এ এক অন্য প্রেমের গল্প। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই এ গল্পের শুরু। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদি সেই সময় থেকেই ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। কতটা ঘনিষ্ঠ, সেটা বোঝা গেল ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফার নির্বাচনী প্রচারের সময়। নরেন্দ্র মোদিকে দেখা গেল ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারমঞ্চে, যেখানে তিনি হাত নাড়িয়ে বললেন, “আব কি বার ট্রাম্প সরকার”। এখানে বলে রাখা যাক, আসল যে স্লোগান অর্থাৎ ‘আব কি বার মোদি সরকার’, যেটাকে একটু পাল্টে নিয়ে ট্রাম্পের প্রচারে মোদি ব্যবহার করেছিলেন, সেই স্লোগানের লেখক পীযূষ পাণ্ডে শুক্রবার প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর লেখা স্লোগান যে আমেরিকার নির্বাচনে ব্যবহার হবে, এমনটা পীযূষ ভেবেছিলেন কী?
সে যাই হোক, এবার ট্রাম্প-মোদির গল্পে ফিরে আসি। চলতি বছরে ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মোদি ছিলেন সেই সব প্রথম দিকের বিশ্বনেতাদের একজন, যিনি হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেন। পহেলগামে জঙ্গি হামলার পরেও এই দুই নেতার কিন্তু ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। জুন মাসে কানাডায় জি-সেভেন সামিটের সময় তাঁদের মধ্যে টেলিফোনে কথা হয়। এরকম কথা আরও হয়েছে। বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রি জানিয়েছিলেন, ভারত-পাক যুদ্ধের সময় মোদি আর ট্রাম্পের মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে কোনও কথাই হয়নি, কেন না তখন ‘অপারেশন সিঁদুর’ চলছিল। কিন্তু ট্রাম্প কী দাবি করলেন? ঠিক উল্টো কথাটা। বললেন, যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী বাণিজ্য সম্পর্কই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধ করতে সাহায্য করেছিল।
কিন্তু যেকোনও সম্পর্কেই জোয়ার-ভাটা থাকে, টানাপোড়েন থাকে। মোদি-ট্রাম্পও তার বাইরে নন। ভারত-পাক যুদ্ধের পর পাকিস্তান যখন আমেরিকার কাছে গুরুত্ব পাচ্ছিল, তখন উল্টোদিকে মোদি-ট্রাম্পের রাজনৈতিক যোগাযোগেও কিন্তু ভাটার টান ধরে। বিশ্বের রাজনৈতিক মহল মনে করছিল, এই সময় ভারত মার্কিন সম্পর্কের অবনতি হয়। এরপর অগাস্টে ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। তবে সেপ্টেম্বর থেকেই বরফ গলতে শুরু করল। ৭৫তম জন্মদিনে মোদিকে শুভেচ্ছা জানালেন ট্রাম্প। এরপর এই দুই নেতার মধ্যে, একাধিকবার কথাবার্তা হয়েছে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বিহার ভোটে চুপ RSS, হাত ছাড়ছে বিজেপির? একা মোদি বাঁচাতে পারবেন NDA-র গদি?
এখন কথা হচ্ছে ট্রাম্প আর মোদির সম্পর্ক নিয়ে এতক্ষণ ধরে এতো বকবক করলাম কেন? না, ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ গাইছি মনে করবেন না। আসল প্রশ্নটা এই, ভারত নামের দেশটাকে কে চালাচ্ছে? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি না আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প? আমাদের এখানে বিরোধীরা একটা কথা বারবার বলে আসছেন। তা হল, মোদি কখনওই ট্রাম্পের কোনও কথার প্রতিবাদ করেন না। আর তার থেকেও বড় কথা, বিদেশ নীতিতে ভারতের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ভারতের আগেই দুনিয়ার সামনে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর আগে ভারত-পাক যুদ্ধ নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প মুখ খোলার পর ভারতের বিদেশমন্ত্রক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। এবার আবার এক বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প, এবং তারপর বিবৃতি জানিয়েছে ভারত। যেমনটা আগেও হয়েছিল আর এখনও হল।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেই বিস্ফোরক মন্তব্যটা কী? ট্রাম্প জানিয়েছেন, মোদির সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে এবং মোদি তাঁকে বলেছে, ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনবে না। ট্রাম্প আরও বলেন, তাঁর আশা, এর ফলে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে প্রভাব পড়বে। যদিও ভারত নিজেদের অবস্থান বজায় রেখে জানিয়েছে, দেশের মানুষকে সস্তায় জ্বালানী দিতে বাজার মূল্য অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জ্বালানী কিনবে তারা।
কিন্তু মোদি, নিজে ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্পের কথার কোনও প্রতিবাদ করেননি। ঠিক যেমনটা করেননি, ভারত-পাক যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্যের বিরুদ্ধে। আর শুধু তাই নয়, আসন্ন ২২তম এশিয়ান সামিটে সশরীরে হাজির থাকবেন না মোদি, ভার্চুয়ালি দেখা যাবে তাঁকে। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? মার্কিন চাপে রুশ তেল কেনা বন্ধ করবে ভারত? দেশে দাম বাড়বে জ্বালানীর? দীপাবলির পর এই জল্পনাই এখন তুঙ্গে উঠেছে। ২০১৪ সাল থেকে যে এশিয়ান সামিটে বারবার হাজির ছিলেন মোদি, এবার সেখানে থাকবেন না কেন? ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখোমুখি হতে পারেন এই ভয়ে? আর এটা কী সত্যি যে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া মোদির কাছে ঝুঁকির ব্যাপার? কেন না, ৫৩বার ট্রাম্প বলেছেন তিনি ভারত-পাক যুদ্ধ থামিয়েছেন। ৫বার বলেছেন, রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধের আশ্বাস দিয়েছে ভারত। আর শুধু এটুকুই নয়, বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করে ট্রাম্পের বক্তব্য, “এটা একটা প্রক্রিয়া, আচমকা সবকিছু বন্ধ করা যায় না, বছরের শেষের দিকে তেল কেনার পরিমান ভারত ক্রমশ কমিয়ে দেবে।” ট্রাম্পের এই দাবি নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি ভারত। তবে সংবাদসংস্থা রয়টার্স জানাচ্ছে, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রি এর মধ্যেই তেল কেনা বন্ধ করেছে। একই পথে এগোচ্ছে ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন। রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ না করলে আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যে ধাক্কা আসবে, সেজন্য?
রাশিয়ার একটা বড় টাকা আসে সেখানকার তেল বেচে। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ না করায় সেই তেল বেচা বন্ধ করতে চেয়েছিল আমেরিকা। আর সেখানেই নয়া দিল্লিকে দাবার বোড়ে বানাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন? নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দুই রুশ তেল কোম্পানি রসনেক্ট ও লুক অয়েলের উপর। আর এই নিষেধাজ্ঞার খেলায় ট্রাম্প জড়িয়ে নিচ্ছে ভারতকে। এর ফলে রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল কেনা কমিয়ে আনতে পারে ভারত। যার ফলে গভীর প্রভাব পড়তে পারে দেশের অর্থনীতিতে। কী করবেন মোদিজি? এরকমটা শোনা যাচ্ছে, আমেরিকার আদালতের হাত থেকে আদানিকে বাঁচানোর জন্যই ট্রাম্পের সামনে মুখ বুজে আছেন মোদি। আদানির কান ধরে টানলে বিজেপির মাতারাও কি একের পর এক আসবে? সেই জন্যই কি এই নীরবতা? কে চোকাবে এই নীরবতার দাম? দেশের মানুষ আবার কে?







