Tuesday, October 7, 2025
spot_img
HomeScrollFourth Pillar | আদানির জন্য আইনটাকেই বদলে দিলেন মোদিজি
Fourth Pillar

Fourth Pillar | আদানির জন্য আইনটাকেই বদলে দিলেন মোদিজি

আইন কার্যকর হলে আদানির আর পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র লাগবে না

যে আইনের জন্য আদানি সাহেবের ব্যবসা আটকে যাচ্ছে, সেই আইনটাকেই বদলে দিলেন মোদিজি। দেশ যে কে চালাচ্ছে সেটা এখন খুব পরিস্কার। উনি দেশে দেশে গিয়ে আদানির জন্য ব্যবসা কনট্রাক্ট সিকিওর করছেন, আবার দেশের মধ্যে কোথাও অসুবিধে হলেই “হাম হ্যায়্ না” বলে আইনটাকে বদলে দিচ্ছেন। মোদিজির সরকার পাশে আছে আদানির, আর তাই পরিবেশ দূষণ কোনও বাধাই নয়। এটাই প্রথম নয়, কিন্তু আপাতত আদানির নয়া কেচ্ছা আপনাদের জন্য। মুম্বই, কল্যাণের অ্যাম্বিভলি এলাকায় আদানি গোষ্ঠীর সহযোগী সংস্থা অম্বুজা সিমেন্টস লিমিটেডের ৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্রতি বছর ক্যাপাসিটির সিমেন্ট গ্রাইন্ডিং প্ল্যান্ট স্থাপনের প্রস্তাব কেবল এক শিল্প প্রকল্প নয়; এটা এখন ভারতে পরিবেশগত শাসন (Environmental Governance) আর কর্পোরেট ক্ষমতার ভারসাম্যের লড়াই এ পরিবেশের হেরে যাওয়ার কিসসা। প্রকল্পটা মুম্বই মেট্রোপলিটন অঞ্চলের (MMR) অন্তর্গত একটা অত্যন্ত জনবহুল এলাকায় তৈরি হচ্ছে। মহারাষ্ট্র দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের (MPCB) জন-শুনানিতে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রায় ২,৯০০টি মৌখিক আর লিখিত আপত্তি জমা পড়েছিল। এই বিপুল সংখ্যক বিরোধিতা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয় যে, জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য স্থানীয় মানুষজনদের উদ্বেগ কতটা তীব্র, কতটা জরুরি। কিন্তু তাতে কী? প্রকল্প তো আদানির, দেশের আসলি মালিকের। তাই কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক একটা খসড়া আইন প্রস্তাব করেছে, যা কার্যত এই বিতর্কিত প্রকল্পটাকেই পরিবেশগত ছাড়পত্র আর বহু মানুষের সমালোচনা, অভিযোগ আর এই মুহুর্তের আইন থেকে বাঁচার এক রাস্তা তৈরি করে দেবে।  দ্রুতগতিতে ‘ব্যবসা করার সুবিধে’ (Ease of Doing Business) নিশ্চিত করার নামে পরিবেশ সুরক্ষার মূল স্তম্ভগুলোকে ভেঙে ফেলার, একটা যা খুশি তাই করার চেষ্টা চলছে। এই মুহুর্তের আইন আর নীতির এই পরিবর্তনগুলো কীভাবে স্থানীয়দের জীবন, জীবিকা এবং দেশের পরিবেশগত সুরক্ষা কাঠামোকে দুর্বল করে দিচ্ছে, সেটা নিয়েই কিছু কথা, যা শুনলে মনে হবে, দেশটা আপনার আমার নয়, দেশ সেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও নয়, দেশ এখন হাতে গোনা কিছু ফড়েদের হাতে চলে গিয়েছে।

