Tuesday, September 9, 2025
বাঙালি কাউন্টডাউন
HomeScrollFourth Pillar | মোদিজি = এক প্রকাণ্ড মিথ্যেবাদী
Fourth Pillar

Fourth Pillar | মোদিজি = এক প্রকাণ্ড মিথ্যেবাদী

মোদিজিকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে, বিক্ষিপ্ত দেখাচ্ছে, ডেসপারেট হয়ে উঠছে মোদি-শাহ সরকার

কেবল মিথ্যে দিয়ে দেশ চলছে সেই ২০১৪ থেকে। মিথ্যের পর মিথ্যে, মিথ্যের পর মিথ্যে। প্রতিটা ঘোষণার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে মিথ্যে। নির্বাচনের জেতার জন্য ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা থেকে পুলওয়ামা, বালাকোট সেই মিথ্যের ইতিহাস, এক মিথ্যেকে ঢাকতে আর এক মিথ্যে। এবারের স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে দেওয়া ভাষণে মোদি বলেছেন, তিনি যুবকদের জন্য ১ লক্ষ কোটি টাকার প্রধানমন্ত্রী বিকশিত ভারত রোজগার যোজনা চালু করছেন। শুনে যে কারও মনে হবে স্বাধীনতা দিবসে দেশের বেকারত্বের দিকে নজর দিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী এক নতুন প্রকল্প শুরু করলেন। কিন্তু একটু শুনলেই বুঝতে পারবেন এই প্রকল্পের ঘোষণা অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন আগেই ২০২৫-এর জুলাই মাসের বাজেট ভাষণে করেছিলেন, শুধু নামটা নতুন করে দেওয়া হয়েছে। নতুন বোতলে পুরনো মদ বেচছেন প্রধানমন্ত্রী তাও আবার স্বাধীনতা দিবসে, লালকেল্লা থেকে ঘোষণা করে জানাচ্ছেন। এর আগে ২০২৪-এ বাজেট অধিবেশনেই সরকার প্রধানমন্ত্রী ইন্টার্নশিপ যোজনা (PMIS) চালু করেছিল, যার লক্ষ্য ছিল ২০২৯ সালের মধ্যে ১ কোটি যুবককে ইন্টার্নশিপ দেওয়া। কিন্তু আসলে কী হয়েছে? কিচ্ছু হয়নি। সরকারি তথ্যই বলছে প্রথম রাউন্ডে ১.২৭ লক্ষ ইন্টার্নশিপের সুযোগ থাকলেও মাত্র ৮,৭২৫ জন যোগ দিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে অনেকেই পরে কাজ ছেড়ে দেন। আর এই প্রকল্পের জন্য প্রথমে ২,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও পরে তা কমিয়ে ৩৮০ কোটি টাকা করা হয় এবং ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত মাত্র ২১ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। মানে বোঝা গেল? বাজেট অধিবেশনে বলা হল ১.২৭ লক্ষ ইনটার্নশিপ-এর সুযোগ আসবে, এল ৯ হাজারের কম। এটাই হল মোদিজি কি গ্যারান্টি। মোদিজির মুখে ‘স্কিল ইন্ডিয়া মিশন’, মেক ইন ইন্ডিয়া এসব ঢপবাজি প্রচুর শুনেছেন। ওটা নিয়েও একই কথা বলা যায়। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পরিবর্তনের ফিরিস্তিটা দেখুন। ২০১৪ সাল থেকে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন রাজীব প্রতাপ রুডি, তিনি গেছেন, কেন? কেউ জানে না, উনি নাকি মোদিজির গুডবুকে নেই। তারপর ধর্মেন্দ্র প্রধান, তারপর মহেন্দ্রনাথ পাণ্ডে, আবার ধর্মেন্দ্র প্রধান, এবং এখন জয়ন্ত চৌধুরী। এবং জয়ন্ত চৌধুরী এই দফতরে এসে একটা ফাইলেও সই করেছেন বলে তো মনে হয় না, কারণ সব কাজ তো পিএমও থেকেই হয়। এত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক নিয়ে এটা যেন এক ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ খেলার মতো খেলা চলছে, কিন্তু প্রকল্পের বিরাট বিজ্ঞাপন, বিরাট প্রচার, মোদিজি যেখানে পারেন সেখানে এই স্কিল ইন্ডিয়া মিশনের কথা বলছেন।

