Monday, September 15, 2025
বাঙালি কাউন্টডাউন
HomeScrollFourth Pillar | শুভেন্দু, সেলিমের শিক্ষা-দুর্নীতির ইস্যুটা কি ফিকে হয়ে গেল?
Fourth Pillar

Fourth Pillar | শুভেন্দু, সেলিমের শিক্ষা-দুর্নীতির ইস্যুটা কি ফিকে হয়ে গেল?

ভাবমূর্তি উদ্ধার করাটা ছিল আসল কাজ, আর সেটা অনেকটাই করতে পেরেছেন ব্রাত্য বসু আর তাঁর দফতর

শিক্ষামন্ত্রী জানালেন, অক্টোবরের শেষেই এসএসসি-র নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশের লিখিত পরীক্ষার ফল বেরোবে। এর পরে নভেম্বরে এসএসসি-র ইন্টারভিউ। এমনিতে মমতা ব্যানার্জির অনুপ্রেরণা শব্দবন্ধ দিয়েই বাক্য শুরু করেন ব্রাত্য বসু, কিন্তু রবিবারে পরীক্ষার পরে সেই শব্দবন্ধ ছাড়াই জানালেন “আগামী মঙ্গলবার অর্থাৎ ১৬ সেপ্টেম্বর, নবম-দশমের মডেল উত্তরপত্র এসএসসি-র ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়া হবে। একাদশ-দ্বাদশের মডেল উত্তরপত্র ২০ সেপ্টেম্বর ওয়েবসাইটে তোলা হবে।” তাঁর বডি ল্যাঙ্গোয়েজ থেকে ঝরে ঝরে পড়ছে কনফিডেন্স। কুঁকড়ে থাকা শিক্ষা দফতর কি একটু হলেও ফ্রন্ট-ফুটে ব্যাট করছেন? বা ফুটবলের ভাষায় মেক্সিকান ডিফেন্স-এর রাস্তা ছেড়ে ব্রাজিলের অল-আউট অ্যাটাকের ছন্দ ফিরে পেয়েছেন ব্রাত্য বসু? হ্যাঁ, সেটাই মনে হচ্ছে। এক দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষক নিয়োগ, নিয়োগে দুর্নীতি, টাকা নিয়ে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগে মামলা, ইডি, সিবিআই-এর সক্রিয়তা, শিক্ষামন্ত্রীর বান্ধবীর খাটের তলা থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার, শিক্ষকদের আন্দোলন, আলোচনা, বামেদের আন্দোলন, বিজেপির আন্দোলন, বিচারকদের প্রায় দলীয় নেতাদের মত বক্তব্য, শিক্ষকদের রাস্তা দখল – সব মিলিয়ে গত কয়েকবছর ধরে খবরের কাগজের শিরোনামে এ বছরের বর্ষার মতো এক ভূমিকা, যেতে আর চায় না। সবে মনে হল একটু থিতিয়েছে, ওমনি আরেক ক্যাচাল শুরু হয়ে গেল। খবরের কাগজের পাঁচের পাতা থেকে লাফ দিয়ে শিক্ষা দুর্নীতি চলে এল প্রথম পাতায়। আর কলতলার ঝগড়া, যেদিনই কিছু নেই, সেদিনই ‘মেরে পাশ মা হ্যায়’-এর মতো শিক্ষা দুর্নীতি তো আছে, আর আছেন সেই সব বিশেষজ্ঞ যাঁরা ‘কামচাটকাতে কুমিরের প্রজনন’ থেকে অনুব্রত মন্ডলের চালকল সম্পর্কিত যে কোনও বিষয়েই অনায়াসে বলতে পারেন, ঘাড়ে পাউডার দিয়ে তাঁরা হাজির প্রাইম টাইমে শিক্ষা দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে। তারপর লেগেই ছিল এই রায়, ঐ রায়, আর কিছু ওকালতি প্যাঁচ পয়জার, খেয়ে নেব সবকটার চাকরি, একজনও চাকরি ফিরে পাবে না, হ্যাঁ, সেই চারদিক থেকে ঘিরে জীবনটা হেল করে দেব, নরক করে তুলব-র মত কথাও শুনেছি।

