পশ্চিমবঙ্গে স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর-এর কাজ এখনও শুরুই হয়নি, অথচ এই শুরু হবে এই ঘোষণা শুনেই সাধারণ মানুষের মনে চরম আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এই আতঙ্কের ফল, মর্মান্তিক আত্মহত্যা, যে আত্মহত্যা নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, আর যে আত্মহত্যা নিয়ে ভাড়ামি করছেন রুদ্রনীল ঘোষ, যে আত্মহত্যাকে সাজানো বানানো বলে খিল্লি করছেন বিরোধী দলনেতা। বীরভূমের ইলামবাজার এলাকায় ক্ষিতীশ মজুমদার নামে ৯৫ বছরের এক বৃদ্ধ মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। তিনি বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছিলেন বহু বছর আগে। তাঁর পরিবার জানিয়েছে, তিনি খুব ভয় পেয়েছিলেন, সে কথা অস্ফুট স্বরে জানাচ্ছিলেন। তাঁর ভয় ছিল, এই ৯৫ বছর বয়সে তাঁকে বিদেশি ঘোষণা করা হতে পারে, হয়তো তাঁকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে, এই আশঙ্কা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। শেষমেষ তিনি আত্মহত্যা করলেন। একইভাবে, উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটির বাসিন্দা ৫৭ বছরের প্রদীপ করও একই ভয়ে এক অজানা আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন। তিনিও শেষমেষ আত্মহত্যা করেন। পুলিশের দাবি, উদ্ধার হওয়া ‘সুইসাইড নোটে’ও এসআইআর-এর সেই ভয়ের কথা বলা ছিল। তাঁর পরিবার জানিয়েছে, ২০০২ সালের তালিকায় তাঁর নাম ছিল না। এ কারণেই তিনি ভয় পেয়েছিলেন যে, তাঁকে নাগরিকত্ব হারাতে হতে পারে, তাঁকে তাঁর আত্মীয় পরিজনদের থেকে দূরে অন্য কোথাও পাঠানো হতে পারে। ৫৭ বছরের এক প্রবীণের কাছে সেই আতঙ্ক হয়ে দাঁড়াল তাঁর মৃত্যুর কারণ। কোচবিহারের দিনহাটার বাসিন্দা খাইরুল শেখ নামে আরেক ব্যক্তি এসআইআর আতঙ্কে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় তাঁর নামের বানান ভুল ছিল, তিনি বেশ কিছু মানুষের কাছে নামের বানান ভুল থাকলে কী হতে পারে, তা জানার চেষ্টাও করেছিলেন। সম্ভবত সেখানেই কোনও হালকা ঠাট্টার ছলে তাঁকে কেউ বলেছিল, তোমাকে ওপারে পাঠানো হবে। সেই আতঙ্ক তিনি কাটাতে পারেননি।
যে কাজ এখনও শুরুই হল না, তার আগেই এই ঘটনাগুলো বলে দেয়, এসআইআর প্রক্রিয়া শুরু হলে আতঙ্ক আর গুজব কোন পর্যায়ে যাবে, আর তার চেহারা কেমন হতে পারে। আসলে ভোটার তালিকা সংশোধনের এই কাজ সাধারণ মানুষের কাছে জাস্ট একটা প্রশাসনিক কাজ নয়। এটা তাঁদের অস্তিত্বের উপর আঘাত। প্রতিটা মুহুর্তে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিৎকার করছেন অনুপ্রবেশকারীদের বেছে পাঠানো হবে বাংলাদেশে। অথচ একবারও বলছেন না যে, কদিন আগেই সোনালি বিবির মা বাবার নাম ২০০২-এর ভোটার তালিকাতে থাকলেও তাঁকে কাঁটাতারের ওপারে পাঠানো হয়েছে। তার দায় কে নেবে? একই শেয়ালের চিৎকার আমরা এই বাংলার বিজেপি নেতাদের মুখে। এই মৃত্যুগুলোই দেখিয়ে দেয়, নথি হারানোর বা বিদেশি ছাপ পড়ার ভয় কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। এই ভয় এখন আর শুধু রাজনৈতিক আলোচনার বিষয় নয়; এটা এখনই আটকাতে হবে। প্রকৃত ভোটার, বৈধ ভোটার – এসব নয়, মানুষকে বলতে হবে, “আমরা পাশে আছি”। কারা ভয় পাচ্ছেন? লক্ষ্য করে দেখুন, ভয় পাচ্ছেন বিশেষ করে দুর্বল এবং বয়স্ক মানুষেরা, যারা সেই কবে বাবা-মার হাত ধরে এপার বাংলাতে এসেছিলেন, রুজি রুটির জন্য এসেছিলেন, তাঁরা যাদের কাছে পুরোনো নথি জোগাড় করা কঠিন, তাঁরা সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত। আর সেই আতঙ্কে ধোঁয়া দিচ্ছেন বঙ্গ বিজেপির নেতারা। এসব আমরা ভুলে যাবো? একবার ভেবে দেখুন তো এসআইআর কি সত্যিই এনআরসি-র ছদ্মবেশ নয়? এসআইআর হল ভোটার তালিকার ‘নিবিড় সংশোধন’। নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ হল ভোটার তালিকাটাকে আপডেট করা এবং ত্রুটিমুক্ত রাখা। কিন্তু এবারের এই সংশোধন প্রক্রিয়া নিয়ে মূল প্রশ্নটা হল, কমিশন কি তার এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের কাজ করছে?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | গব্বর সিংয়ের মতো আতঙ্ক নিয়ে হাজির স্পেশ্যাল ইনটেনসিভ রিভিশন, এসআইআর