অনেকের মনে আছে ওনার সাধের সেই মেক ইন ইন্ডিয়া: শুরু হয়েছিল ওনার ক্ষমতায় আসার পরেই। ২০১৪ সালে এর লক্ষ্য ছিল ২০২২ সালের মধ্যে জিডিপি-তে উৎপাদন খাতের অবদান ২৫ শতাংশ করা। মানে ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রির থেকে জিডিপিতে যা যাবে তার পরিমাণ হবে ২৫ শতাংশ। এখন কত হয়েছে? ১৩ শতাংশের কিছু কম। ৫০ শতাংশ ট্যাক্স লাগার পরে কী হাল হবে কেউ জানে না। কিন্তু এখন আমাদের অর্থমন্ত্রী বলছেন, আগামী দুই দশকে এটা ১২ শতাংশ থেকে ২৩ শতাংশ করা হবে। ভুলেই গেছেন যে ২০১৪তে বলা হয়েছিল ২০২২-এ এটা ২৫ শতাংশ হবে, ২০২৫-এ এসে বলছেন এটা ২৩ শতাংশ হবে। তারপর ধরুন কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা: ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি এখন কেউ আর আলোচনা করে না। এখন কোন অবস্থায় আছে? ইন ফ্যাক্ট ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতির কথা ধরলে আদতে আয় কমে গেছে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি নিয়ে আর কোনও উচ্চবাচ্য নেই। কেবল পুণ্যপ্রসূন বাজপেয়ীর চাকরিটা চলে গেল। উনি এই বাওয়ালির একটা প্রোগ্রাম চ্যানেলে চালিয়েছিলেন, যাতে দেখানো হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী সামনে ভিডিও কনফারেন্সে মিথ্যে কথা বলানো হয়েছিল। পরের দিন ওনাকে বেলপাতা ধরানো হয়েছিল। মনে আছে সংসদ আদর্শ গ্রাম যোজনার কথা? ২০১৪-তে এটাও নরেন্দ্র মোদি লালকেল্লা থেকেই বলেছিলেন, ২০১৬-র মধ্যে প্রত্যেক সাংসদ একটা করে একটা আদর্শ গ্রাম গড়ে তুলবেন, ২০১৯-এর মধ্যে আরও দুটো আর ২০২৪-এর মধ্যে আরও পাঁচটা করে আদর্শ গ্রাম গড়ে তোলা হবে। মানে ৫৪২ জন সাংসদ ৮টা করে আদর্শ গ্রাম তৈরি করবেন ২০২৪-এর ভিতরে, মোট ৪৩৩৬। তো ক’টা হয়েছে? অর্ধেক? একের চার ভাগ? একের আট ভাগ? না, একটাও হয় নি, একটাও নয়। সেটাও ছিল নিখাদ ঢপবাজি, এই প্রকল্পটা এখন সবাই ভুলেই গেছে। এছাড়াও সব্বার মনে আছে স্বচ্ছ ভারত মিশন হাতে ঝাড়ু নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, আর গান্ধীজির গোল চশমাওলা লোগো, যার একদিকে লেখা ছিল স্বচ্ছ, অন্যদিকে ছিল ভারত। মানে যেদিকে স্বচ্ছ সেদিকে ভারত নেই, যেদিকে ভারত সেদিকে স্বচ্ছতা নেই। তো যাই হোক এখন ঝাড়ু-চশমা কিছুই নেই, প্রধানমন্ত্রী ফটো তুলিয়েছেন, ভুলে গেছেন। ওনার দেখাদেখি কিছু নেড়ানেড়িরাও ফটো তুলিয়েছিলেন, সে সব আর কারও মনেই নেই।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | গণতান্ত্রিক ভারতের জেলেই পচে মরবে উমর খালিদ, শরজিল ইমাম?