সিমেন্ট গ্রাইন্ডিং প্ল্যান্টগুলিকে সাধারণত ইন্টিগ্রেটেড সিমেন্ট প্ল্যান্টের তুলনায় কম দূষণকারী হিসেবে ধরা হয়। কারণ এতে ক্লিনকার (clinker) তৈরির জন্য দরকারি উচ্চ-তাপমাত্রার প্রয়োজন হয় না, যেমন ‘ক্যালসিনেশন’ বা ‘ক্লিনকেরাইজেশন’ করা হয় না। কিন্তু পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, যখন এটা একটা ঘনবসতিপূর্ণ শহরে তৈরি করা হয়, তখন তার দূষণের প্রভাব বহুগুণ বেড়ে যায়। স্থানীয়দের সবথেকে বড় উদ্বেগ হল, প্ল্যান্ট থেকে বেরিয়ে আসা ডাস্ট পার্টিকল, পার্টিকুলেট ম্যাটার (PM) আর বহুতর গ্যাসের বেরিয়ে আসা, নির্গমন, যার মধ্যে রয়েছে সালফার ডাইঅক্সাইড নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড আর কার্বন মনোক্সাইড। এই গ্রাইন্ডিং প্রক্রিয়ার সময় কেবল নয় বরং কাঁচামাল পরিবহনের সময়েও ‘ফিউজিটিভ ডাস্ট’ বা অনিয়ন্ত্রিত ধূলিকণা বেরিয়ে আসতে থাকে, যা বায়ু দূষণের এক বড় উৎস। সিমেন্ট শিল্প থেকে বেরিয়ে আসা এই দূষিত কণাগুলো অ্যাসিড বৃষ্টির কারণ হতে পারে এবং স্থানীয় ইকোসিস্টেম ও জীববৈচিত্র্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। আর যেহেতু এই প্ল্যান্টটা বৃহত্তর মুম্বই মেট্রোপলিটন অঞ্চলের অংশ আর অত্যন্ত জনবহুল জায়গাতে তৈরি হচ্ছে, তাই এখানকার মানুষের শ্বাসতন্ত্রের রোগ সমেত অন্যান্য বহু ধরণের স্বাস্থ্যঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্ল্যান্টটা যদি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এবং সংবেদনশীল জলপথের এত কাছাকাছি তৈরি করা হয়, তবে এটাকে আলতো করে ‘নিম্ন দূষণকারী’ আখ্যা দেওয়া হলেও, বাস্তবে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য এক মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে। গোটা এলাকার জনস্বাস্থ্য এবং নদীগুলোর জন্য গুরুতর সমস্যা তৈরি করতে পারে। প্ল্যান্টটা করাই হচ্ছে সংবেদনশীল নদী গুলোর পাশে। স্থানীয় এনজিও এবং বাসিন্দারা নিশ্চিত যে কারখানা থেকে দূষিত বর্জ্য কাছের উলহাস, কালু এবং ভাতসা নদীতে ফেলা হবে। কালু নদী প্রস্তাবিত প্ল্যান্ট থেকে মাত্র ০.১ কিলোমিটার দূরে আর উলহাস নদী প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে, আর এই নদীগুলো মুম্বই মহানগর এলাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ জল সরবরাহের উৎস। এই প্রকল্পের বাস্তবায়নে যদি কোনও সামান্য ত্রুটি বা ব্যর্থতা থাকে, তাহলে সংবেদনশীল এই নদীগুলোতে দূষিত বর্জ্য সরাসরি মিশে যাওয়ার ঝুঁকি থেকে যাবে। মানে আরেকটা ভিলাই হয়ে উঠবে এই কারখানা, অন্তত সেই সম্ভাবনা থাকছে।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজি যা বলবেন, সেটাই বিচার, সেটাই আইন

