Friday, September 12, 2025
বাঙালি কাউন্টডাউন
HomeScrollFourth Pillar | ট্রাম্প পালটি খেলেন–মোদিজি ডিগবাজি, কেন? কোন শর্তে?
Fourth Pillar

Fourth Pillar | ট্রাম্প পালটি খেলেন–মোদিজি ডিগবাজি, কেন? কোন শর্তে?

ট্রাম্পের আচরণে এই হঠাৎ পরিবর্তনকে শুধুমাত্র এক বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা ভুল হবে

দুই ধুরন্ধর রাষ্ট্রনেতার মধ্যে কথার খেলা চলছে, কূটনীতির ধাঁধা চলছে, না একে দুই পাগলের প্রলাপ বলব? ক’দিন আগেই যিনি বললেন রাশিয়া আর ভারতের অর্থনীতি ডুবে মরুক, তিনিই বলছেন ভারত এক মহান দেশ, মোদি এক মহান নেতা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমরা শুনলাম ‘দোস্তি বনি রহে’, ‘ভারত আমেরিকার বন্ধুত্ব অমর’ ইত্যাদি। বলাই যায় যে, আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল। যে ডোনাল্ড ট্রাম্প মাত্র ক’দিন আগেই ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, ৫০ শতাংশ ট্যারিফ চাপিয়েছিলেন, এমনকি একরকম কটাক্ষ করে ভারতের অর্থনীতিকে ‘মৃত’ বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন, হঠাৎ তিনিই সুর বদলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূয়সী প্রশংসা করলেন। তিনি মোদিকে ‘একজন মহান নেতা’ এবং ভারতকে ‘একটি মহান দেশ’ বলে সামাজিক মাধ্যমে এক তক্তা লিখেও দিলেন। ট্রাম্পের এই মন্তব্যের পরপরই মোদিও তাঁর এই ‘ইতিবাচক মূল্যায়নকে’ সম্মান জানাচ্ছেন এবং দুই দেশের সম্পর্ককে ‘ভবিষ্যৎমুখী কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ বা ‘ফিউচারিস্টিক স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ’ হিসেবে বর্ণনা করেন। একটু ভারি হয়ে গেল ব্যাপারটা, আফটার অল মোদিজি তো, একটু ভারি তো হবেই। মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগবে, এই নাটকীয় পরিবর্তনের পিছনে কী এমন ঘটল? যে নেতা প্রায়শই ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের কৃতিত্ব নিজের বলে দাবি করে মোদিকে বিব্রত করেছেন, যিনি প্রায় ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে ভারতের অর্থনীতিকে চাপে ফেলেছেন, তিনি কেন হঠাৎ এমন প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন? আসুন, আমরা এই আপাত জটিল ধাঁধার পিছনের ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণগুলো একে একে পেঁয়াজের খোসার মত খুলে বোঝার চেষ্টা করি।