স্বচ্ছতা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন উঠছিল, আর গতকাল এসএসসি-র চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার জানালেন, কোনও পরীক্ষার্থীর প্রশ্ন বা উত্তর ভুল বলে মনে হলে ওই মডেল উত্তরপত্রকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন। এর জন্য পাঁচ দিন সময় দেওয়া হবে। তার পরে ফের বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে আবার চূড়ান্ত উত্তরপত্র আপলোড করা হবে। ভাবা যায়, প্রশ্নপত্র নয়, ওএমআর শিট নয়, এমনকি মডেল উত্তরপত্র নিয়েও চ্যালেঞ্জ করা যাবে। এবং তারপর যদি তা সঠিক মনে হয়, তাহলে সেই উত্তরপত্রকেও বদলানো হবে। হ্যাঁ, এরকমই এক স্বচ্ছ পরীক্ষা ব্যবস্থাই তো আমরা নাগরিকেরা চেয়েছি। ছেলেমেয়েরা তাঁদের মেধার ভিত্তিতে চাকরি পাবে, যেমনটা ব্রাত্য পেয়েছিলেন বাম আমলে। কিন্তু কী হয়েছিল? অবশ্যই এক খুল্লম-খুল্লা লুঠমার। এমন নয় যে আগে সবটা স্বচ্ছ করতোয়া নদী ছিল। ধরুন ২০০১, ২০০২ সালের ডিওয়াইএফআই বা সিপিএম পার্টি হোলটাইমারদের তালিকা ধরে ধরে চেক করলেই দেখা যাবে তাঁদের স্ত্রী, বা তাঁদের স্বামী প্রাইমারি স্কুল, সেকেন্ডারি স্কুল, কলেজের শিক্ষক বা অশিক্ষক কর্মী। দাস রিপ্রোগ্রাফিক্স-এ কাজ করতেন এক কমরেড গুহ। ১৯৮৪, ১৯৮৫ সাল থেকেই তিনি বেহালারই এক কলেজের অশিক্ষক কর্মচারী, সম্ভবত ল্যাব অ্যাসিসট্যান্ট। খোঁজ নিয়ে দেখুন তো, কোন পরীক্ষা দিয়ে তিনি ঢুকেছিলেন? সারা রাজ্য জুড়ে বাম আমলে এই ঘটনা ঘটেছে। সম্ভবত সেই সার শিক্ষা মাথায় রেখেই সদ্য মন্ত্রী হওয়া ব্রাত্য বসু বলেছিলেন, বেশ করব, তৃণমূল যারা করে তাদেরই তো চাকরি দেব। পরে বুঝেছিলেন চাকরি দিতে দোষ নেই, কিন্তু তা গাজোয়ারি করে বলার মধ্যে দোষ আছে। তো তিনি নাট্যকার মানুষ, হাজারো সতেজ ব্যাখ্যা দিয়ে পাশ কাটিয়েছিলেন পরবর্তী প্রশ্ন গুলোর। কিন্তু আসল কেলোটা হল সিপিএম দল চালানোর জন্য, সংগঠন বাড়ানোর জন্য চাকরি বিলি-বন্টন করেছিল। দু-চার জায়গাতে টাকা পয়সার লেনদেন ছিল না তা নয়, কিন্তু আদতে কাঞ্চি পেট আর দলবল নিয়ে বুথে অনায়াসে শ’দেড়েক ভোট দিতে পারে। কাজেই তাকে দেওয়া হোক গড়াগাছা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অশিক্ষক কর্মচারীর পদ। কিন্তু না, এর জন্য কাঞ্চির পকেট থেকে টাকা দিতে হয়নি। তৃণমূল জামানাতে এটা এক্কেবারে নিলাম বাজার করে তোলা হয়েছিল। হ্যাঁ, পিছনে মন্ত্রী ছিলেন, কিছু আমলারা ছিল, এবং আড়কাঠিরা ছিল জেলায় জেলায়। এক বিরাট নেটওয়ার্ক চাকরি বিক্রিতে নেমেছিল। বাম জমানাতে যা ছিল দলের উন্নতির জন্য, তৃণমূল জামানাতে সবটাই আত্মোন্নতির জন্যই করা হয়েছিল। আর সেই জন্যই তাকিয়ে দেখুন শিক্ষা দফতরের লক স্টক ব্যারেল হাজতের ওপাশে।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মণিপুর সফরের আগেই জ্বালানো হল মোদিজির কাটআউট