প্রকল্পের শুরুয়াতি জন-শুনানিতে বেশ কিছু মানুষ স্পষ্ট জানিয়েছেন যে এই প্রকল্পের কারণে তাঁদের কৃষি সংক্রান্ত জীবিকা এবং মৎস্যজীবীদের জীবনযাত্রা ব্যাহত হবে। তাঁদেরকে চাকরির কথা বলা হয়েছে। যদিও আজকের দিনে এরকম এক কারখানাতে আনস্কিলড লেবারের সবটাই কনট্রাক্টারদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়। আর স্কিলড লেবার তো আসবে বাইরে থেকে। তাঁদের কথার দাম কতটুকু? আদানির কোম্পানি ২৫০০টি গাছ লাগানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও , ইতিমধ্যেই সেই এলাকার গাছগুলোকেই কেটে ফেলেছে। পরিবেশ রক্ষার জন্য এই কর্পোরেট কোম্পানিরগুলোর প্রতিশ্রুতি, অঙ্গীকার আজ বিশ্বাসযোগ্য তো নয়ই, বরং তা হাস্যকর। এই প্ল্যান্টটা তৈরি হচ্ছে ন্যাশনাল রেয়ন কোম্পানির (NRC) পুরোনো জমিতে। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এনআরসি-র কারখানাটা প্রায় ৪৫০ একর জমিতে বিস্তৃত ছিল, যা আদানি গ্রুপ ২০২০ সালে অধিগ্রহণ করে। এনআরসি ২০০৯ সাল থেকে রুগ্ন এবং লকআউট অবস্থায় ছিল। আদানি গ্রুপ ইনসলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাঙ্ক্রাপসি কোড (IBC), ২০১৬- আইনেই সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে। আজ ২০২৫, এখনও পুরানো শ্রমিকদের বকেয়া ক্ষতিপূরণ (Pending Compensation/Dues) এবং পাওনা নিয়ে এখনও আইনি বিরোধ চলছে। শ্রমিকরা তাঁদের পাওনা টাকা পায়নি। জন-শুনানিতে পরিবেশগত প্রশ্নের পাশাপাশি এই শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। শ্রমিকদের পাওনা না মিটিয়ে দেওয়া, জমি অধিগ্রহণের স্বচ্ছতা নিয়ে বহু প্রশ্নের মীমাংসা এখনও হয়নি। এসব প্রশ্ন ওঠার পরেই মহামান্য আদানির কোম্পানি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, অদক্ষ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে আর স্থানীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এতদিন পরে কেন? জানা নেই। এই প্রতিশ্রুতি কবে কতটা পালন করা হবে, তার কোনও রোড ম্যাপ? এখনও নেই। স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানি জনস্বার্থ রক্ষার চেয়ে কর্পোরেট স্বার্থ চরিতার্থ করার দিকেই বেশি মনোযোগী। আদানির আগের সমস্ত কারবার সেই কথাই বলে। কিন্তু তারপরেও স্থানীয় বাসিন্দারা যদি বিশ্বাস করেন যে, এই প্ল্যান্ট তাঁদের জীবিকা এবং পরিবেশের উপর আঘাত হানবে। তবে ১৫০০ চাকরির প্রতিশ্রুতিও তাঁদের জীবনযাত্রার মানের বিনিময়ে গ্রহণযোগ্য হবে না, সেটা তাঁরা জানিয়ে দিয়েছে। এবং এইখানেই মাঠে নেমেছে মোদি সরকার, পরিবেশ ছাড়পত্র থেকে মুক্তি দেওয়ার নতুন আইন বানানোর শেষ পর্যায়ে তারা। কল্যাণ প্ল্যান্টের বিরোধিতার মধ্যে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর দিকটা হল, কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের একটা খসড়া বিজ্ঞপ্তি, যা পরিবেশগত ছাড়পত্র (EC) পাওয়ার প্রক্রিয়াকে সোজা করে দিয়ে এই বিশেষ প্রকল্পটাকে সরাসরি সুবিধে দেওয়ার পথ তৈরি করছে। কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক এক খসড়া বিজ্ঞপ্তি প্রস্তাব করেছে, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৩-এ পাবলিক ডোমেইন এ রাখা হয়েছে, যা এখনকার পরিবেশ দফতরের বিজ্ঞপ্তি, ২০০৬-কে সংশোধন করে একটা নির্দিষ্ট শিল্পশ্রেণিকে পরিবেশগত ছাড়পত্র আর দিতেই হবে না বলে প্রস্তাব এনেছে।

