Thursday, September 11, 2025
বাঙালি কাউন্টডাউন
HomeScrollFourth Pillar | প্রধানমন্ত্রী মণিপুর যাচ্ছেন, সমস্যা মিটবে না সমস্যার নতুন অধ্যায়...
Fourth Pillar

Fourth Pillar | প্রধানমন্ত্রী মণিপুর যাচ্ছেন, সমস্যা মিটবে না সমস্যার নতুন অধ্যায় শুরু হবে?

মণিপুরের ভৌগোলিক বিন্যাস আর জাতিগত বিভাজন খুবই স্পষ্ট

২০২৩ সালের ৩ মে মণিপুরে ভয়াবহ জাতিদাঙ্গা শুরু হয়েছিল। রাজ্যের প্রধান দুই জাতিগোষ্ঠী, ইম্ফল উপত্যকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই এবং পাশেই পাহাড়ের কুকি-জো সম্প্রদায়ের মধ্যে শুরু হওয়া এই সংঘাত দ্রুত এক গৃহযুদ্ধের রূপ নিয়েছিল, যার আগুন এখনও নেভেনি। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, এই দাঙ্গায় প্রায় ২৬০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন, ৬০,০০০ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন, এবং ৪,৭৮৬টারও বেশি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং চার্চ, মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি সত্ত্বেও দেশের প্রধানমন্ত্রী এতদিন মণিপুরে যাওয়ার সাহসটুকুও দেখাননি বা দেখাতে পারেননি। এখন একটা চুক্তি সই হওয়ার পর তাঁর সফরের খবর সামনে এসেছে। প্রশ্ন হল, এতদিন পর প্রধানমন্ত্রীর এই সফর কি সমস্যার সমাধান করতে পারবে? যে চুক্তি হয়েছে, তা কি সত্যিই শান্তি ফিরিয়ে আনবে, নাকি এ্রর পরেই অশান্তির নতুন অধ্যায় শুরু হবে। সেটা বুঝতে গেলে প্রথমেই বুঝতে হবে মণিপুরের এই সংকট হঠাৎ করে শুরু হয়নি। ৩ মে’র ঘটনা ছিল বহু বছরের জমে থাকা ক্ষোভ এবং অবিশ্বাস থেকে তৈরি এক বিস্ফোরণ। প্রথম কারণটা হল জাতি, জমি আর ক্ষমতা: সেখান থেকেই জন্ম নেওয়া এক দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের শিকড়, যা আজকের নয়।

মণিপুরের ভৌগোলিক বিন্যাস আর জাতিগত বিভাজন খুবই স্পষ্ট। রাজ্যের মোট ভূখণ্ডের ৯০ শতাংশ পাহাড়ি অঞ্চল, যেখানে প্রধানত কুকি, নাগা ও অন্যান্য উপজাতিরা বাস করেন। অন্যদিকে, মাত্র ১০ শতাংশ সমতল উপত্যকা, যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মেইতেই জনগোষ্ঠীর মানুষজন থাকেন। এই দুটি অঞ্চলের মধ্যে ভূমির অধিকার এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে এক ঐতিহাসিক লড়াই বহুকালের। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, মেইতেইরা পাহাড়ি অঞ্চলে জমি কিনতে বা বসবাস করতে পারেন না, অথচ উপজাতিদের উপত্যকায় জমি কেনা বা বসবাসের ক্ষেত্রে কোনও আইনি বাধা নেই। মেইতেইরা অভিযোগ করে, এই অসম আইন তাদের এমনিতেই কম জমির দখলদারিকে আরও সংকুচিত করছে, যা তাদের সংস্কৃতি এবং পরিচয়কে কালচারাল আইডেন্টিটিকে হুমকির মুখে ফেলছে। ১৯৯০-এর দশকে কুকি ও নাগাদের মধ্যেও একই ধরনের সংঘাত হয়েছিল, যেখানে নাগারা কুকিদের তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করেছিল। সেই সংঘাতের ফলে ১,০০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। মণিপুরের সংঘাতের মূল কারণ কোনও একক ঘটনা নয়, বরং এটা জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব, জমির অধিকার আর রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের এক অনেক পুরোনো লড়াই, যা বারবার নতুন মোড়কে ফিরে আসে।