আর ২০১৫-তে বিশাল ঢাকঢোল পিটিয়ে স্মার্ট সিটি মিশন শুরু করেছিলেন, ১০০টা স্মার্ট সিটি তৈরি হবে, ৫০ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে এই স্মার্ট সিটি হবে বলে জানানো হয়েছিল, একটাও হয়নি। এই প্রকল্পগুলো ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচারের জন্য শুরু হয়েছিল, প্রচার শেষ, সব্বাই ভুলে গেছেন। শুরু হয়েছিল, কিন্তু এখন প্রায় সবাই ভুলে গেছে। এবারের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে মোদি ‘নেক্সট জেনারেশন রিফর্মস’ নিয়ে বড়বড় কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি কি সত্যিই ভূমি অধিগ্রহণ, কৃষি বা শ্রম সংস্কারের মতো কঠিন পদক্ষেপগুলো নেওয়ার মতো জায়গাতে আছেন? নেবেন? কারণ, এর আগেই তিনি ভূমি অধিগ্রহণের বিল এনে পিছোতে বাধ্য হয়েছেন, কৃষি বিল এনে বিরোধিতার মুখে ফেরত নিতে বাধ্য হয়েছেন আর ২০১৪ সালে তিনি শ্রম কোড নিয়ে কথা বলেছিলেন, সংসদ সেগুলো পাশও করেছে, কিন্তু সরকার এখনও সেগুলো কার্যকর করার সাহস দেখাচ্ছে না, দেখালে সরকার পড়ে যাবে সেটাও মোদিজি জানেন। ২০১৮ সালে বিজেপি-র এক মিটিংয়ে অমিত শাহ বলেছিলেন, বিজেপি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে জিতবে এবং আগামী ৫০ বছর, অর্থাৎ ২০৬৯ সাল পর্যন্ত তাদের ক্ষমতা থেকে কেউ সরাতে পারবে না। কিন্তু ক’দিন আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ লোকসভায় বললেন, বিরোধীরা আগামী ২০ বছর, অর্থাৎ ২০৪৫ সাল পর্যন্ত বিরোধী আসনে থাকবে। ধরে নিচ্ছি এটা ২০৪৯ সালও হতে পারে, কারণ ২০৪৪ সালে আবার লোকসভা নির্বাচন আছে। কিন্তু উনি নিজের থেকেই সময় কমিয়েছেন। ওদিকে মোদিজি ওনার বিকশিত ভারতের স্বপ্নকে ঠেলে ২০৪৭-এ পাঠিয়ে দিয়েছেন। এগুলো আসলে কিছু একটা বলে ক্ষমতাকে ধরে রাখার চেষ্টা। নরেন্দ্র মোদি এবারের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বলেছেন, আগামী ১০ বছরে, অর্থাৎ ২০৩৫ সালের মধ্যে তিনি দেশের সুরক্ষার ঢাল আরও বড়, শক্তিশালী ও আধুনিক করতে চান। হ্যাঁ, তিনি চান, মানে ৭৫-এ রিটায়ার করার ইচ্ছে ওনার নেই, এখন ২০৩৫ সালে তার বয়স হবে মাত্র ৮৫ বছর, যা জো বাইডেনের রাষ্ট্রপতি থাকার সময়ের বয়সের চেয়ে কম। মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদও প্রায় ৯৫ বছর বয়স পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কাজেই ৮৫ বছরের কথা তিনি বলছেন, কিন্তু কেন বলছেন? আসলে কোনও নেতা যদি অবসরের কথা ভাবছেন বলে ইঙ্গিতও দেন, তাহলে তার চারপাশের মানুষ তাঁকে ছেড়ে চলে যেতে শুরু করবে। রাজনীতিতে এরকমটা করা যায় না। আর মোদিজির মতো ক্ষমতালোভী মানুষের পক্ষে তো সেটা করা সম্ভব নয়।

