ইয়ার্কি মারছি না। রূপকার্থেও বলছি না। সত্যি ঘটেছে ।
সিএবি-র তিনতলার ডিনার লাউঞ্জে এত ভিড় যে বাইশ গজ হলে শটে জায়গা করার জন্য রিভার্স স্কুপ ভাবতে হত। যেহেতু নয় –নাতিদীর্ঘ লাইন দিয়ে প্লেট তুলতে তুলতে শুনলাম ট্রাভিস হেড আউট। মাটন প্লেটে পড়তে পড়তে অভিষেক শর্মা। একটু দূরে থাকা ডেজার্ট কাউন্টার থেকে চাটনি প্লেটে তোলার সময় বলল , ঈশান কিষান গন।
ঘরটায় টিভি নেই। ওই প্যাচপেচে ভিড়ে জিওহটস্টারও ঠিকমত আসছে না। দৌড়ে স্টেডিয়ামে ফেরত গিয়ে আবিষ্কার করা গেল ১৩ বলে তিন উইকেট চলে গিয়েছে এসআরএইচের। আর এখুনি চতুর্থটা যাচ্ছিল আন্দ্রে রাসেল গপ্পা ক্যাচ না ফেললে। তিরানব্বই বছরের ইডেন গার্ডেন্স অনেক ভোজবাজির প্রহর দেখেছে। আর প্রত্যাঘাতের নাটকীয়তা বিবেচনায় আজকের রাত্তিরটা ইডেনের প্রথম তিরিশে জায়গা পাওয়া উচিত।
আইএপিএল শুরুর সময় থেকে আজ পর্যন্ত ধরা যাক। কেকেআর আগাগোড়া দারুণ খেলে অনেক ম্যাচ জিতেছে। কখনো নারিন বা রাসেলের একক কৃতিত্বে জিতেছে। কখনো গম্ভীরের ব্যাটে। দলগত ভাবে প্রচন্ড চাপের মুখে লড়াই করেও দীনেশ কার্তিকের আমলে বার করেছে। কিন্তু টসের আগেই আগাম ম্যাচ হারার সাদা প্যান্ডেলের তলায় লটকাতে লটকাতে বেরিয়ে গিয়েছে এমন জেতার সংখ্যা কত ? একটা মনে পড়ছে। হাতে খুব কম রান নিয়েও প্রথম বছরে সেহবাগের দিল্লির বিরুদ্ধে শোয়েবের অবধারিত হারা ম্যাচ জেতানো।
আজকের ৮০ রানে জিতে ওঠা সেই ওটিটি সিরিজের মুচমুচে এক এপিসোড। একটা সময় টিমের যথেষ্ট রান নেই। পাওয়ার প্লে-তে প্রচুর ডট বল গিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে আবার হারের দিকে এগোচ্ছে। একে লিগ টেবলে সবার নিচে। তার ওপর আজ হারলে বাকি ১০ ম্যাচের অন্তত ৭ জিততে হবে। সারমর্ম –গভীর দুর্যোগ গতবারের চ্যাম্পিয়নদের ওপর।
কে জানত তারা যে ডেথ ওভারে আচমকা জীবন ফিরে পাবে। বহু আলোচিত দুই আউট অফ ফর্ম তারকা ব্যাটসম্যান যে ইডেন আকাশ ভরিয়ে দেবেন ক্লিন হিটিংয়ের আতশবাজিতে। টুর্নামেন্টের সবচেয়ে ঐশর্য্যশালী ব্যাটিং পাওয়ার হাউসের বিরুদ্ধে যে এমন বোলিং বৈভব দেখাবে টিম !
আরও পড়ুন: হায়দরাবাদ দুরমুশ, পাঁচে উঠে এল কেকেআর
একটা টিম ব্যাটিং পাওয়ার হাউস হিসেবে টুর্নামেন্টের আগেই এমন খ্যাত হয়ে গিয়েছে যে মোটামুটি ধরে নেওয়া হচ্ছে দুটো আইপিএল ব্যাটিং রেকর্ডের সৌধ এবার তারা স্থাপন করছেই। তিনশো রানে প্রথম পৌঁছবে। আইপিএল ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ছয় মারবে। প্রথম ম্যাচে ২৮৬ করার পর আরো নিশ্চিন্ত আলোচনা শুরু হল যে ব্যাপারটা নিছক সময়ের অপেক্ষা।
দুপুরে বউবাজারের চশমার দোকানের কর্মচারী যে উদ্বেগের সঙ্গে ট্র্যাভিসেকের কথা তুললেন ,একইরকম ভূকম্পন তো দুপুরে মধ্যবয়স্ক হাসপাতাল কর্মীর মুখেও শুনেছি। দাদা লাইনআপটা ভাবুন। ট্রাভিস ,অভিষেক,ঈশান , ক্লাসেন ,অনিকেত,নীতিশ। এর মধ্যে অনিকেত আবার স্পিন বোলিংয়ের ঘাতক। স্পিনের বিরুদ্ধে এবারে যাঁর স্ট্রাইক রেট ২৩৮। তরুণ সাংবাদিক ম্যাচের আগে সম্ভাব্য সেরা বাছলেন –ঈশান কিষান। মানে ধরেই নিচ্ছেন হোম টিম হারবে। মাঠে ঢুকে শুনি এসআরকে আসবেন না। ক্লাবহাউসের আপার টিয়ারের অনেক সিট্ খালি। দুধারেও বেশ কিছু সিট ফাঁকা। হায়দরাবাদে কোনো কোহলি নেই বলে এত সিট খালি যেতে পারে না। নাইট সমর্থকেরা নির্ঘাত শংকিত ছিলেন আবার মনখারাপের রাত্তিরের মুখোমুখি হতে হবে বলে।
