Thursday, November 27, 2025
HomeScrollFourth Pillar | মন্দির থেকে জন্ম নিচ্ছে এক হিন্দুরাষ্ট্র, শুরু হচ্ছে এক...
Fourth Pillar

Fourth Pillar | মন্দির থেকে জন্ম নিচ্ছে এক হিন্দুরাষ্ট্র, শুরু হচ্ছে এক নতুন কালচক্র

মন্দিরের আবেগ দিয়ে ‘ভুখা পেটে অন্নের জোগান’ দেওয়া তো সম্ভব নয়!

Written By
অনিকেত চট্টোপাধ্যায়

৫০০ বছরের দাসত্বের ইতিহাসের অবসান হয়েছে, ৫০০ বছরের ব্যাথা সেরে উঠছে, এক নব নির্মাণের পথে চলেছি আমরা – এই কথা গুলো দেশের প্রধানমন্ত্রী অযোধ্যার রামমন্দিরে ভাগওয়া ধ্বজ বা ধর্ম-ধ্বজা উত্তোলনের পরে দেশের মানুষকে বললেন। প্রতিটা চ্যানেল সেই ভাষণ দেখাল, প্রতিটা খবরের কাগজে সেই কথাগুলো লেখা হল, কেউ উৎকোচ পেয়েছেন, আরও পাওয়ার আশায় এক নতুন যুগের সূচনার কথা জানালেন। কেউ আবার জেলে যাওয়া আটকাতেই এই মন্দিরের পিছনে যে বিরাট স্থাপত্যবিদ্যা কাজ করেছে, এই মন্দিরই যে ভারতের আত্মাকে জুড়বে, এই মন্দির যে দেশের ঐক্যের প্রতীক, তার ব্যাখ্যা দিলেন। মোদ্দা কথা হল, যে যেভাবে পারলেন এই নতুন যুগের ভোরে নিজেদের আখের গোছানোর কাজ করলেন। এক বিশাল হিন্দু সমাজে আলোড়ন, ‘এসে গেল রাম, রাজ্য এসে গেল’। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলছেন, মন্দির থেকেই শুরু হল নব নির্মাণ, আসছে রাম রাজ্য। এরকম একটা সময়ে আরেকজন প্রধানমন্ত্রীর কথা মনে পড়তে বাধ্য, যিনিও দেশের নতুন মন্দিরের উদ্বোধন করেছিলেন। এক নব নির্মাণ সেদিনও শুরু হয়েছিল, সেদিনের সেই নব নির্মাণের নায়ক সময় পেয়েছিলেন ১৭ বছর, এবং মাথায় রাখতে হবে সদ্য দেশ বিভাগের পরে লুঠ হয়ে যাওয়া এক দেশের হাল ধরেছিলেন সেই নব নির্মাণের নায়ক। হ্যাঁ, আমি জওহরলাল নেহেরুর কথাই বলছি। ১৯৪৭-এর ১৫ অগাস্ট দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন, আর মে, ১৯৬৪-তে মারা যাচ্ছেন। মধ্যে ১৭ টা বছর। ভাখরা নাঙ্গল নদীবাঁধ তৈরি হয়েছে, উৎপাদন হবে জলবিদ্যুৎ, নেহেরু বলেছিলেন এটাই হল আধুনিক ভারতের মন্দির, ‘টেম্পলস অফ মডার্ন ইন্ডিয়া’। সেই স্থাপত্য নিয়ে কথা বললে যদি আবার জেলে পুরে দেয়, তাই আপাতত ওই রাম মন্দিরের মাহাত্ম্য নিয়েই কথা বার্তা।