কিন্তু ক্রমশ অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি বাড়ছে, ক্রমশ মিথ্যে প্রতিশ্রুতিগুলো কঙ্কালের চেহারা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। একই প্রকল্প আর কতবার কত নামে চালাবেন? কাজেই মোদিজিকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে, বিক্ষিপ্ত দেখাচ্ছে, ডেসপারেট হয়ে উঠছে মোদি-শাহ সরকার। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শরদ পওয়ার একবার বলেছিলেন, যখন মনমোহন সিং-এর সরকার ছিল, তখন পি চিদাম্বরম ‘প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট’ (PMLA)-এ এমন এক সংশোধনী এনেছিলেন, যেখানে দোষ প্রমাণ করার দায়িত্ব অভিযুক্তের উপর চলে এসেছিল। পওয়ার তখন মনমোহন সিং-কে সতর্ক করে বলেছিলেন, যদি সরকার পরিবর্তন হয়, তাহলে আমাদেরও এর ফল ভোগ করতে হবে। কিন্তু তাঁর কথায় কেউ কান দেননি। মজার ব্যাপার হল, ২০১৯ সালে চিদম্বরমকেই এই PMLA-এর একটি মামলায় ইডি গ্রেফতার করে। তাঁকে ১০৬ দিন জেলে কাটাতে হয়েছিল। এই ১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিল ভবিষ্যতে এক রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠবেই, যা কেন্দ্র সরকার, যা সবসময় বিজেপি নাও হতে পারে, বিরোধী দল-শাসিত রাজ্যগুলোর সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করতে পারে। তাহলে কেন বিজেপি এমন এক আইন বানাতে চাইবে? এর একমাত্র কারণ হতে পারে যে, বিজেপি মনে করে তারা ২০৪৯ সাল পর্যন্ত আর কখনওই বিরোধী আসনে বসবে না। না, বিজেপি এত বোকাও নয়, এমনিতেই চন্দ্রবাবু নাইডু নাকি বিজেপি নেতৃত্বের কাছে তাঁর প্রবল আপত্তির কথা জানিয়েছেন। আসলে বিজেপির হাতের তির শেষ হয়ে আসছে, মোদিজির ক্যারিশমা শেষ হয়ে আসছে, ২৪-এ নির্বাচন হয়েছে, ইন্ডিয়া টুডের ২৫-এর মুড অফ দ্য নেশন বলছে এনডিএ ভোট শেয়ার কমছে, রাহুল গান্ধীর জনপ্রিয়তা বাড়ছে, বিরোধী জোটের আসন বাড়ছে। হ্যাঁ, এক গভীর ক্ষয়রোগ বাসা বেঁধেছে বিজেপির শাসন ক্ষমতায়, বিজেপির ক্ষমতার এক অসম্ভব কেন্দ্রীভবন, সমস্ত ক্ষমতা মোদি-শাহের হাতে চলে যাওয়াই এটার কারণ হতে পারে। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে বিজেপি ক্রমশ ক্রমশ অ্যান্টি ইনকমব্যান্সির সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা হারাচ্ছে, আর ঠিক তাই বিকশিত ভারতের সেই সোনার হরিণ লক্ষ্যকে ২০২২ থেকে ২০২৭ থেকে ২০৩৫-এ নিয়ে যাওয়ার পরে এখন তা গিয়ে ঠেকেছে ২০৪৭-এ। অনেকেই বলছেন ২০২৯ পার করার পরে আবার এসব নিয়ে আলোচনা করা যাবে।

Read More

Latest News