Wednesday, November 5, 2025
HomeScrollFourth Pillar | প্রথম দফার ভোট ৬ নভেম্বর, কী হতে চলেছে বিহারে?
Fourth Pillar

Fourth Pillar | প্রথম দফার ভোট ৬ নভেম্বর, কী হতে চলেছে বিহারে?

৩ ধাঁধার সমাধান করলেই বোঝা যাবে, বিহারে কাদের নেতৃত্বে সরকার তৈরি হবে!

প্রচার শেষ, আর প্রথম ফেজের ১২১টি আসনের ভোট ৬ নভেম্বর। সেদিনে অনেক রথী-মহারথীর ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাবে, তেজস্বী যাদবও সেই তালিকাতেই আছেন। না নীতীশ কুমার নির্বাচনে নেই, তিনি পরে হয় বিধান পরিষদ থেকে, না হলে অন্য কোনওভাবে জিতে আসার চেষ্টা করবেন? তার দরকার পড়বে? এসবের হিসেব ইভিএম খোলার আগে কেউ হলফ করে বলতেই পারবে না। কিন্তু এবারে নির্বাচনের আগেই কথা হচ্ছিল নীতীশ কুমারের আসন নিয়ে, সেই সময়েই পিকে, মানে প্রশান্ত কিশোর বোমাটা ফেলেছিলেন, নীতীশ কুমার যে কনস্টিচুয়েন্সি থেকে দাঁড়াবেন, উনিও নাকি সেখানেই নমিনেশন দেবেন। এসবের পরে নীতীশ কুমারের নির্বাচনে নামা নিয়ে যাবতীয় আলোচনা এক্কেবারে শেষ হয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ, একসময়ে নওয়াদা, নালান্দার হিরো এখন সরাসরি নির্বাচনে নামার রিস্কও নিতে পারছেন না। এটাই বুঝিয়ে দেয় যে, অবস্থা কতটা খারাপ। ওদিকে কংগ্রেসের হাতে এখনও সেই কবেকার ঘি লেগে রয়েছে। তারা মনে করে যে, তাদের ছাড়া কিছুই হওয়ার নয়, এবং সেটা মনে করার যথেষ্ট কারণও আছে। কারণ তারাই একমাত্র দল, যারা সারা ভারত জুড়ে আছে, আর বিজেপি বিরোধী জোটের তারাই কমান্ডার। কিন্তু তারা বিজেপিকে দেখে শেখেনি যে, ক্ষমতায় আসতে গেলে, ফিরতে গেলে, অনেক ছাড় দিতে হয়। যতদিন তারা মহারাষ্ট্রে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি, তারা শিবসেনা, শিন্দে-শিবসেনা, অজিত পাওয়ারকে তেল দিয়ে গিয়েছে এখন তাদের মুখ্যমন্ত্রী। বিহারেও দেখুন না, নীতীশই তো মুখ্যমন্ত্রী, যদিও বিজেপির এমএলএ অনেক বেশি। তবে তারা জানে যে, নীতীশ সরে গেলেই বিহারে বিজেপি শেষ। কিন্তু কংগ্রেস সেটা বোঝে না, আর বোঝে না বলেই জোটের জট হয়ে থেকে যায়, সে জট কাটছেই না। বিহারে এই মুহুর্তে জোটের যত জট তা কিন্তু এই কংগ্রেসকে ঘিরে। মিটেও মিটতে চাইছে না। জোটের মধ্যে একটা নতুন জোট তৈরি হচ্ছে, আর রাহুল গান্ধী নাকি তাকে হাওয়া দিচ্ছেন। ওদিকে এমনও নয় যে, এনডিএ-তে জট নেই, চিরাগ আর নীতীশ খেলা জমিয়ে দিয়েছেন। এমনকি পিকের পাটনা দফতরে বিক্ষোভ হয়ে গেল সেদিন। প্রার্থী হতে পারেনি এমন একজন এসে বিক্ষোভ দেখালেন।

