১৫ অগাস্ট লালকেল্লা থেকে ভাষণে মোদিজি বলেছেন, আরএসএস হল বিশ্বের সবথেকে বড় এনজিও, নন গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন। হঠাৎ আরএসএস নিয়ে লালকেল্লা থেকে এত প্রশংসা কেন? ক’দিন পরেই বোঝা গেল, আরএসএস মাথা মোহন ভাগবত জানিয়ে দিলেন না না, আমি কাউকে ৭৫-এ অবসর নিতে বলিনি, এমনকী আমিও ৮০ পর্যন্ত অনায়াসে টানতে পারি। হ্যাঁ সেপ্টেম্বর এসে গেছে, এ মাসেই তো দুজনেই পা দেবেন ৭৫-এ, কাজেই সেই প্রশ্ন উঠত বইকী, কবে গায়ে শাল জড়িয়ে পদ ছাড়ছেন? কিন্তু তার আগেই লালকেল্লা থেকে মোদিজির প্রশংসা আর নাগপুর থেকে মোহন ভাগবতের আশ্বাসবাণী। ল্যাটা চুকল, দেহত্যাগ পর্যন্ত পদত্যাগের যে বিধি ভারতীয় রাজনীতিতে আছে সেটাই চলবে। কিন্তু কথা সেটা নয়, কথা হল লালকেল্লা থেকে আবার একটা মিথ্যে বললেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। এখন অবশ্য এটাই খবর হওয়া উচিত যে এই তো তিনি এক সত্যি কথা বলেছেন। কিন্তু সেই মিথ্যেটা কী? যা তিনি লালকেল্লা থেকে দেশের মানুষদের বললেন? তিনি বলেছেন আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ হল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এনজিও। তাই নাকি? তো দেশের আইন কী বলে এই এনজিও নিয়ে?
আইন খুব পরিষ্কার, আপনাকে রেজিস্টার্ড হতে হবে, মানে আবেদন করতে হবে, সেই আবেদনে সংগঠনের নামের জন্য আবেদন করতে হবে, চাইলেই তো হবে না, সেই নামে অন্য কোনও সংগঠন আছে কি না তা জানতে হবে, যদি থাকে তাহলে বিকল্প নাম দিতে হবে। এনজিওর নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক ডোনেশনের হিসেব থাকতে হবে, টাকা কোথায়, কোন উদ্দেশ্যে খরচ হয় তা জানাতে হবে, সেই আয় এবং ব্যয়ের আর্থিক হিসেব পত্র অডিট বা পরীক্ষা করাতে হবে। যদি বিদেশ থেকে টাকা আসে, যদি সংগঠনে বিদেশের লোকজন থাকে তার জন্য আলাদা অনুমতি নিতে হবে, তো আরএসএস-এর সেসব কিছু আছে? ওই আবেদনেই জানাতে হবে কমিটিতে কারা আছে? কীভাবে কমিটির লোকজন বাছাই হয়, দায়িত্ব নেয়, তার বিবরণ থাকতে হবে। সেসব কি আছে? না, জেনে রাখুন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ একটা আনরেজিস্টার্ড সংগঠন, পাড়ার ক্লাবেরও যে রেজিস্ট্রেশন আছে, আরএসএস-এর সেটা নেই। মহারাষ্ট্রে রেজিস্টার্ড আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ কয়েকজন চালান, এই নামেই তাঁরা তাঁদের সংগঠন রেজিস্টার্ড করেছেন কিন্তু তাঁদের সঙ্গে এই আরএসএস-এর কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁরা প্রথমে জানতে চেয়েছিলেন আরএসএস রেজিস্টার্ড অর্গানাইজেশন কি না, জানানো হয়, না, আরএসএস-এর কোনও রেজিস্ট্রেশন নম্বর নেই। এরপরে তাঁরা এই নামেই তাঁদের সংগঠন রেজিস্টার করেন, এবং সেই সংগঠনের তলায় বসেই আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরোধিতা করেন।