ওদিকে মূলত হিন্দু মেইতেইরা ২০১২ সাল থেকে তফসিলি উপজাতি মর্যাদার দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের যুক্তি হল, এই মর্যাদা পেলে তারা তাদের সংস্কৃতি, ভাষা এবং ঐতিহ্য রক্ষা করতে পারবে। তারা আরও মনে করে, ১৯৪৭ সালে ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির আগে তারা উপজাতি হিসেবেই পরিচিত ছিল এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের জনসংখ্যাও কমে আসছে। কুকি বা অন্যান্য উপজাতিরা এই দাবির তীব্র বিরোধিতা করছে। তাদের ভয়, মেইতেইরা এসটি মর্যাদা পেলে তাদের জন্য সংরক্ষিত চাকরি, শিক্ষায় সুযোগ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, পাহাড়ি অঞ্চলে জমি কেনার অধিকার পেয়ে যাবে। যেহেতু মেইতেইরা সংখ্যায় বেশি এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, সম্পদশালী তাই তারা উপজাতিদের অধিকার কেড়ে নেবে বলে কুকিরা মনে করে। মণিপুরের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং ২০১৮ সাল থেকে ‘মাদক বিরোধী যুদ্ধ’ (War on Drugs) শুরু করেছিলেন। অনেকেই বলেন কুকি উপজাতি মানুষজন ড্রাগ তৈরি, পাচার ইত্যাদির ব্যবস্থা করলেও মূল কন্ট্রোল থাকে মেইতেই কিছু মাফিয়াদের উপরেই, বীরেন সিং সেই মেইতেই মাফিয়াদেরই সাহায্য করার জন্য এই নাটক করছেন। কিন্তু সে যাই হোক মণিপুরের এই সংকটকে কেবল একটা হাইকোর্টের রায়ের ফল হিসেবে দেখা ভুল। এটা আদতে এক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লড়াই, যেখানে হাইকোর্টের রায়টি কেবল এক ‘শেষ খড়কুটো’ হিসেবে কাজ করেছে। আসল উত্তেজনা বহু বছর ধরে জমে আছে— ভূমি, পরিচয় এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং-এর ‘ওয়ার অন ড্রাগস’কেও কুকি জনগোষ্ঠী আসলে এক জাতিগত আক্রমণ হিসেবেই দেখেছে।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজি = এক প্রকাণ্ড মিথ্যেবাদী

এই সমস্ত কারণে তাদের ক্ষোভ জমা হচ্ছিল, আজ নয় বহুকাল ধরেই, এবং যখন মেইতেইদের এসটি মর্যাদার বিতর্ক সামনে আসে, তখন এই দুই পক্ষের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ ফেটে পড়ে। মানে, মাদক বিরোধী অভিযান (অর্থনৈতিক আঘাত) + ভূমি সংক্রান্ত বিতর্ক (ঐতিহাসিক ভয়) + এসটি মর্যাদা ইস্যু (রাজনৈতিক অধিকারের ভয়) = ভয়াবহ জাতিদাঙ্গা। এই কারণগুলো একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এই জাতিদাঙ্গা একটা চুক্তিতেই মিটে যাবে এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক (MHA) এবং কুকি-জো গোষ্ঠীগুলির মধ্যে নতুন ‘সাসপেনশন অফ অপারেশনস’ (SoO) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে । এটাকে বিরাট এক সাফল্য হিসেবে দেখানো হলেও এই চুক্তির বাস্তবতা এবং কার্যকারিতা নিয়ে বহু প্রশ্ন আছে। ইন ফ্যাক্ট মণিপুরের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সরকারের চুক্তির ইতিহাসও অনেক পুরোনো। প্রতিবছর চুক্তি হয়, প্রতিবছরেই তা ভাঙে। ২০০৮ সাল থেকে সরকার কুকি-জো গোষ্ঠীর (KNO এবং UPF) সাথে এই ‘সাসপেনশন অফ অপারেশনস’ (SoO) চুক্তি করে আসছে। এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য সবসময়েই ছিল সশস্ত্র পথ ছেড়ে আলোচনার মাধ্যমে এক রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছনো। কিন্তু মজার কথা হল এই চুক্তির আওতায়, সশস্ত্র গোষ্ঠীর ক্যাডাররা তাদের জন্য নির্দিষ্ট ক্যাম্পে আশ্রয় পায় এবং সরকারের কাছ থেকে মাস মাইনে পায়। তারা সব অস্ত্র কোনওদিনই সারেন্ডার করে না, ক্যাম্পে থাকাকালীনই বাকি অস্ত্র নিয়ে গুন্ডামি, তোলাবাজি আর ড্রাগের ব্যবসা চালিয়েই যায়। কিছু বিদ্রোহী নেতা রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছেন, কেউ কেউ মাদক চক্র চালাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ শুধু সরকারের কাছ থেকে মাসে মাসে টাকা নিয়ে দিব্যি আছেন। মানে ছেলে বড় হয়েছে, এবারে জঙ্গলে গিয়ে একে ফর্টি সেভেন ধরে নাও, তারপর হয় রাজনীতি, না হলে ড্রাগ, নাহলে মাসমাইনে।

বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী, মণিপুরের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো, এই মাদক ব্যবসা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে। তারাই আবার এই অর্থ দিয়ে অস্ত্র কেনে, নতুন ক্যাডার নিয়োগ করে আর তাদের নতুন গোষ্ঠী চালায়। কুকি ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (KNO), ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট (UPF), ইউনাইটেড ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (UNLF), পিপলস লিবারেশন আর্মি (PLA) আর পিপলস রেভোলিউশনারি পার্টি অফ কাংলেইপাক (PREPAK) এর মতো সংগঠনগুলো চাঁদাবাজি আর মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাহলে এবারের চুক্তিতে নতুন কী? সংঘাত-প্রবণ এলাকা মানে যেগুলোকে ওরা ওয়ার জোন বলছে, সেখান থেকে বিদ্রোহী ক্যাম্পগুলো দূরে সরানো, আর ক্যাডারদের সরাসরি তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়া, এর বাইরে নতুন কিছুই নেই। আর চুক্তি অনুযায়ী NH-2 হাইওয়ে খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। চুক্তি হওয়ার ক’দিনের মধ্যেই মেইতেইদের প্রধান সংগঠন Coordinating Committee on Manipur Integrity (COCOMI) এই চুক্তিকে “আমাদের ঠকানো হচ্ছে” আর “চুক্তি গণতন্ত্র বিরোধী” তাই আমরা এই চুক্তি মানি না বলে জানিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, কুকিদের মধ্যে কিছু গোষ্ঠী চুক্তিটিকে সমর্থন করলেও, কিছু গ্রাম স্বেচ্ছাসেবক গোষ্ঠী (VVCC) NH-2 হাইওয়ে খোলার সিদ্ধান্তকে “অননুমোদিত” ও “বাতিল” বলে ঘোষণা করেছে। এই ধরনের একপেশে নীতি কোনও স্থায়ী শান্তি দিতে পারে না। তাহলে হাতে কী থাকল? পেনসিলও নয়। অথচ চুক্তি হয়েছে বলে লাফাচ্ছেন অমিত শাহ।

মণিপুর থেকে আলাদা হয়ে একটি নতুন রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের দাবি কুকিরা ১৯৯০ সাল থেকেই জানিয়ে আসছে। তারা মনে করে, মেইতেইদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার তাদের অবহেলা করছে, এবং নাগাদের মতো জাতিগোষ্ঠীও তাদের ভূমি অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে। কুকি নেতারা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, তাঁদের ‘পৃথক প্রশাসন’-এর দাবি থেকে তারা কোনও অবস্থাতেই সরছেন না।  অন্যদিকে, মেইতেইরা মণিপুরের আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে কোনওভাবেই ছাড় দিতে রাজি নয়। তাদের মূল উদ্বেগ হল, রাজ্য বিভক্ত হলে তাদের জাতিগত ও ঐতিহাসিক পরিচয় হুমকির মুখে পড়বে। মেইতেই সংগঠনগুলো বারবার ঘোষণা করেছে যে, মণিপুরের ভূখণ্ড ভাগ করা হলে তারা নতুন করে আন্দোলন শুরু করবে। মণিপুরের মানুষ দুই বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিল, তাদের এই সমস্যা ধৈর্য ধরে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে মেটানো সম্ভব ছিল, কিন্তু তা না করে এক চটজলদি চুক্তি আর মোদিজির এই সংক্ষিপ্ত তিন ঘণ্টার সফর কোনও সমাধান এনে দেবে না। বরং ঠিক এই সময় থেকেই আবার নতুন করে জাতিদাঙ্গা লেগে গেলে অবাক হব না। দীর্ঘ রাজনৈতিক নীরবতার পর প্রধানমন্ত্রীর এই সফর কেবল এক ‘প্রতীকী’ পদক্ষেপ। এটা সমস্যার মূল সমাধান না করে, কেবল এক ইতিবাচক পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করতেই পারত, কিন্তু সেই পদক্ষেপ নিতে হত সেই তখনই যখন মণিপুর জ্বলছিল, তখন উনি ট্রাম্প সাহেবকে নিয়ে আদেখলাপনায় ব্যস্ত ছিলেন। আজ কেবল এক প্রতীকী পদক্ষেপে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।

Read More

Latest News