এর আগেও ২০০২ সালেও ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন হয়েছিল। সেই সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য যাচাই করা হয়েছিল। কিন্তু তখন কোথাও নাগরিকত্ব হারানোর প্রশ্নটা উঠে আসেনি। কারণ, সেই সংশোধন ছিল মূলত মৃত, ভুয়ো বা স্থানান্তরিত ভোটারের নাম বাদ দেওয়া বা ঠিকানা সংশোধনের মতো রুটিন কাজ। এবারের ছবি, এবারের পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। এবারের এসআইআর কেবল তালিকা ত্রুটিমুক্ত করার জন্য হচ্ছে না। বরং, এটাকে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ভোটার তালিকায় ত্রুটি খুঁজে বের করা পরের কথা, তার চেয়ে নাগরিকত্ব যাচাই করাই যেন মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের মনে ধারণা জন্ম নিচ্ছে যে, এটা আসলে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসি-র একটা প্রচ্ছন্ন রূপ। সেই ধারণা এক্কেবারে ফেলে দেওয়ার মতো তো নয়, বরং সেই ধারণার যথেষ্ট ভিত্তি আছে, আর সেই ধারণাই আজকের ব্যাপক আতঙ্কের মূল কারণ। স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (SIR) আসলে কী? স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর হল, ভোটার তালিকা যাচাইয়ের একটি বিশেষ নিবিড় পদ্ধতি। এই প্রক্রিয়ায় বুথ লেভেল অফিসাররা (BLOs) বাড়ি বাড়ি যাবেন। তাঁরা ভোটারদের তথ্য যাচাই করবেন। এর মূল উদ্দেশ্য হল, এমন ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া, যারা হয় মারা গিয়েছেন, নয়তো অন্য কোথাও স্থায়ীভাবে চলে গিয়েছেন। এমনকি, একই ভোটারের নাম একাধিক তালিকায় থাকলে, সেটাও চিহ্নিত করা হবে। সাংবাদিক সম্মেলনে, সুপ্রিম কোর্টে নির্বাচন কমিশন জোর দিয়ে বলছে যে, ভোটার তালিকা ত্রুটিমুক্ত রাখাই তাদের সাংবিধানিক কর্তব্য। ভোটারদের সঠিক তথ্য যাচাই করা এবং ভুয়ো ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া জরুরি। কমিশন মৃত ভোটারদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য নজিরবিহীন পদক্ষেপও নিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিহারে তিন দফায় বাড়ি পরিদর্শনের পর ৪১ লক্ষ ভোটারকে তাঁদের ঠিকানায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে ১৪ লক্ষ ভোটার মারা গিয়েছিলেন এবং প্রায় ২০ লক্ষ অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছিলেন। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটা রুটিন সংশোধনের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর আর জটিল। এর মাধ্যমে শুধু মৃত বা স্থানান্তরিতদের নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে না, বরং ভোটারের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্যও কঠোর নিয়ম চাপানো হচ্ছে। এখানেই নির্বাচন কমিশনের এক্তিয়ার, আইনি সীমানা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
