তলপেটের তলায় কী আছে? হ্যাঁ সেটাই এখন শেখানো হচ্ছে তাও আবার কলকাতার এক নামীদামি স্কুলে। স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট, অ্যাঙ্গার কন্ট্রোল, মনঃসংযোগ নিয়ে চারদিকে কত বাওয়াল, কত জ্ঞান গম্ভীর আলোচনা, কত ওয়ার্কশপ, প্রশিক্ষণ শিবির এবং অবশ্যই ব্যবসা। তো সেই অ্যাঙ্গার কন্ট্রোল, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি নিয়ে হেয়ার স্কুল কর্তৃপক্ষও চেয়েছিলেন একটা ওয়ার্কশপ করাতে। সেই কর্মশিবির হয়েও গেল, গত সপ্তাহে ছ’দিন ধরে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের ট্রেনিং নিয়েছে পড়ুয়ারাও। ক্লাস সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত শ’পাঁচেক ছাত্রের ট্রেনিং হয়েছে হেয়ারে, তাদের শেখানো হয়েছে রাগকে কীভাবে বশে আনতে হয়, কীভাবে সামলাতে হয় মানসিক চাপ। সেই কর্মশিবিরে রবিবার ছিল শেষ দিন। এবং ওস্তাদের মার শেষ রাতে, সেদিন প্রশিক্ষণ ছিল বাবা-মায়েদের। এই কর্মশালাতে শেখানো হল কীভাবে কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করে মনকে বশে আনা যায়, কী কাণ্ড! এই পরমাত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, ব্রহ্মতালুতে গরম-ঠান্ডা অনুভূতি, এগুলো কেমন পথ? আপাতত ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তপনকুমার মাইতি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “কোভিডের পর থেকেই দেখছি, ছেলেদের মধ্যে একটা অস্থিরতা। সারাক্ষণ তারা মানসিক চাপে ভোগে। কোনও সহমর্মিতা, সৌজন্য নেই। কেমন হিংস্র হয়ে উঠছে। তাই শিক্ষা দফতরের অনুমতি নিয়েই আমরা স্ট্রেস রিলিফের প্রশিক্ষণ দিয়েছি পড়ুয়াদের।” মানে শিক্ষা দফতর অনুমতি দিল কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত করার? সেই জাগ্রত বোধকে ছাত্র কেবল নয় তাদের অভিভাবকদের মাথাতেও পুরে দিতে সুদূর মুম্বই থেকে ডেকে আনা হল মাতাজি নির্মলাকে, তাঁর আশ্রমের লোকজন এসে শেখালেন তলপেটের তলায় আছে সেই সাড়ে তিন প্যাঁচের কুলকুণ্ডলিনী, তাকে জাগাতে হবে, কেবল জাগালেই চলবে না তাকে জাগিয়ে মাথায় তলে পদ্মের চাষ করতে হবে। সেটাই বিষয় আজকে। স্কুলে শেখানো হচ্ছে তলপেটের তলায় কী আছে?
মুম্বই থেকে আসা নির্মলা মাতাজির শিষ্যরা স্কুলের ছাত্রদের শেখাচ্ছিলেন মানুষের শরীর নাকি আসলে দু’রকম। একটা এই নশ্বর দেহ, অন্যটা সূক্ষ্ণ দেহ। যখন শেখাচ্ছিলেন তখন হেয়ার স্কুলের বায়োলজির মাস্টারমশাইরা হাজির ছিলেন কী? তাঁরা কি জানতে চেয়েছিলেন সেই সূক্ষ্ণ দেহের বিজ্ঞান? সে কথা থাক, তাঁরা জানালেন ধ্যানের মাধ্যমে সেই সূক্ষ্ণ শরীরকে ওয়েক আপ কল দেওয়া, মানে ‘জাগিয়ে তোলা’ সম্ভব। মেরুদণ্ডের একেবারে নীচে মানে তলপেটের তলায় থাকে একটি কুণ্ডলী। ছাত্ররা ফিল করেছেন সেই কুণ্ডলী? তাঁদের ফিল করতে বলা হয়েছিল। ঘোড়ার আড়াই চাল আর এই কুণ্ডলীর সাড়ে তিন প্যাঁচ, সেই কুণ্ডলী নাকি প্রতিটি মানুষের শরীরে ‘ঘুমিয়ে থাকে’। মানে তাঁদের কথায় বেশিরভাগ মানুষেরই নাকি এই সাড়ে তিন প্যাঁচের কুলকুণ্ডলিনী ঘুমিয়েই থাকে। যোগ, ধ্যানের মাধ্যমে তাকে জাগিয়ে তুলতে হয়। কুণ্ডলীর শক্তি বিশাল। ২১কে ২১ দিয়ে ১০৮ বার গুণ করলে যা হয়, ঘুমন্ত কুণ্ডলীর তেমনই শক্তি!