এখন আদানি সাহেবের সমস্যাটা কোথায়? পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র তিনি পাচ্ছেন না, কিন্তু এই আইন কার্যকর হলে তাঁর আর এই সার্টিফিকেট লাগবেই না – ‘না রহেগা বাঁশ না বজেগা বাঁশুরি’। এই আইন থেকে অব্যাহতি দিতে ‘ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টবিহীন স্ট্যান্ড-অ্যালোন সিমেন্ট গ্রাইন্ডিং ইউনিট’-এর আর আগে থেকে পরিবেশগত ছাড়পত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতাই থাকবে না। মজার বিষয়টা হল, আদানি গ্রুপের প্রস্তাবিত ৬ এমএমটিপিএ সিমেন্ট গ্রাইন্ডিং প্ল্যান্টটা ঠিক এই ‘স্ট্যান্ড-অ্যালোন সিমেন্ট গ্রাইন্ডিং ইউনিট’ ক্যাটাগরিতেই পড়ে। যদি এই খসড়া আইনটা পাস হয়ে যায়, তাহলে ১,৪০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পটার জন্য আর আগে থেকে পরিবেশগত ছাড়পত্র পাওয়ার কোনও বাধ্যবাধকতাই থাকবে না। আরও আছে। সরকার এই ছাড়ের পক্ষে যুক্তিও দিয়েছে। সরকার বাহাদুরের হিসেবে ‘নিম্ন দূষণ সম্ভাবনা’ এবং ‘সবুজ লজিস্টিকস’কে তুলে ধরেছে। তাদের দাবি, যেহেতু এই প্ল্যান্টগুলোতে উচ্চ-তাপমাত্রার প্রক্রিয়া হয় না, এবং কাঁচামাল এবং সমাপ্ত পণ্য পুরোটাই রেলওয়ে বা ই-ভেহিকলসের মাধ্যমে পরিবহন করা হবে, তাই এতে নাকি দূষণের সম্ভাবনা কম। কিন্তু এই নীতিগত পরিবর্তনের সবচেয়ে মারাত্মক দিকটা হল- এই খসড়া বিজ্ঞপ্তি কার্যকর হলে, এই ধরনের সমস্ত ইউনিটগুলোর জন্য জনগণের পরামর্শ (Public Consultation) বা বিস্তারিত পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (EIA) রিপোর্ট তৈরি করার আর কোনও প্রয়োজনই থাকবে না। একটা দু’কোটি টাকার কারখানা খুলতে হলে পরিবেশ সংক্রান্ত সার্টিফিকেট দরকার হয়, আর ১২০০ কোটি টাকার এই কারখানার জন্য কোনও পরিবেশ সংক্রান্ত সার্টিফিকেট লাগবে না। যখন সরকার নিজেই আইনকানুন বদলে দিয়ে এই ফড়ে দালাল পুঁজিকে বাড়তে সাহায্য করে, কর্পোরেটদের অন্যায় সুবিধে দেয়, তখন স্থানীয় মানুষের প্রতিবাদ এবং পরিবেশ আদালতই শেষ ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এই প্রবণতাই চলতে থাকলে, পরিবেশগত সুরক্ষা কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে, আর হঠাৎ এক সকালে শয়ে শয়ে নিথর লাশের ওপরে বসে মানুষের কাঁদা ছাড়া আর করার কিছু থাকবে না। এই ঘটনাটা পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ভারতের বর্তমান নীতিগত কাঠামোতে, দ্রুত উন্নয়নের নামে পরিবেশ দূষণকে আর কোনও বাধা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না। যদি আদানির দরকার হয়, ফড়ে কর্পোরেটদের দরকার হয় তাহলে দেশের আইন পালটে দিয়েও তাদের অবাধ লুঠতরাজকে চালিয়ে যেতে দিয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আমাদের প্রধানমন্ত্রী মোদিজি।

Read More

Latest News