এই নির্বাচন কমিশনের নাগরিকত্বের প্রমাণ চাওয়াটা কি বৈধ? ভ্যালিড? সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলা দায়ের হয়েছিল। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন সর্বোচ্চ আদালতে এক হলফনামা জমা দিয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে জানিয়েছে। কমিশন তাদের হলফনামায় দাবি করেছে, কোনও ব্যক্তির ভোট দেওয়ার সাংবিধানিক অধিকার আছে কী না, সেটা যাচাই করতে তারা নাগরিকত্বের প্রমাণ চাইতেই পারে। তারা আরও দাবি করে যে, তারা বেআইনিভাবে বা ভোটারের অধিকার হরণ করে কোনও প্রক্রিয়া চালাচ্ছে না। বরং এটাও ভোটার তালিকা ত্রুটিমুক্ত করার একটি প্রচেষ্টা। এই যুক্তিতে কমিশন এসআইআর-এর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলি খারিজ করার আবেদনও জানায়। আবার কমিশন অন্য দিকে আশ্বাস দিয়েছে যে, নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়ার পরে কারও নাম তালিকা থেকে বাদ গেলেও, তাঁর নাগরিকত্ব চলে যাবে না। ডবল স্ট্যান্ডার্ড, দুরকমের পরস্পরবিরোধী কথা বলছেন তাঁরা। এই ডবল স্ট্যান্ডার্ডই মানুষের উদ্বেগ আরও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা একবারও খোলসা করে বলছেনই না যে আধার, এই নির্বাচন কমিশনের দেওয়া EPIC, বা রেশন কার্ড কেন অগ্রহণযোগ্য? তাঁরা এগুলোকে প্রমাণ হিসেবে মানতেই রাজি নয়। কমিশন বলছে, আধার কার্ড শুধু একটি পরিচয়পত্র। ভোটার হওয়ার যোগ্যতা প্রমাণে আধার কার্ডের ভূমিকা সীমিত। তাই এটাকে চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে মানা যাবে না। অথচ এই আধার কার্ডের ভিত্তিতে জমি বাড়ি কেনা হলে, সেই দলিল, বা এই আধার কার্ডের ভিত্তিতেই তৈরি হওয়া পাসপোর্টকে তারা ভ্যালিড ডকুমেন্ট হিসেবে গণ্য করছেন। ব্যাপারটা পাগলা সম্রাটের মতো হয়ে গেল না? এক তুঘলকি রাজ চলছে আমাদের দেশে। কমিশনের যুক্তি, পুরানো ভোটার তালিকার ভিত্তিতেই ভোটার কার্ডের এপিক নম্বর তৈরি হয়েছে। যদি সেই পুরানো তালিকাতেই ভুল থাকে, তবে ভোটার কার্ডকে প্রমাণ হিসেবে ধরলে সংশোধনের উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়ে যাবে। আচ্ছা ২০০২ সালের ভোটার লিস্ট তৈরি হওয়ার সময় কোন তথ্য দেখতে চাওয়া হয়েছিল? একটাও নয়, তার আগের ভোটার তালিকাতে নাম থাকলেই তাকে ভোটার তালিকাতে রাখা হয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে যাদের ২০০২-এর ভোটার তালিকাতে নাম আছে, তাঁদের আর কিচ্ছুটি করতে হবে না। তার মানে ধরে নিতে হবে, এই বাংলাতে অনুপ্রবেশ কেবল ২০০২-এর পরেই শুরু হয়েছে? এক উন্মাদের চিন্তা ছাড়া আর কিছুই নয়। কমিশন দাবি করেছে, দেশজুড়ে ভুয়ো রেশন কার্ডের রমরমা দেখা গিয়েছে। তাই ভোটার হওয়ার যোগ্যতা প্রমাণ করতে রেশন কার্ডকে মান্যতা দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সেই রেশন কার্ডের ভিত্তিতেই ৮০ কোটি মানুষকে ফ্রি’তে রেশন দেওয়ার জন্য দেশের সরকার ১১.৮ লক্ষ কোটি টাকা গত পাঁচ বছরে খরচ করেছে। এটা কি মামদোবাজি? যেগুলো মানুষের কাছে আছে, (১) ভোটার কার্ড, (২) রেশন কার্ড, (৩) আধার কার্ড। খেয়াল করে দেখুন এগুলো কে নির্বাচন কমিশন প্রমাণ হিসেবে দেখছে না। কেন? কারণ এগুলো নকল হতে পারে, বানানো হতে পারে। দেশের মাত্র ৯ শতাংশ মানুষের কাছে পাসপোর্ট আছে। সংঘি জ্ঞানেশের জানা নেই যে সেই ডকুমেন্টও নকল করা যায়, নকল হয়। ওনাদের কর্তার পেয়ারের মেহুলভাই চোকসির ৮টা পাসপোর্ট ছিল। এই গোটা প্রক্রিয়াটা হল এক ভয় দেখানোর প্রসেস। ওনাদের ধারণা, ভয় পেয়ে বাংলার মানুষ ঐ শান্তিকুঞ্জের মূর্তিমান অশান্তি কিম্বা শক্তি চাটুজ্যের সাড়ে তিনখানা কবিতা পড়া ইনটেলেকচুয়াল সভাপতির পায়ে ডাইভ মারবে। ২৬ আসুক, বাংলার মানুষ জবাব দেবে, ‘সব কুছ ইয়াদ রকখা যায়েগা’, প্রত্যেকটা মৃত্যু জবাব দিতে হবে বঙ্গ বিজেপির নেতাদের।