তাঁদের এবং হয়ত টিম মালিককে আশ্চর্য না করে টস হারা কেকেআর দুই ওপেনারকে দ্রুত হারাল। কুইন্টন ডি কক ইডেনে রান করেন না এটা প্রাচীন অরণ্যপ্রবাদ। এদিন আরো জমাট বাঁধল। কোনো ফরম্যাটের ক্রিকেটে এখানে তিরিশ পেরোননি ডিকক। আইপিএলে ৮ ইডেন ইনিংস তাঁকে দিয়েছে ৭০ রান। সর্বোচ্চ ২৮। ওয়ানডে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে এখানে করেছিলেন ৩। গম্ভীর কোচ হলে দুই বাঁ হাতিকে হয়তো ওপেনই করতে দিতেন না যেহেতু রাইট-লেফট কম্বিনেশনে তাঁর অনন্ত বিশ্বাস। গতবার সল্ট-নারিনের গড় ছিল ৪৩.৯। স্ট্রাইক রেট ২০৭। এবার সেটা নেমে দাঁড়িয়েছিল ১৫.৩.স্ট্রাইক রেট একশোর নিচে। বাঁহাতিদের ওপেনিং কম্বিনেশনে এবার রান হয়েছে ১.৪, ১৪।
তারা ফর্ম অনুযায়ী দ্রুত ফেরত। এরপর রাহানে ভালো খেলতে খেলতে রিভার্স সুইপ মারতে গিয়ে ছুঁড়ে দিলেন উইকেট। মুহূর্তের জন্য মনে পড়ে গেল ঠিক ওই হাইকোর্টের দিকেই রিভার্স সুইপ মারতে গিয়ে এক অধিনায়ক বিশ্বকাপ বিসর্জন দিয়েছিলেন। মাইক গ্যাটিং-এর ভাগ্য কি তাড়া করবে রাহানেকে ? অংরিশ রঘুবংশীর পঞ্চাশ পূর্ণ হওয়ার পর মারতে গিয়ে হারাকিরির পর মনে হচ্ছিল লিগ টেবলের শেষ অবস্থান ঘুচবে না। রাহানে আর গ্যাটিং — দুটো শটের ছবি লেখার সঙ্গে আপলোড করে দেব ! সুইপ অপঘাতের আটত্রিশ বছর।
অপ্রত্যাশিত নয়। চরম অপ্রত্যাশিত ভাবে এই সময় খেলা ঘুরিয়ে দিলেন বহুসমালোচিত ২৩ কোটিওয়ালা ভেঙ্কটেশ আইয়ার আর রিংকু সিং । ৩১২ দিন পর আবার এই দুটো টিম মুখোমুখি হয়েছিল। চেন্নাই আইপিএল ফাইনালের পর আবার। সেদিন ভেঙ্কটেশ হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন। আজও করলেন। কিন্তু আজকের ২৯ বলে ৬০ সম্ভবত ফ্রেঞ্চাইজির হয়ে তাঁর সেরা ইনিংস। রিংকুকেও অনেক দিন বাদে পুরোনো রিঙ্কু দেখাল। এঁদের মিলিত আচমকা ঝড়ের সামনে কী করবেন প্যাট কামিন্স ভেবে পাননি। কিছুদিন আগেও তাঁকে আধুনিক বিশ্বের সেরা অধিনায়ক বলা হচ্ছিল। কিন্তু এদিন চাপের মুখে ট্যাকটিক্যাল ভুল করতে শুরু করলেন। কামিন্দু মেন্ডিস আইপিএল ইতিহাসের প্রথম সব্যসাচী বোলার। ডানহাতির জন্য অর্থডক্স লেফট আর্ম করেন। বাঁ হাতির জন্য অফ স্পিন। তাঁকে এক ওভারের বেশি আক্রমণে রাখলেন না কামিন্স। যার পুরো ফায়দা তুললেন ব্যাটসম্যানেরা।
কেকেআর দুশো করার পর পুরো মোমেন্টাম তাদের দিকে ঝুঁকে যায়। উইকেট একটু স্লো করায় বল হালকা দেরিতে আসছিল । হায়দ্রাবাদের স্ট্রোক প্লেয়ারদের অসুবিধে হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ করার মুখ নেই। টস জিতে প্ৰথম ব্যাট করে নিলেই তো পারত । তাছাড়া একই উইকেটে তো ভেঙ্কটেশ-রিঙ্কু মাঠের আলো বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারা প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ বৈভবকে তালজ্ঞানহীন মারতে গেল কেন ?
ইডেনে সাদা বলের অন্যতম সেরা প্রহর কেকেআরকে জেনারেল বেড থেকে বাইপাসের রাস্তার স্বাভাবিক জীবনে আবার ফেরত দিয়েছে। আজকের ম্যাচ এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এবার কী হয় দেখা যাক।