Tuesday, November 11, 2025
HomeScrollFourth Pillar | প্রচার শেষ, আগামীকাল ভোট, এখনও এক্স ফ্যাক্টর সেই প্রশান্ত...
Fourth Pillar

Fourth Pillar | প্রচার শেষ, আগামীকাল ভোট, এখনও এক্স ফ্যাক্টর সেই প্রশান্ত কিশোর, পিকে

উন্নয়নের এক গোলকধাঁধা আছে, তাতেই আটকে পড়েছেন পিকে!

Written By
অনিকেত চট্টোপাধ্যায়

প্রথম দফায় বাম্পার ভোট পড়া দেখে পন্ডিতেরা নিদান হেঁকেছেন, ‘তখত পলট গয়া’, বিজেপি এনডিএ নীতীশ কুমার হারছে, জিতছে মহাগঠবন্ধন। পন্ডিতরা হিসেবই করেননি যে, গতবারের তুলনায় এবারের ভোতার লিস্টে ৪৬ লক্ষ ভোটার কমে গিয়েছে, আর সেটাকে হিসেবে ধরলে খুব বেশি হলে ৩ শতাংশের মতো মানুষ বেশি ভোট দিয়েছেন যা এসআইআর নিয়ে এই বাজারে বিরাট শোরগোলের মধ্যে এমন কিছু বেশি নয়। এবং আরও একটা কথা মাথায় রাখলে ভালো হয় যে, ভোট বেশি পড়লেই পরিবর্তন হয় না, ২০২১-এ এই বাংলাতেও বেশি ভোট পড়েছিল। এক বিরাট জটিল ভোট সমীকরণের মাঝখানে এবারের ভোটে পিকে এক নতুন এন্ট্রি। এক নতুন ন্যারেটিভ নিয়ে তিনি মাঠে নেমেছেন, গত তিন বছর ধরে একটু একটু করে নিজের ঘুঁটি সাজিয়েছেন, সংগঠনের কাজ করেছেন আর প্রচারের দিক তিনি নিজেই বোঝেন। কাজেই ভোট শুরু হতে না হতেই মনে হয়েছিল, এক সুনামি আসছে। তারপর সেই সুনামি ঢেউ, তারপর সামান্য স্রোত, এখন পুকুরের নিস্তরঙ্গ জলের মতই শান্ত। আসলে উন্নয়নের এক গোলকধাঁধা আছে, সেটাতেই আটকে পড়েছেন প্রশান্ত কিশোর, পিকে। ধরুন একটা সমাজ, যেখানে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র কাঠামো বা সরকারের সমস্য ব্যবস্থার সুবিধা পাচ্ছেন সেই রাষ্ট্রের ১৫ শতাংশ মানুষ। এবার সেই রাষ্ট্রে আরও উন্নয়ন হবে, আরও বিকাশ হবে। তার মানে কী? ঐ ৮৫ শতাংশ মানুষজন কিছু বেশি তো পাবেন, কিন্তু ঐ ১৫ জন? ১৫ শতাংশ মানুষ আরও বেশি সুবিধা পাবেন। সুবিধা পাওয়ার যে হার, সেই হারে তো কোনও পরিবর্তন হবে না। কাজেই অর্থনীতিগতভাবে, সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা লোকজন যতক্ষণ না রাজনৈতিক ক্ষমতাটা হাতে পাচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা কোনওভাবেই কেবল এক বিকাশ বা উন্নয়নের শরিক হতে পারবেন না, পারাটা সম্ভব নয়। পিকে ঐ জাতিগত ভাবে ঐতিহাসিকভাবেই পিছিয়ে থাকার বিরুদ্ধে না লড়ে কেবল বিকাশ আর উন্নয়নের কথাটা বলছেন, যেটা শুনতে খুব ভালো লাগছে, কিন্তু সেটা কাজের কথা নয়। কাজেই ভোট যত সামনে আসছে, তত বেশি করে ঐ দলিত, পিছিয়ে পড়া মানুষ বা অতি পিছড়ে বর্গের মানুষজনের রাজনৈতিক লড়াইটাই প্রাধান্য পাচ্ছে, পিকে তাঁর দুর্দান্ত এজেন্ডাগুলোকে নিয়ে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছেন। তাঁর তোলা এজেন্ডাগুলো কি চর্চাতে নেই? আছে বৈকি, এত বড় করে পলায়ন, মাইগ্রেশন বিহারের রাজনীতিতে কখনও আসেনি, প্রতিবার ভোটের আগে ট্রেন ভারা দিয়ে, বাস রিজার্ভ করে ঐ মাইগ্রেটরি লেবারদের আনা হত বিহারে। তাঁরা গত তিনটে বিধানসভার ভোটে সরাসরি নীতীশ কুমারকে সমর্থন দিয়েছেন, কিন্তু এবারে দেবেন? তাঁরা কি তেজস্বী যাদবে ঐ ‘সরকারি নৌকরি দেবো’ এই প্রতিশ্রুতিতে শরীর দোলাবেন? জানা নেই, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যাচ্ছে যে, তাঁরা প্রশান্ত কিশোরের কথাগুলো খুব সিরিয়াসলিই নিয়েছেন। হ্যাঁ, কেরালাতে বসে, তামিলনাড়ু বা পাঞ্জাবে বসে ইউটিউব রিলে পিকের কথাগুলো গিলেছেন। সে ভোট কি পিকের বাক্সে জমা হবে? নাকি বিহারে আসতে আসতে সেই ভোট আবার দুসাধ, চামার, নাই, তাঁতি, মাল্লাহতে ভাগ হয়ে যাবে? জানা নেই।