১৯৪৭ সাল। দেশের মানুষের খাদ্য চাই, অসংখ্য উদ্বাস্তু, মাথার উপর ছাদ চাই, ওধারে চীনের আস্তিনে ছুরি, এধারে দুর্ভিক্ষ। এমন এক প্রেক্ষিতে তিনি স্বপ্ন দেখছেন নতুন ভারতের নতুন মন্দিরগুলোর, সেটাও ছিল নবনির্মাণ। আসুন সেই নবনির্মাণের খোঁজ খবর নেওয়া যাক। ভাখরা নাঙ্গল ড্যাম দিয়ে শুরু হয়েছিল নতুন ভারতের মন্দিরের শুরুয়াত। মারা যাওয়ার আগেই এই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে যন্ত্রপাতি দরকার, তার জন্যই ভারত হেভি ইলেক্টনিক্স লিমিটেড, ‘ভেল’-এর পরিকল্পনা করেছিলেন নেহেরু, আজকেও সেই ‘ভেল’ এক লাভজনক প্রতিষ্ঠান। গতকালও যখন বাকি শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে, ‘ভেল’-এর শেয়ারের দাম কিছুটা হলেও বেড়েছে। নেহেরুর সময় তৈরি হল অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স, ‘এইমস’, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার এক নতুন অগ্রগতি শুরু হয়েছিল এই ‘এইমস’-এর হাত ধরে। এই ‘এইমস’-এ গতবছরে রাম মন্দির উদ্বোধনের জন্য এক বেলার ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এক মন্দির বন্ধ রেখে অন্য মন্দিরের উদ্বোধন হচ্ছে, তাই, শেষে চার ধার থেকে চিৎকার চ্যাঁচামেচি হওয়ার পরে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। আজও দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মাথায় আছে এই ‘এইমস’, যা ছিল ভারতের প্রথম নবনির্মাণের একটা পিলার। লাইফ ইন্সিওর‍্যান্স কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া সেই সময়েই শুরু হচ্ছে, দেশের মানুষ যাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিমার সুযোগ পায়, তার জন্য ‘এলআইসি’ পথ চলা শুরু করল। এরই সঙ্গে এল ‘ওএনজিসি’, অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কোম্পানি। নিজেদের তৈল ভাণ্ডার খুঁজে বের করতে হবে, ক্রুড অয়েল পরিশোধন করতে হবে, হ্যাঁ, নব নির্মাণের প্রথম পুরোহিতের হাত ধরেই ‘ওএনজিসি’-র পথচলা। ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ ইন্ডিয়া, ন্যাশন্যাল ইন্সটিটিউট অফ ডিজাইন এর রূপরেখা তৈরি হল, কাজও শুরু হল ওই জহরলাল নেহেরুর সময়ে। কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, যা আজকেও সারা দেশে প্রাথমিক থকে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশুনোর অন্যতম জায়গা, সেটাও এই সময়েই শুরু হল। ইস্পাত কারখানা ভিলাই, রাউরকেল্লা, দুর্গাপুর; বিশাল উদ্যোগ, লক্ষ মানুষের চাকরি। আর মজার কথা, তখন আমাদের এক ট্রিলিয়ন ইকোনমিও নয়। কিন্তু এই সব হচ্ছে রাষ্ট্রের টাকায়, আর আজ সেসব বিক্রি করা হচ্ছে। আর যা কিছু হচ্ছে, তা হচ্ছে আদানি, আম্বানি বা তাঁদের মত দু’চারটে হাউসের জন্য। এদিকে দেশের অর্থনীতি নাকি পাঁচ ট্রিলিয়ন ইকোনমি হবে আর কিছুদিনের মধ্যে।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | আলবিদা ধর্মেন্দ্র (১৯৩৫-২০২৫)

