সাড়া তৈরি করে। যার প্রভাব পড়ে আমাদের অনুভূতির ওপর। গবেষণায় দেখা গেছে ইন্টারনেট আসক্ত মানুষের মস্তিষ্কে বিশেষ পরিবর্তন ঘটে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, মস্তিষ্কে ও মস্তিষ্ক কোষের যে অংশগুলির দ্বারা মনোযোগ, অনুভূতি ও আবেগ নিয়ন্ত্রিত হয়, সেগুলোর উপর এই আসক্তির বিশেষ প্রভাব পড়ছে। এই পরিবর্তন কোকেন বা হেরোইন আসক্ত মানুষের মস্তিষ্কেও দেখা দেয়। ডোপামিন আমাদের মস্তিষ্কে আনন্দ ও পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি জাগায়৷ গবেষণায় দেখা গিয়েছে ইন্টারনেট আসক্ত মানুষের মস্তিষ্কের ডোপামিন গ্রন্থিগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কোন পথে প্রতিকার
ইন্টারনেট আসক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করার কাজটা সত্যিই কঠিন। কারণ ইন্টারনেট বা সোশাল মিডিয়া ছাড়া জীবনযাপন আজকের দিনে অসম্ভব।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে যেটা করতে হবে, তা হল, কী ভাবে ইন্টারনেটের যথাযথ ব্যবহার করতে হবে, তা শেখা। একেবারে বর্জন সহজ, কিন্তু বর্জন না-করে নেশার বস্তুকে যথাযথ ব্যবহার করে, তার সুফল ভোগ করার কাজটা অনেকটাই কঠিন।
কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থিয়োরি ইন্টারনেট আসক্তি দূর করার ক্ষেত্রে একটি প্রভাবশালী চিকিৎসা পদ্ধতি। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ইন্টারনেটে আসক্ত মানুষটিকে শেখানো হয়, কী ভাবে প্রযুক্তি যথাযথ ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে বিশেষ সুফল মিলেছে বলেও জানা গেছে। তাই বাবা-মায়ের উচিত পরবর্তী প্রজন্মকে প্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহার শেখানো। শুধু ছোটদের ক্ষেত্রেই নয়, নির্দিষ্ট সময় ছাড়া অযথা ইন্টারনেট ব্যবহারের অভ্যাস থেকে বিরত থাকার চেষ্টা অত্যন্তই গুরুত্বপূর্ণ।
ছুটির দিনে চেষ্টা করুন ইন্টারনেট অফ রেখে অন্যান্য সৃজনশীল কাজে মনোনিবেশ করা। তা ঘর গোছানোই হোক বা বেকিং বা ছবি আঁকার মতো আপনার পছন্দের কাজ। ইন্টারনেট অন থাকলেও নোটিফিকেশন অফ করে রাখুন। খাওয়ার সময় ও শোওয়ার সময় চেষ্টা করুন যাথাসম্ভব ফোনের থেকে দূরে থাকার। শরীর সুস্থ রাখতে এই দুটি ক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিন ধরেই এগুলিতে ব্যাঘাত ঘটলে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা তৈরি হতে পারে।