রাজনৈতিক কৌশলী থেকে রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রশান্ত কিশোরের (পিকে) উত্থান বিহারের রাজনীতিতে এক নতুন সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। বিশেষ করে, যখন তিনি ‘জন সুরাজ অভিযান’ শুরু করেন এবং পরবর্তীতে এটাকে একটা রাজনৈতিক দল—জন সুরাজ পার্টি  হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন ২ অক্টোবর ২০২৪-এ, তখন মনে হয়েছিল যে বিহারের ৩০ বছরের পুরানো রাজনৈতিক দ্বৈরথ এবার হয়তো ভাঙতে চলেছে। পিকে-র মোদ্দা মেসেজটা ছিল একদম সোজা আর শক্তিশালী: প্রচলিত জাতপাতের রাজনীতির, দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে ‘সঠিক লোক’, ‘সঠিক চিন্তা’ এবং ‘সামূহিক প্রয়াস’-এর মাধ্যমে বিহারে এক আমূল পরিবর্তন বদলাও আনা। কাজেই শুরুর দিকে পিকে-র প্রচারে এক ধরণের আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। তাঁর বক্তব্য ছিল, বিহারের মানুষ এবার হয়তো জাতপাত, ধর্মীয় মেরুকরণ, এবং অতীতের ‘জঙ্গলরাজ’ বনাম ‘সুশাসন’-এর বিতর্কের বাইরে এসে নিছক উন্নয়ন ও বিকাশের মাপকাঠিতে ভোট দেবে। তিনি জোর দিয়েছিলেন যে, নীতীশ কুমার এবং লালু প্রসাদ যাদবের দীর্ঘ শাসনের ফলেই বিহারের যুব সমাজকে অন্য রাজ্যে গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। পিকে পরিযায়ী শ্রমিকদের এবং যুব সম্প্রদায়কে এই নির্বাচনের ‘এক্স ফ্যাক্টর’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, যারা পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। তাঁর এই আহ্বান, বিশেষত ডিজিটাল দুনিয়ায়, বিপুল সাড়া ফেলেছিল। তিনি এক নতুন বিকল্প তৈরির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, যা বিহারকে পুরনো রাজনৈতিক জোটের প্রভাবমুক্ত করবে। কিন্তু নির্বাচন যত এগিয়ে এল, তত দ্রুত এই আশাবাদ, যাবতীয় পজিটিভ কথাবার্তা ম্লান হতে শুরু করল। প্রথম পর্যায়ের ভোটের পরেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বিহার তার চিরাচরিত ভোট বিভাজনে—উচ্চবর্ণ, ব্রাহ্মণ, রাজপুত, ভূমিহার, ওবিসি, ইবিসি, এবং দলিতদের ভিত্তিতে ফিরে এসেছে। দুই প্রধান জোট, অর্থাৎ এনডিএ এবং মহাগঠবন্ধন, অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এই চিরাচরিত জাতপাতের সমীকরণগুলিকে আবার প্রচুর অক্সিজেন দিয়ে সক্রিয় করে তুলেছে, যার ফলে পিকে-র জন সুরাজ অনেকটা সাইডলাইনের বাইরে চলে গিয়েছেন, যাচ্ছেন। তাহলে প্রশ্ন তো উঠবেই যে, জাতপাতের এই নিরন্তর ফিরে ফিরে আসার কারণ কী? সমীক্ষা বলছে, বিহারের মাত্র ২৩ শতাংশ ভোটার উন্নয়ন বা ইস্যু-ভিত্তিক বিষয়কে তাঁদের সিদ্ধান্তের প্রাথমিক মাপকাঠি ধরেন। বাকিরা জাতপাত, ধর্ম এবং অন্যান্য নানা আলাদা কারণে প্রভাবিত হন। পিকে-র এই নির্বাচনে হঠাৎ পিছিয়ে পড়া আসলে এই মৌলিক কাঠামোগত বাস্তবতাকে তুলে ধরছে। তিনি রাজনৈতিক অদক্ষতা ও দুর্নীতির দীর্ঘ ইতিহাসের সমাধানের জন্য সাধারণ দাওয়াই হিসেবে উন্নয়ন বিকাশকে তুলে ধরছিলেন, যা আসলে একট গভীর, কাঠামোগতভাবে অর্থনৈতিক সমস্যা, সম্পদ ও ক্ষমতার চরম অসম বন্টন থেকেই তৈরি। যতদিন না পিকে বা অন্য কেউ সরাসরি এই অর্থনৈতিক অসমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারছেন, ততদিন জাতপাতের রাজনীতিকে অস্বীকার করা সম্ভব হবে না। বিহারের জাতিগত সমীকরণ কেবল সামাজিক পরিচয়ের লড়াই নয়, বরং তা অর্থনৈতিক ক্ষমতার হদিশও দেয়। এটাই কিছুদিন আগে বিহার জাতিভিত্তিক জনগণনা ২০২৩-এর অর্থনৈতিক তথ্য থেকে পরিস্কার বেরিয়ে এসেছে। এই জনগণনাটাই আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এটা এখন পরিস্কার যে, মার্কসের শ্রেণি দন্দ্ব, হ্যাভ আর হ্যাভনটস-এর দন্দ্ব এখানে, আমাদের দেশে, বিহারে ঐ জাতিগুলোর মধ্যেকার সম্পর্ক। ঐ জাতিগত জনগণনা থেকে পাওয়া তথ্যগুলো জাতি আর অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যের কঠোর সম্পর্ককে পরিস্কার করে তুলে ধরেছে।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বিজেপির মুখে বন্দেমাতরম? ওয়াক থু