গান্ধীর কথা মাথায় রেখেই পরিকল্পনায় ভারসাম্য আনারও চেষ্টা করেছিলেন নেহেরু, খাদি ও গ্রামদ্যোগ কমিশনও তৈরি হয়েছিল এই সময়েই। তখন ‘স্মার্ট সিটি’ বলা হত না, কিন্তু গড়ে উঠছিল বড় শহর, তার পরিকাঠামো। সঙ্গে নিলেন কাদের? নিজে একাই পুরোহিত হয়ে থাকার ইচ্ছে তো নেহেরুর ছিল না, নিজেই বিজ্ঞানী, নিজেই ম্যাথমেটিসিয়ান, নিজেই নালির গ্যাস থেকে স্টোভ জ্বালাচ্ছে বা ‘এ প্লাস বি’-এর মাহাত্ম্য বোঝাচ্ছে – এরকম ইচ্ছে তো নেহেরুর ছিল না, তিনি সঙ্গে নিলেন মহারথীদের – হোমি জাহাঙ্গির ভাবা, বিক্রম সারাভাই, পি সি মহালানাবিশ, ভার্গিস কুরিয়েন, এস এস ভাটনগর, সি ডি দেশমুখ – এক একজন এক এক দিকপাল। শুরু হল ‘ইসরো’র পরিকল্পনা, ইন্ডিয়ান স্টাটিস্টিকাল ইন্সটিটিউট নতুন করে সাজানো হল, প্রথম জেনারেশন কম্পিউটার এল সেখানে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শুরু হল, অনুপ্রেরণা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। ‘প্ল্যানিং কমিশন’ তৈরি হল, নেতাজি বহু আগেই তার বিস্তৃত পরিকল্পনা করে গিয়েছেন। নেতাজির সেই ‘প্ল্যানিং কমিশন’ অবশ্য এখন নাম পালটে ‘নীতি আয়োগ’। ওদিকে আইআইটি শুরু হল, রেলপথের শুরুয়াতি বিস্তারের হার আজও রেকর্ড। সেই সময়ে সূত্রপাত ‘ইন্ডিয়ান অয়েল’-এর, ‘আমূল’-এর, যা আজকেও পৃথিবীর ১০০টা কোম্পানির মধ্যে অন্যতম। ভার্গিস ক্যুরিয়েনের হাত ধরে দেশ দুধের ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতার দিকে এগোল, শিশুদের দুধ দরকার, গ্যালন গ্যালন দুধ শিবের মাথায় ঢালার জন্য নয়, পুষ্টির জন্যই দরকার বুঝেছিলেন নেহেরু, শুরু করেছিলেন নব নির্মাণ।