বিহারে এই সার্কাস চলছে। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন যে, বিহারের এই লড়াই কিন্তু আজকের নয়, নব্বইয়ের দশকে যে তিন শিবির তৈরি হয়েছিল, খেলা তারাই চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিতে এখনও যে সামাজিক মেরুকরণ এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে, তার মূল ভিত্তি পাথরটা পোঁতা হয়েছিল ১৯৭০-এর দশকে, প্রবীণ গান্ধীবাদী সমাজবাদী নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ (জেপি)-এর হাত ধরে। বিহারের সরকারে দুর্নীতি ও অব্যবস্থার বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালের ১৮ই মার্চ যে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটাই পরে জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে ‘সম্পূর্ণ বিপ্লব’ (সর্বাত্মক বিপ্লব) নামে গণ-আন্দোলনের রূপ নেয়। জেপি-র এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল সমাজের সর্বক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনা এবং দলহীন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, যা এই মুহূর্তে বিহারে তিনটে দলের জন্ম দিয়েছে – আরজেডি, জেডিইউ, লোকজনশক্তি পার্টি। জেপি-র আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন আনেনি, বিহারের সামাজিক বিচার, পিছিয়ে পড়া বর্গ (‘পিছড়ে বর্গ’) এবং দলিতদের এক নতুন সমীকরণ তৈরি করেছিল। সমাজের ৮৫ শতাংশ জাতপাত ও সম্পদের নিরিখে পিছিয়ে থাকা মানুষের দৈনন্দিন সামাজিক লড়াইয়ের সঙ্গে বাম এবং সমাজবাদী দলগুলির রাজনৈতিক লড়াই হাতে হাত রেখে চলতে শুরু করেছিল। জেপি-র এই গণ-আন্দোলন থেকেই উত্থান ঘটে লালু প্রসাদ যাদব, নীতীশ কুমার এবং রামবিলাস পাসোয়ানের মতো তিন প্রধান নেতার, যাঁরা পরবর্তীকালে দীর্ঘ সময় ধরে বিহারের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আজও তাঁরাই, বা তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম মাঠে আছেন।

জরুরি অবস্থা উঠে গেলে ১৯৭৭ সালে লালু প্রসাদ যাদব প্রথমবার লোকসভা নির্বাচনে অংশ নেন এবং সাংসদ হন। এর প্রায় দেড় দশক পর, তিনি প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হন।  দ্বিতীয় দফায় মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব ছাড়ার পরেই ১৯৯৭ সালের ৫ জুলাই লালু প্রসাদ যাদব তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় জনতা দল (RJD) প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন। RJD-র রাজনৈতিক সমীকরণ ছিল, ‘মাই, মুসলিম যাদব’। তাদের মেরুকরণ করে এক ভোট ব্যাঙ্ক এখনও আরজেডি-র মূল সমর্থন ভিত্তি। লালু-নীতীশের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের মধ্যেই জেডি(ইউ) থেকে আলাদা হয়ে রামবিলাস পাসোয়ান ২০০০ সালের ২৮শে নভেম্বর লোক জনশক্তি পার্টি (LJP) প্রতিষ্ঠা করেন। বিহারের দলিতদের মধ্যে তিনিই ছিলেন চ্যাম্পিয়ন আর নিজের সেই হাওয়া মোরগ হয়ে ওঠার ফলে তিনি দল বা জোট বদলেছেন বহু বহু বার, কিন্তু ক্ষমতায় থকেছেন যে কোনও মূল্যে।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকা সংশোধনে কাদের নাম কাটা পড়বেই?