অবশ্যই এই কেলেঙ্কারি মধ্যপ্রদেশের ব্যপমের চেয়ে অনেক অনেক ছোট্ট মানের, অবশ্যই মেডিকেল বা আইএএস, আইপিএস মানে ইউপিএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিক্রি করার সারা ভারত জুড়ে র‍্যাকেটের তুলনায় কিছুই নয়। এবং এটাই যদি বিজেপিরাজ হত, একজনও জেলে থাকতেন না। কারণ ইডি বা সিবিআই তো প্রভুর কথা শুনেই কাজ করে। কিন্তু দুর্নীতি যে হয়েছিল, চাকরি বেচে বেশ কিছু মানুষের একটা চক্র যে অঢেল পয়সা কামিয়েছিল, তা নিয়ে তো কোনও সন্দেহই নেই। কাজেই তা এক রাজনৈতিক ইস্যুও হয়েছিল। বড় রাজনোইতিক ইস্যু। এরকম এক ইস্যু পেলে বিরোধী দলনেত্রী থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের প্যান্ট খুলে ধর্মতলায় ফেলে রাখতেন, সরকার অন্তর্বাস পরে ঘুরে বেড়াতো সরকার পড়ে যেত। কিন্তু অকর্মণ্য কমরেড সেলিম আলিমুদ্দিনে কেবল সাংবাদিক বৈঠক করা ছাড়া কিসসু করেননি। যাঁরা গ্যাট চুক্তির বিরুদ্ধে বাংলা বনধ ডেকেছেন, যাঁরা আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তির বিরুদ্ধে ব্রিগেড কাঁপিয়েছেন, সেই তাঁরাই এ রাজ্যের লক্ষ লক্ষ বেকারের চাকরি চুরির লড়াইয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ধানি ফটকা ফাটানোর চেয়ে বেশি শব্দ করতে পারেননি। আর আমাদের বিরোধী দলনেতার ব্যাথা আমরা বুঝি, এই দুর্নীতির রমরমা দিনগুলোতে তিনিই তো ছিলেন পার্থ ঘনিষ্ঠ, পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে অযোগ্যদের সংখ্যাটা দেখলেই তা পরিস্কার হবে। কাজেই তিনি কামান চালাবো, কামান ফাটলে কিন্তু যা তা হবে, আমার কামানে এক বারে ২০ কেজির বারুদ পোরা যায়, ইত্যাদি হুমকির পর হুমকি দিয়েছেন, আর সময় চলে গিয়েছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে আবার শিক্ষা দফতরে ফিরে আসা ব্রাত্য এই সময়টাই চাইছিলেন।

হ্যাঁ, দুটো পরীক্ষা, তার স্বচ্ছতা, পরীক্ষা হলে কড়াকড়ি ইত্যাদি দেখেই বোঝা যাচ্ছে পরিস্কার যে, কেবল এক স্বচ্ছ পরীক্ষা নেওয়াটাই উদ্দেশ্য ছিল না, ভাবমূর্তি উদ্ধার করাটা ছিল আসল কাজ, আর সেটা অনেকটাই করতে পেরেছেন ব্রাত্য বসু আর তাঁর দফতর। এক প্রচন্ড ধাক্কা সামলে আবার দু’পায়ে দাঁড়ানোর ভরসাটা সম্ভবত ফিরে পেয়েছেন। নবম-দশমের ক্ষেত্রে পরীক্ষার আবেদন করেছিলেন ৩,১৯,৯৬১ জন পরীক্ষার্থী, পরীক্ষায় বসেছেন ২,৯৩,১৫২ জন। একাদশ-দ্বাদশের ক্ষেত্রে পরীক্ষার আবেদন করেছিলেন ২,৪৬,৫৪৩ জন। তাঁদের মধ্যে পরীক্ষা দিয়েছেন ২,২৯,৪৯৭ জন। নবম-দশমে ভিন রাজ্যের পরীক্ষার্থী ৩১,৩৬২ জন। একাদশ-দ্বাদশের ক্ষেত্রে তা ১৩,৫১৭ জন। হ্যাঁ, এই তথ্য বলে দেয় যে, যাবতীয় চাকরি করতে ইচ্ছুকরা পরীক্ষাতে বসেছেন, এবং তাঁরা ফলাফলের দিকে চেয়ে বসেও থাকবেন। এবং পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেই জানানো হয়েছে- এবার ওএমআর-এর স্ক্যান করা কপি ১০ বছর সংরক্ষণ করে রাখা হবে। ওএমআর-এর হার্ডকপি দু’বছর সংরক্ষিত থাকবে। কাজেই ন্যাড়া বাগচি বা কমরেড ভট্টাচার্যদেরও বিশেষ কিছু করার থাকছে না। সব মিলিয়ে এই দুদিনের পরীক্ষার পরে হাতে গরম এক শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির ইস্যু তার জৌলুস হারাবে, এবার কথা হবে পার্থ চোর, ব্রাত্যকে আগেই দায়িত্ব দিলে ভালো হত গোছের কিছু আবাল বিষয় নিয়ে, ওদিকে পার্থ অ্যান্ড কোম্পানির বেশিরভাগই জামিন পাবেন এবং জামিন পেলেও রাজনীতির ময়দানের সাইড লাইনেও সম্ভবত তাঁদের দেখা যাবে না। কেবল এই সময়ের মধ্যে হাজার হাজার মাস্টারমশাই, তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা, তাঁদের চাকরি হারানো ইত্যাদির বিষয়গুলো যে যন্ত্রণা তা থেকে যাবে। কমরেড সেলিম বা শান্তি কুঞ্জের শুভেন্দু অধিকারী আবার নতুন ইস্যুর খোঁজে মাঠে নামবেন, এবং শুনেছি পুজোর পরেই ব্রাত্য বসুর নতুন সিনেমার শুটিং। তিনি মন দিয়ে শান্তিতে চা-সিগারেট খেতে খেতে ‘অ্যাকশন’, ‘কাট’ বলবেন, রাতে অযথা ঘুম ভেঙে যাবে না।

Read More

Latest News