বঙ্গ রাজনীতিতে দুই ভিন্ন শিবিরের নেতার ব্যক্তিগত পরিসরে দেখা করার, কথা বলার মতো পরিবেশ কি আর নেই? এই প্রশ্ন তুলে দিল বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর একটি সাংবাদিক সম্মেলন।
বঙ্গ রাজনীতিতে কুকথা, অসৌজন্য মন্তব্য এসব বেড়ে চলেছে এবং তা নিয়ে মাঝেমধ্যে আলোচনা, লেখালেখিও হয় সংবাদমাধ্যমে। এর সঙ্গে আরও যে অসুখ ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে বাংলার রাজনীতিতে তা হল ‘ট্রাস্ট ডেফিসিট’, বিশ্বাসের ঘাটতি।
সম্প্রতি রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী প্রেস কনফারেন্স করে বলেছেন, কলকাতার ডেপুটি মেয়র এবং বিধায়ক অতীন ঘোষ নাকি তাঁর সঙ্গে গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে বৈঠক করেছিলেন কোলাঘাট থার্মাল পাওয়ার গেস্ট হাউসে। পুরোনো ঘটনা। এর কোনও অফিসিয়াল রেকর্ড এখনও নেই। কিন্তু যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় তৃণমূল কংগ্রেস নেতা অতীন ঘোষ ওই বৈঠক করেছিলেন, সেক্ষেত্রে যে প্রশ্নটা সামনে আসে, সেটা হল, তাহলে কি বঙ্গ রাজনীতিতে কোনও নেতা ভিন্ন শিবিরের কোনও নেতার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিসরে দেখা করতে, কথা বলতে পারবেন না আর? বঙ্গ রাজনীতি থেকে কি এথিক্স ব্যাপারটা একেবারেই উধাও হয়ে গিয়েছে?
বিধান রায়ের ব্যক্তিগত সচিব সরোজ চক্রবর্তী তাঁর বই ‘উইথ দ্য চিফ মিনিস্টার্স’-এ লিখেছেন, বিধানসভায় জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়কে এতটাই তীব্র ভাষায় আক্রমণ করতেন যা শুনতে তখন দর্শকরা আসতেন এবং গ্যালারিতে বসে শুনতেন জ্যোতি বসুর সেই বক্তৃতা। ওই বইয়েই সরোজ চক্রবর্তী এটাও লিখেছেন, ডাঃ রায়ের বাড়িতে বিরোধীপক্ষের নেতা জ্যোতি বসু মাঝেমধ্যেই আসতেন। দু’জনে নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। তাই বলে বিধানসভায় জ্যোতি বসুর আক্রমণের মুখে বিধান রায় কখনও এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করেননি। ১৯৫২ সালের পর ১৯৫৭ এবং ১৯৬২-র বিধানসভা ভোটে বিধান রায় একবারও যাননি জ্যোতি বসুর নির্বাচনী কেন্দ্রে সভা করতে, তেমনি জ্যোতি বসুও যাননি বিধান রায়ের কেন্দ্রে সভা করতে। এই রাজনীতি কিন্তু বাংলায় এক সময় ছিল। আজকের বাঙালি নেতারা সেই অতীত ভুলে গিয়েছেন।
আরও পড়ুন:
জ্যোতি বসুর দলও যে এই সংস্কৃতি খুব একটা মনে রেখেছে তা-ও অবশ্য নয়। তখন বিরোধী দলনেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখনও রেলমন্ত্রী। আক্রমণের মুখে হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিধানসভায় একদিন বলে বসলেন, পার্থবাবু নাকি রাতে তাঁকে তাঁর বাড়িতে ফোন করেন। রাজনীতিতে এর থেকে ‘আনএথিক্যাল’ মন্তব্য আর কী হতে পারে।
অনেকে বলেন সিদ্ধার্থশংকর রায় জ্যোতি বসুর পরিবারের একজনকে জম্মু-কাশ্মীরের একটি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। যদিও তিনি সেই কোর্স শেষ না করেই চলে এসেছিলেন। ১৯৯১-এর পর কিছুদিন সিদ্ধার্থশংকর রায় ছিলেন বিরোধী দলনেতা। জ্যোতি বসুর হাতে থাকা স্বরাষ্ট্র দফতরের পুলিশ বাজেটের বক্তৃতা সহ বিভিন্ন বক্তৃতায় সিদ্ধার্থ রায় কঠিনতম ভাষায় আক্রমণ করতেন জ্যোতি বসুর সরকারকে। জ্যোতি বসুর পাল্টা আক্রমণও ছিল অত্যন্ত ধারালো। এই সময় একবার কথা প্রসঙ্গে সিদ্ধার্থশংকর রায়কে এক সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিলেন, জম্মু-কাশ্মীরের মেডিক্যাল কলেজের বিষয়টি ঠিক কি না? সিদ্ধার্থশংকরের তাৎক্ষণিক জবাব ছিল, এই নিয়ে তিনি কিছু বলবেন না।
যে বিধানসভায় একসময় জ্যোতি বসু, সিদ্ধার্থশংকর রায় বিরোধী নেতা ছিলেন, সেই পদে এখন বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী। যদিও তাঁর আচরণে সেই ধারাবাহিকতার লেশমাত্র দেখা যায় না।