আরও পড়ুন: Aajke | মোদিজির আমলে গত ১০ বছরে ওষুধের দাম বেড়েছে ১৪০%
কেন ২১? কেন ১০৮? তা কিন্তু বোঝানো হয়নি বলেই জানা গেছে। তো হিসেব করে দেখলাম ওই গুণফল হল ৪৭৬২৮। কিন্তু সেটা কিলো গ্রাম না কিলোমিটার না কিলোলিটার না কিলোওয়াট তা জানানো হয়নি। কিন্তু তাকে জাগিয়ে তুললে তা শিরদাঁড়া বেয়ে ধাপে ধাপে উপরের দিকে উঠতে থাকবে। তারপর ওই সাড়ে তিন প্যাঁচের কুণ্ডলী ব্রহ্মতালু ভেদ করে ‘আত্মপ্রকাশ করবে’ আজি এ প্রভাতে রবির কর গোছের একটা ব্যাপার। তখন মাথার উপরে একটা পদ্মের মতো শক্তি তৈরি হয়। খেয়াল করুন গাঁদা বা জবা বা গোলাপ নয়, পদ্মফুল গজাবে মাথায় এবং সেই শক্তি পরমাত্মার সঙ্গে মানুষের সংযোগ স্থাপন করে! আর একবার এই সংযোগ স্থাপিত হলেই স্ট্রেস, দুশ্চিন্তা, ইগো, সহ সবকিছুর সমাধান সম্ভব। খানিকটা ট্রান্সফর্মার থেকে আসা লাইনের সঙ্গে ঘরের মেন সুইচের সংযোগ, কানেকশন হলেই ঘুরবে পাখা, জ্বলবে আলো। তো আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা কি কেউ জানেন তলপেটের তলায় থাকা এই সাড়ে তিন প্যাঁচের কুলকুণ্ডলিনী ব্যাপারটা ঠিক কী? শুনুন তাঁরা কী বলেছেন।
আসুন এবারে একটু অন্যদিক থেকে দেখা যাক। এই হেয়ার স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে আছেন জগদীশচন্দ্র বসু, রামতনু লাহিড়ী, রাধানাথ শিকদার, মেঘনাথ সাহা, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো মানুষজন। সেই স্কুলে মাথায় পদ্ম গজানোর চাষ হচ্ছে, জানতে পারলে এনারা আঁতকে উঠতেন। ভাবুন একবার তলপেট থেকে সাড়ে তিন প্যাঁচের এক জিলিপিকে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে, ছাত্রদের তা শেখানো হল, ছাত্রদের অভিভাবকেরাও শিখলেন। কর্মশালা শেষ, এক মনোযোগী ছাত্র যদি সেই সাড়ে তিন প্যাঁচের জিলিপিকে মাথায় না তুলতে পারেন? এ তো সত্যি করে সম্ভব নয়, তাহলে কী হবে? তার মধ্যে আরও হতাশা জন্মাবে আর এক লপ্তেই যদি সেই সাড়ে তিন প্যাঁচের জিলিপি মাথায় উঠে যায় তাহলে তা এক হ্যালুসিনেশন, সেও আর এক মানসিক রোগ, এবার তার মাথায় পদ্ম গজাতে কতক্ষণ? আধ্যাত্মিক চর্চায় এসব চলুক, প্রাপ্তবয়স্করা এ নিয়ে তর্কবিতর্ক করুন, কিন্তু স্কুলের ছাত্রদের এমন সাড়ে তিন প্যাচের জিলিপিতে আটকানোর অর্থ কী? আর হেয়ার স্কুলের প্রধান শিক্ষক সেটা করলেনই বা কী করে? দেহ কয় প্রকার? এই পাঠ দিতে পারবেন তো? তলপেটের তলায় এক সাড়ে তিন প্যাঁচের জিলিপি আছে তা বিজ্ঞান পাঠে থাকবে তো? এই মাতাজির মূল অফিস মুম্বইয়ে। দেশ বিদেশে তাঁদের এই আধ্যাত্মিক কার্যকলাপ চলছে, তাঁদের ভক্তরা ছড়িয়ে আছেন গোটা পৃথিবীতে। প্রয়াত মাতাজির উপরে একটি তথ্যচিত্রে তিনি নিজেই দাবি করেছেন, এমন সব পদ্ধতি তিনি ধ্যান-যোগের মাধ্যমে জেনেছেন। ধ্যানে তিনি স্বর্ণাসনে বসা দেবতাদেরও দেখেছেন! আর তাই মানুষের কাছে এ সব ছড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু জ্ঞান বিজ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল সেই বিজ্ঞান কী বলছে? সাফ কথা, ‘এমন কোনও কুণ্ডলী, নাড়ি, কুণ্ডলীর জাগ্রত হওয়া এবং পরিশেষে তার সঙ্গে পরমাত্মার যোগের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমার কোনও চ্যাপ্টার বিজ্ঞানের বইয়ে নেই। মানুষের শরীরে এমন কিছু থাকেও না।’ তাহলে আদতে কী শেখানো হল এই ছাত্রদের? তাদের অভিভাবকদের? এসবের খবর আছে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর কাছে? নাকি তিনিও ওই কুলকুণ্ডলিনী মানে তলপেটের তলায় সাড়ে তিন প্যাঁচের জিলিপিকে জাগ্রত করার চেষ্টায় ব্যস্ত?