২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিহার বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও কোনও জোটই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সেখানে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়। সরকার গঠন সম্ভব না হওয়ায় রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয় এবং অক্টোবরে আবার নির্বাচন হয়। সেই অক্টোবর ২০০৫ সালের নির্বাচনে বিজেপি-র সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নীতীশ কুমার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। নীতীশ কুমার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে প্রথমবার শপথ নেওয়ার পর বিজেপি জোটের নেতৃত্ব দেন এবং ২০১০ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও এই জোট জয়ী হয়।  সেই থেকে আজ অবধি নীতীশ কুমার বারবার দল বদলেছেন, শিবির ছেড়েছেন, কিন্তু ছোট্ট এক গ্যাপ বাদ দিলে উনিই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মানে বিহারে যা হয়েছে, তাতে এই তিন শিবিরের বিভিন্ন কাটাকুটির সমীকরণেই হয়েছে। বাকিরা সব্বাই পার্শ্বচরিত্র। ৯০ থেকেই বিহারে না কংগ্রেস, না বিজেপি, না বাম, কেউই সেন্টার স্টেজের দখলদার ছিল না। আজও বিহারে সেই তিন দলের সার্কাস চলছে। সেই সত্তরের দশক থেকে শুরু করে আজ অবধি বিহারের রাজনীতিতে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন মূলত এই তিন নেতারাই বা তাঁদের উত্তরাধিকারীরা। কংগ্রেস বা বিজেপি এখনও পর্যন্ত বিহারে সেই গণভিত্তি তৈরি করতে পারেনি, যা লালু-নীতীশ-পাসোয়ানদের এই সামাজিক ও রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করে দিয়েছে। এনডিএ ইত্যাদি হল ওপরের খোলস, যেখানে নীতীশ কুমারের ক্ষয়ে যাওয়া চেহারার সামনে রামবিলাস পাসোয়ানের ছেলে চিরাগ এসে হাজির, কাজেই এনডিএ-র মধ্যে এই দুই নেতার লড়াই, কাজিয়া দেখার মত। অন্যদিকে লালু পুত্র তেজস্বী মহাগঠবন্ধনের ঘোষিত অঘোষিত মুখ্যমন্ত্রী, তিনিই ওখানে মহাগটবন্ধনের শেষ কথা। বাকি খেলোয়াড়দের কাছে মহাগটবন্ধনে থাকা ছাড়া অন্য কোনও অপশনও নেই, কারণ সামনের গাজর বিজেপি বিরোধিতা। তো এই তিন প্রধানের সার্কাসে, এতদিন তো বেশ পরিস্কারই মনে হচ্ছিল, নীতীশ এর জন্যই পিছিয়ে পড়ছে এনডিএ, তেজস্বীর নেতৃত্বে মহাগঠবন্ধন খানিক এগিয়ে।

কিন্তু এখন সব খেলা গুবলেট। মূলত দু’টো কারণ। (১) প্রশান্ত কিশোর কীভাবে, কাদের ভোট কাটবেন, তা বিহারের পন্ডিতরাই দিতে পারছে না। (২) পিকে ‘স্পয়লার’ হবে না ‘কিং-মেকার’ নাকি এক ‘গ্রান্ড ফ্লপ শো’, বোঝা যাচ্ছে না। নীতীশ বেশ খানিকটা পিছিয়ে থাকলেও, তাতে এনডিএ-র খুব বিরাট কোনও ক্ষতি হবে, সেরকমও বুঝতে পারা যাচ্ছে না। কাজেই সব মিলিয়ে সার্কাস জমে উঠেছে। জোটের জট দু’ধারেই, একদিকে চিরাগ, অন্যদিকে রাহুল গান্ধী। যার ফলে আগে যাঁরা বলেছিলেন অ্যাডভানটেজ মহাগঠবন্ধন, তা কিন্তু আজ আর তাঁরা হলফ করে বলছেন না, বলা যাচ্ছে না। তবে এই মুহূর্তে এটুকু তো জলের মত পরিস্কার যে, নির্বাচনের ফলাফল কিছুই নির্ধারণ করবে না। নির্বাচনের পরে নতুন খেলা শুরু হবে। নির্বাচনের পরে তিন ঘোড়ার শক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হবে।

(১) প্রশান্ত কিশোর কত আসন পেলেন? (২) চিরাগ পাসোয়ান কত আসন পেলেন? (৩) মুকেশ সাহনি কত আসন পেলেন? হ্যাঁ, এই তিন দলের আসন সংখ্যা থেকে নতুন সমীকরণ বেরিয়ে আসতেই পারে। তিনটে ধাঁধা আপনাদের সামনে, যা সলভ করতে পারলেই বোঝা যাবে বিহারে কাদের নেতৃত্বে সরকার তৈরি হবে। (১) বিহারের মানুষজন কি এবারেও একইভাবে তাঁদের জাতপাতের সমীকরণ নিয়েই ভোট দেবে? (২) বিহারের নির্বাচনে পিকে কত ভোট পাবেন, কার ভোট কাটবেন? (৩) দুই বড় জোট, এনডিএ আর মহাগঠবন্ধন-এর মধ্যের লড়াই, জোটের ভেতরে কোন্দল কোন জোটকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করবে? হ্যাঁ, এই তিনটে রিডল, তিনটে ধাঁধা নিয়ে অঙ্ক করতে বসে পড়ুন, সমাধান করতে পারলেই আপনিই সেফোলজিস্ট।

Read More

Latest News