হ্যাঁ, আরএসএস-এর দেশজুড়ে যে বিরাট কর্মযজ্ঞ, যে বিরাট সংখ্যক শাখা দেশে বিদেশে চলছে, লক্ষ কোটি টাকা যাঁরা ডোনেশন হিসেবে পান, তাঁরা রেজিস্টার্ড অর্গানাইজেশন নন, তাঁদের হিসেবের কোনও অডিট হয় না। তাঁদের কমিটি কীভাবে বাছাই হয়, কীভাবে একজন সরসংঘচালক বসেন মাথায় তা জানানো হয় না, না সেখানে কোনও নির্বাচন নেই, লোক দেখানো গণতন্ত্রটুকুও নেই। হ্যাঁ, এইভাবেই এক স্বেচ্ছাচারী সংগঠন আজ ভারতের রাজনীতি সমাজনীতি নিয়ে হরবখত কথা বলেই চলেছে, তাঁরাই বলে দিচ্ছেন হিন্দু নারীদের ক’টি করে সন্তান প্রসব করতে হবে। সেই সংঘের মাথা আইনের বিরোধিতা করে, সংবিধানের বিরোধিতা করে কাশী মথুরার দখল চাইছেন। সেই সংগঠনকে লালকেল্লা থেকে মোদিজি বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিওর খেতাব দিলেন। এই সর্ববৃহৎ এনজিও গান্ধী হত্যার পরে মিষ্টি বিলিয়েছিল, নেহরু প্রধানমন্ত্রী, বল্লভভাই প্যাটেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ আরএসএসকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছিলেন। কী বলাছিল সেই আদেশনামায়? “to root out the forces of hate and violence that are at work in our country and imperil the freedom of the Nation and darken her fair name”. “Undesirable and even dangerous activities have been carried on by members of the Sangh. It has been found that in several parts of the country individual members of Rashtriya Swayamsevak Sangh have indulged in acts of violence involving arson, robbery, dacoity, and murder and have collected illicit arms and ammunition”.
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ভোট চোর, গদ্দি ছোড়
আরএসএসকে এক বেআইনি সংগঠন বলে ঘোষণা করে বলা হয়েছিল তারা হিংসা ছড়ায়, ডাকাতি করে, খুন করে, বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র রাখে, সেই হিংসার শিকড় উপড়ে ফেলার জন্যই আরএসএসকে ব্যান করা হল। হ্যাঁ, সেদিন প্যাটেল ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তাঁর কাছে এর সব খবর ছিল। এবং মাস ছয়েক পর থেকেই তখনকার সরসংঘচালক আমরা আর রাজনীতিতে থাকব না, আমরা আমাদের সামাজিক কাজ ছাড়া কিছুই করব না, ইত্যাদি মুচলেকা দেওয়া শুরু করেন, যেমনটা সাভারকর বহু আগেই ইংরেজদের কাছে দিয়েছিলেন। তো সেই চিঠির উত্তরে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গোলওয়ালকরকে লিখলেন “এতে কোনও সন্দেহ নেই যে আরএসএস হিন্দু সমাজের সেবা করেছে… কিন্তু আপত্তিকর অংশটা তখন তৈরি হল, যখন তারা প্রতিশোধের আগুন জ্বালাতে মুসলমান মানুষজনদের উপর আক্রমণ করা শুরু করল। হিন্দুদের সংগঠিত করা আর তাদের সাহায্য করা এক জিনিস, কিন্তু নিজেদের দুর্দশার প্রতিশোধ নিরীহ ও অসহায় পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদের উপর নেওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। এছাড়াও, কংগ্রেসের প্রতি আরএসএস-এর বিরোধিতা এতটাই বিদ্বেষপূর্ণ ছিল যে তারা কোনও শালীনতা বা ভদ্রতার তোয়াক্কা করেনি, মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করেছিল। তাদের সমস্ত ভাষণ সাম্প্রদায়িক বিষে ভরা ছিল। হিন্দুদের উৎসাহিত করার জন্য বিষ ছড়ানোর কোনও দরকার ছিল না… এই বিষের চূড়ান্ত পরিণতি হিসাবে, দেশকে গান্ধীজির মতো একজন অমূল্য জীবনের বলিদান দেখতে হয়েছে… আরএসএস-এর প্রতি সাধারণ মানুষের বিরোধিতা আরও তীব্র হয়, যখন আরএসএস কর্মীরা গান্ধীজির মৃত্যুর পর আনন্দ প্রকাশ করে এবং মিষ্টি বিতরণ করে।”