প্রথমে যেটা বুঝতে হবে সেটা হল, ট্রাম্পের পুরানো বাওয়ালগুলো কী কী আর তার কারণগুলোই বা কী? ডোনাল্ড ট্রাম্পের মোদ্দা রাজনৈতিক দর্শন তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি, যার মূল উদ্দেশ্য হল, আমেরিকার অর্থনৈতিক স্বার্থকে সবার আগে রাখা। ওনার সব পাগলামির মধ্যে নোবেল পুরস্কারের হ্যাংলামিরও উপরে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ হল প্রথম ব্যাপার। তিনি বিশ্বাস করেন, অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে ভারত ও চীনের মতো উদীয়মান অর্থনীতি, তাদের পণ্যে উচ্চ শুল্ক বসিয়ে আমেরিকার বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, নিজেরা লাভ কামাচ্ছে। এই বিশ্বাস মাথায় রেখেই, সেই হিসেব কষেই ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের উপর প্রথমে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা জানিয়েছিল। এর কারণ ওনাদের হিসেবে ভারত তার পণ্যের উপর কোনও কোনও ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশেরও বেশি ট্যারিফ চাপিয়েছে। এরপর এই ২৫ শতাংশের বাইরেও আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক যোগ করা হয়। এই ‘এক্সট্রা টু এ বি’র মত ‘এক্সট্রা ট্যারিফ’ ছিল রাশিয়া থেকে ভারতের তেল আমদানির ‘শাস্তি’। হোয়াইট হাউসের যুক্তি ছিল, যেহেতু চীন রাশিয়া থেকে তেল পরিশোধনের পর ইউরোপে বিক্রি করে, তাই তাদের উপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করলে ইউরোপের বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাবে। যে কারণে চীনকে শুল্ক তালিকা থেকে বাদ রাখা হয়। বোঝো কান্ড, ভারত কি তেল খায়? এই ধরনের একতরফা পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতিতে বিরল, যা ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতিকে কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং কৌশলগতভাবেও এক ‘ইরাটিক’, পাগলের মত কাজকর্ম বললে ভুল হবে না। কিন্তু শুধুমাত্র শুল্কই নয়, এই সময়ের মধ্যে ‘মাই ডিয়ার দোলান্দ ট্রাম্পের’ মন্তব্যও ছিল চরম আগ্রাসী এবং অবজ্ঞাপূর্ণ। তিনি একসময় ভারত ও রাশিয়াকে ‘মৃত অর্থনীতি’ আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন যে, তারা নিজেদের মধ্যে ‘একসঙ্গে ডুবে যেতে’ পারে, তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না। তিনি আরও মন্তব্য করেন যে, আমেরিকার সঙ্গে ভারতের যৎসামান্যই ব্যবসা হয় এবং এটাই বজায় থাকা উচিত। এই ধরনের মন্তব্য থেকে মনে হচ্ছিল দুই দেশের সম্পর্ক চুকে-বুকে গিয়েছে, তার বদলে এখন থেকে সম্পর্কে এক চরম শীতলতা বজায় থাকবে। এছাড়াও, ট্রাম্প বারবার ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যের যুদ্ধ থামানোর কৃতিত্ব নিজের বলে দাবি করেছেন। এমনকি ৩৫ মিনিটের ফোনালাপের পরেও তিনি এই দাবি থেকে এক চুলও সরেননি। তাঁর এই দাবি ভারতের কূটনৈতিক অবস্থানের জন্য একরকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করে, যেখানে ভারত বারবার স্পষ্ট করেছে যে, তারা কোনও মধ্যস্থতা মেনে নেবে না। এবং এতকিছু হবার পরে হঠাৎ ভোলবদল। এমন তীব্র সমালোচনা এবং আগ্রাসী মনোভাবের ঠিক পরেই ট্রাম্পের ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতমুখী মন্তব্য এসে হাজির। তিনি মোদিকে ‘মহান নেতা’ এবং ভারতকে ‘মহান দেশ’ বলেছেন। তিনি বলেছেন, ভারত-আমেরিকার মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে এবং চিন্তার কোনো কারণ নেই। যেন ওনার চিন্তার জন্য ভারত বসে রয়েছে। মোদিজিও এক্কেবারে যেন লোপ্পা ক্যাচের জন্য অপেক্ষাই করছিলেন। সঙ্গে-সঙ্গেই এই ইতিবাচক মূল্যায়নকে তাঁর এক্স হ্যান্ডলে গভীরভাবে সম্মান জানান।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | নেপালের পরে কি এবারে ভারতের পালা?