সেই নায়ক মাত্র ১৭ বছর পরে ১৯৬৪-তে যখন মারা যাচ্ছেন, তখন ৩০ মে ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ পত্রিকাতে লেখা হচ্ছে, ‘Throughout the long years of his premiership, he retained his magical grip on the great masses of people.’ তিনি দেশের নতুন মন্দিরের নির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তার সঙ্গেই দেশের মানুষের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মিক সম্পর্ক। আজকে যে প্রধানমন্ত্রী এক মন্দিরের উপরে তাঁদের বহুকালের স্বপ্ন সেই ভাগওয়া ধ্বজা উত্তোলন করে নব ভারতের নবনির্মাণের, ভারতের নবজাগরণের কথা বলছেন, তাঁর রাজত্বকালের মাত্র ১০ বছরে ডিমনিটাইজেশনের মতো দেশকে জ্যান্ত ডোবানোর পরিকল্পনা আমরা দেখেছি, দেখেছি আনপ্ল্যান্ড ‘জিএসটি’ এনে আবার সেই অর্থনীতিকেই আরও বিপন্ন করতে। দেশের যাবতীয় সম্পদ, যার মালিকানা ছিল দেশের মানুষের কাছে, তা বেচে দেওয়া হচ্ছে। দেশের মানুষের গড় আয় কমছে, সম্পদ কমছে, কিন্তু বাড়ছে আদানি আম্বানির মতো কর্পোরেট জায়ান্টের সম্পদ। দেশে আজ যে বৈষম্য, তা তো আমরা স্বাধীনতার পরেও দেখিনি! দেশ ‘ফাইভ ট্রিলিয়ন ইকোনমি’ হয়ে লাভ কী, যদি মানুষের মাথা পিছু আয় না বাড়ে, উলটে কমে যায়? তিনি নতুন কালচক্রের কথা বলছেন, রামমন্দিরের আঙিনা থেকে রাম রাজ্যের কথা বলছেন। কেমন সেই রাম রাজ্য? খানিকটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা তো স্বয়ং তুলসীদাস নিজেই করেছিলেন। তিনি বলছেন, ‘অল্পমৃত্যু নহিঁ কবনিউ পিরা, সব সুন্দর সব বিরুজ সরীরা, নহিঁ দরিদ্র কোই দুখি ন দীনা, নহি কোই অবুধ ন লচ্ছন হিনা’। অবধি ভাষায় তিনি যা বলছেন, তার মানে হল, কম বয়সে যেন কেউ মারা না যায়, কেউ যেন অসুস্থ না থাকে, সবাই নিরোগ আর সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়, কেউ যেন দরিদ্র বা দুঃখী না হয়, কেউ যেন মূর্খ বা শুভলক্ষণ হীন না হয়। হ্যাঁ, এটাই রাম রাজ্যের শর্ত, তুলসীদাস বলছেন। বাস্তব অবস্থা টা কী? দারিদ্রের মাপকাঠিতে আমরা ১২৫টা দেশের মধ্যে ১১১, গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্স এই কথাই বলছে। হ্যাপিনেশ ইনডেক্সে আমরা ১৩৬টা দেশের মধ্যে ১২৬-এ দাঁড়িয়ে আছি, নেপাল, বাংলাদেশেরও পরে। দেশের ৭ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের ৮০ শতাংশ সম্পদ, দেশের ৯৩ শতাংশ মানুষের হাতে আছে মাত্র ২০ শতাংশ। নব নির্মাণ? যে দেশের প্রায় ২০ শতাংশ সংখ্যালঘু নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, সেই দেশে নবনির্মাণ শুরু হচ্ছে এক মন্দির দিয়ে? হ্যাঁ, এই মন্দির এক বিরাট আবেগ তৈরি করেছে, কিন্তু সে আবেগ দিয়ে আরেকটা নির্বাচনই তো জেতা সম্ভব! সেই আবেগ দিয়ে ভুখা পেটে অন্নের জোগান দেওয়া তো সম্ভব নয়।

নেহেরু যখন সেই নবনির্মাণের কাজে ব্যস্ত, তখন আজকের নবনির্মাণের হোতারা জাতির পিতাকে খুন করার চক্রান্ত নিয়ে ব্যস্ত। সারা দেশে দাঙ্গার পরিস্থিতি কীভাবে তৈরিও করা যায়, তার কাজে ব্যস্ত। ১৯৪৯-এ তারই অঙ্গ হিসেবেই বিতর্কিত এক মসজিদে রাম লালার মূর্তি রেখে আসা হল, তাই নিয়ে বার বার কমিউনাল টেনসন তৈরি করা হল, দাঙ্গার আগুন জ্বালানোর চেষ্টা ধারাবাহিকভাবেই চলেছিল। সেই তাঁরাই, সেদিনের দাঙ্গাবাজেরা, স্বাধীনতার আগের বিশ্বাসঘাতকেরা আজ দেশপ্রেমের কথা বলছে, নবনির্মাণের, নবজাগরণের কথা বলছে। ১৯৪৭-এর পরে নবনির্মাণের ইতিহাসের সবথেকে মূল্যবান নির্মাণ হল, আমাদের সংবিধান। সেই সংবিধানের প্রতিটা পাতার প্রতিটা মূল্যবোধকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে এই আধুনিক নবনির্মণের শুরুয়াত। এ নবনির্মাণ নয়, কালাপাহাড়ের মত দেশের সমস্ত আশা আকাঙ্খা উপরে এক চুড়ান্ত আঘাত।

দেখুন ভিডিও:

Read More

Latest News