হ্যাঁ, প্যাটেল এই কথা লিখছেন। এই আরএসএস এক্কেবারে পরিকল্পনা করে ১৯৯২-এ বাবরি মসজিদ ভেঙেছিল, আদালতের কাছে এফিডেভিট দিয়েছিল তাদের সরকার, যে বিতর্কিত মসিজিদের কোনও ক্ষতি করা হবে না, কিন্তু তারা ঘণ্টা পাঁচ ছয়ের মধ্যে এক শতাব্দী প্রাচীন মসজিদকে গুঁড়িয়ে দিল, তারা তোয়াক্কাও করেনি এই দেশের আইন কানুনকে। এই ১৫ অগাস্ট লালকেল্লা থেকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী আরএসএস এক মহান সংগঠন আর তার দেশপ্রেম নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছিলেন, দেখুন সেই দেশপ্রেমের ইতিহাস। আরএসএস-বিজেপির দেশপ্রেম? পাঁচ পাঁচটা চিঠিতে যাদের নেতা ফিলোজফার গাইড, সাভারকর কাকুতি মিনতি করে মুচলেকা দিয়েছে ইংরেজদের কাছে, যাতে ছত্রে ছত্রে আছে বীর সাভারকরের কাপুরুষতার কাহিনি, কীভাবে ইংরেজদের সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়ে ছাড়া পেতে চেয়েছিলেন আন্দামানের কারাগার থেকে, তারা দেশপ্রেমিক? সরসঙ্ঘচালক গোলওয়ালকর ইংরেজদের লিখছেন, কীভাবে ৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরুদ্ধে তাঁরা ইংরেজদের পাশে দাঁড়াতে চান। সঙ্ঘের প্রত্যেক সদস্যের কাছে নির্দেশ যাচ্ছে এই মর্মে, নির্দেশ যাচ্ছে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগদান না করার। এই বাংলাতে হক মন্ত্রিভার দু’ নম্বর মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ইংরেজদের চিঠি লিখে জানাচ্ছেন কীভাবে শায়েস্তা করা হবে ৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের আন্দোলনকারীদের। যারা এই নির্দেশ দিচ্ছে, তারা দেশপ্রেমী? যারা মুসলিম লিগের হাত ধরে দেশটাকে দু’ টুকরো করার আবেদন করছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে, তারা দেশপ্রেমিক? তাদের কাছ থেকে আমাদের দেশপ্রেম শিখতে হবে যারা জওয়ানদের লাশের উপর দিয়ে নির্বাচনী সাফল্য আনে, আমার চেষ্টা করে?
যারা ৫৩ বছর জাতীয় পতাকা তাদের সদর দফতরে তোলেনি, তুলেছে ভাগওয়া ঝান্ডা তারা আজ জাতীয় পতাকার কথা বলছে। আম্বেদকর, সংবিধানের জন্য তৈরি গণপরিষদ নিয়েছিল এই ত্রিবর্ণ জাতীয় পতাকার সিদ্ধান্ত। কী ছিল তখন এই আরএসএস-এর ভূমিকা? তাদের পত্রিকা দ্য অর্গানাইজারে তারা লিখেছিল, হিন্দুরা কখনও এই ত্রিবর্ণ পতাকাকে মেনে নেবে না, তিন সংখ্যাটাই হল অশুভ, তিনটে রং দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে, হ্যাঁ এ কথা আরএসএস-এর মুখপত্রে লেখা হয়েছিল, তারা আজ জাতীয় পতাকার কথা বলছে, তারা জাতীয় পতাকার সম্মান অসম্মান নিয়ে কথা বলছে? গোলওয়ালকর তাঁর বই বাঞ্চ অফ থটস-এর ‘ড্রিফটিং ড্রিফটিং’ শিরোনামে লিখছেন, আমাদের নেতারা যে নতুন পতাকা তৈরি করলেন তা মানুষের নজর সরিয়ে দেওয়ার জন্য, আমাদের কি অন্য কোনও পতাকা ছিল না? আজ স্বাধীনতা দিবসে তেরঙার তলায় দাঁড়িয়ে সেই বিশ্বাসঘাতকদের মুখে শুনতে হবে দেশপ্রেমের কথা? একটা বেআইনি সংস্থাকে বিশ্বের সবথেকে বড় এনজিও বললেন আমাদের মিথ্যেবাদী প্রধানমন্ত্রী।