প্রশ্ন হল, এই নাটকীয় পরিবর্তনের পিছনে কী এমন ঘটল? এটা কি চীন-রাশিয়া-ভারত ঐক্য গড়ে ওঠার ভয়, নাকি আমেরিকার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির সমস্যা? বস্তুত, এই দুটো কারণই একসঙ্গে ট্রাম্পকে তাঁর পুরানো অবস্থান থেকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে। তাই এবার প্রশ্ন পিছু হটার নেপথ্যে কোন খেলা? ভূ-রাজনীতি না ঘরের সমস্যা? ট্রাম্পের আচরণের এই হঠাৎ পরিবর্তনকে শুধুমাত্র এক বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা ভুল হবে। বরং, এটা তাঁর নিজস্ব নীতির অপ্রত্যাশিত এবং নেগেটিভ রিঅ্যাকশনের এক অত্যন্ত প্রাগম্যাটিক প্রতিক্রিয়া। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির আগ্রাসী চেহারাটা আদতে আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। দেশের মধ্যেই কথা উঠছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বল্টন সরাসরি এই পরিস্থিতির জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করেছেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, ভারতের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্প প্রশাসন মার্কিন-ভারত সম্পর্ককে কয়েক দশক পিছিয়ে দিয়েছেন আর এর ফলস্বরূপ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে রাশিয়া ও চীনের কাছাকাছি ঠেলে দিয়েছেন। এই পরিস্থিতিকে আরও স্পষ্ট করে দেখা যায়, যখন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন যে, রাশিয়া, ভারত এবং চীন পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে তাদের সহযোগিতা আরও শক্তিশালী করছে। তিনি সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (SCO) শীর্ষ সম্মেলনে এই তিন দেশের মধ্যের ঘনিষ্ঠতাকে এক বৃহত্তর ঐক্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলেন। এটা সম্ভব কী না, ভারত চীনের এক দীর্ঘস্থায়ী বাণিজ্যিক রাজনৈতিক সম্পর্ক সম্ভব কী না সে তো পরের কথা, কিন্তু একই মঞ্চে, এই এক জায়গাতে এসে দাঁড়ানোটাই বড় ব্যাপার। এই ধরনের জোট আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দেবে, দিয়েছে। আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে ভারতকে তার স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের মিত্র রাশিয়া থেকে দূরে সরিয়ে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে মোকাবিলা করার জন্যই পাশে পাওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্কনীতি সেই দশকের পর দশক ধরে চলা কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে নষ্ট করে দিয়েছে। এই নীতির কারণে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনীতিকে নতুন করে সাজানোর এক সুযোগ পেয়েছেন। হঠাৎ একলা হয়ে পড়ার জায়গা থেকে চীন আবার নিজেদের সামলে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এই ক্ষতির দিকটা হয়তো ট্রাম্প নিজেও বুঝতে পেরেছেন, কেননা তিনি নিজেই সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে মন্তব্য করেছেন যে, আমেরিকা ভারত ও রাশিয়াকে চীনের কাছে হারিয়েছে। আদতে ট্রাম্পের মূল লক্ষ্য তো ছিল বাণিজ্য ঘাটতি কমানো। এর জন্য তিনি ভারতের ওপর উচ্চ শুল্ক চাপালেন এবং রাশিয়া থেকে তেল কেনার জন্য ভারতকে ‘শাস্তি’ দিলেন। এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল, কিন্তু এই পদক্ষেপের ফলে ভারত অর্থনৈতিকভাবে বিকল্প বাজার খুঁজতে বাধ্য হল এবং রাজনৈতিকভাবে রাশিয়া ও চীনের দিকে ঝুঁকল। এটা মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চোখে এক বড় ভুল। তাই দেশের মধ্যেই নানান লবি থেকে কথা শুরু হয়েছে। এর ফলে আমেরিকার ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল’ এবং চীনের মোকাবিলায় ভারতকে পাশে পাওয়ার দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে দিল। আর ঠিক তাই এই সুর বদল। এক কৌশলগত মেরামতের চেষ্টা, যেখানে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ দেশকে আবার নিজেদের দিকে টানতে চাইছেন। এটা প্রমাণ করে যে, ভূ-রাজনৈতিক চাপ এক বড় কারণ, যা আমেরিকাকে তার পুরনো অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছে।

কিন্তু এবারে প্রশ্ন, মোদি কেন ইউ-টার্ন নিলেন? কূটনীতির নিপুণ চাল? আবার সেই মাস্টার-স্ট্রোক? ট্রাম্পের বারবার বিব্রত করার পরেও মোদি কেন সঙ্গে সঙ্গেই ইউ-টার্ন নিলেন? আসলে মোদির কাছে অন্য বিরাট কোনও বিকল্প খোলা আছে কি? চীন, রাশিয়ার সঙ্গে এক জোট তৈরি করে রাজনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে থাকার অন্তত একটা সম্ভাবনা আছে, কিন্তু অর্থনীতি? দেশের মধ্যের বিভিন্ন ব্যবসায়ী মহলে, শিল্প মহলে হাহাকার উঠেছে। আবার এটাও ঠিক যে, মোদিজি আরও ঘাড় নিচু করলে দেশের মধ্যে রাজনীতিকে সামাল দিতে পারবেন না। তাই প্রথম সুযোগটা আসা মাত্র তিনি লুফে নিয়েছেন। প্রতিশোধ বা রাগ দেখিয়ে সম্পর্ককে আরও খারাপ করা ভারতের জন্য মোটেই লাভজনক হত না, বিশেষ করে যখন শুল্কের কারণে বাণিজ্য সম্পর্ক এমনিতেই খারাপ। সব মিলিয়ে বলাই যায়, ট্রাম্পের ভোলবদলের পিছনে কোনও একটা একক কারণ নেই, বরং ভূ-রাজনৈতিক কারণ, BRICS জোটের ভয়, কোয়াডের কার্যকারিতা আর অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক মন্দা ও ভোটারদের চাপ – সবকটা কারণই সমানভাবে কাজ করছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, ট্রাম্প পুরো দান ছেড়ে দিয়েছেন। এসব কথা বলার পরেই গতকাল মাঝরাতে তিনি বলেছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন যেন ১০০ শতাংশ ট্যারিফ চাপায় চীন আর ভারতের উপর। এখন দেখার সত্যিই ট্রাম্প সাহেব কী চান, আর তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধু নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি কীভাবে এই পাগলামিকে সামাল দেন। কেন? কারণ শাস্ত্রে বলা আছে, ‘সাঁকোর উপর পাগলকে দেখলে সাঁকো নাড়াতে নেই’। উনি সাঁকো নাড়িয়েছেন, দেশকে ভুগতে হচ্ছে, এখন দাঁত চেপে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় আছে বলে তো মনে হয় না।

Read More

Latest News