বিহারের জনসংখ্যার মাত্র ১৫.৫২ শতাংশ সাধারণ বা উচ্চবর্ণের (General Communities)। অন্যদিকে, বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ—মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৩ শতাংশ—অনগ্রসর (ওবিসি), অতি অনগ্রসর (ইবিসি) এবং তফসিলি জাতি (এসসি) দ্বারা গঠিত। এর মধ্যে ওবিসি এবং ইবিসি একত্রে ৬৩.১৪ শতাংশ এবং তফসিলি জাতি (এসসি) ১৯.৬৫ শতাংশ। বিহারের রাজনীতিতে এই বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে, তাঁদের সমস্যাগুলোকে, তাঁদের উপর চাপানো এক সামাজিক ব্যবস্থাকে না সরিয়ে কেবল ‘উন্নয়ন’-এর বিমূর্ত কথা বলে সাফল্য অর্জন করা কার্যত অসম্ভব। ২০২৩ সালের জনগণনার অর্থনৈতিক তথ্য স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, বিহারে সম্পদ ও ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারা জাতিগত লাইনে কতটা গভীরভাবে অসম। উচ্চ আয়ের ক্ষেত্রে উচ্চবর্ণের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ, যে পরিবারগুলোর মাসিক আয় ৫০,০০০ টাকা বা তার বেশি, সেই উচ্চ আয়ের গোষ্ঠীগুলোতে ১৫.৫২ শতাংশ জনসংখ্যার সাধারণ ক্যাটেগরির পরিবারগুলির অংশ প্রায় ১০ শতাংশ (৯.৮৬ শতাংশ)।  মানে সিংহভাগ উচ্চবর্ণের মানুষ ঐ হাই-ইনকাম গ্রুপের মধ্যেই আছে। অন্যদিকে, রাজ্যের বৃহত্তর অনগ্রসর শ্রেণিগুলোর মধ্যে উচ্চ আয়ের পরিবারের হার তুলনামূলকভাবে হতাশাজনক। যে ওবিসি গোষ্ঠী রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশের বেশি জনসংখ্যা ধারণ করে, সেখানে মাত্র ৪.২২ শতাংশ পরিবার মাসিক ৫০,০০০ টাকার বেশি আয় করে। ইবিসি গোষ্ঠীর (যা রাজ্যের সবচেয়ে বড় অংশ) ক্ষেত্রে এই হার আরও কম, মাত্র ২.২৮ শতাংশ। তফসিলি জাতি (এসসি)-র পরিবারগুলিতে উচ্চ আয়ের হার মাত্র ১.৭২ শতাংশ। এই তথ্যগুলো স্পষ্ট করে যে, সম্পদ এবং অর্থনৈতিক সুযোগের চূড়ায় উচ্চবর্ণের একটা ছোট অংশ আজও নিজেদের অবস্থান দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছে। এই বৈষম্যের অন্য দিকটা হল দারিদ্র্য। বিহারের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে এমন পরিবারের সংখ্যা তফসিলি জাতিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, যা প্রায় ৪৩ শতাংশ। ইবিসি পরিবারগুলির মধ্যেও ৩৩.৫৮ শতাংশ চরম দারিদ্র্যের শিকার। ওবিসিদের ক্ষেত্রেও এই হার ৩৩ শতাংশের বেশি। এমনকি জেনারেল ক্যাটেগরি, যারা নাকি মাত্র ১৫ শতাংশ, তাঁদের মাত্র ২৫.০৯ শতাংশ পরিবার দরিদ্র। উচ্চ আয়ের ক্ষেত্রে তাঁদের যে নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ, তা কাঠামোগত সুবিধাকেই তুলে ধরে।

যখন প্রশান্ত কিশোর ‘উন্নয়ন’ মানে নতুন শিল্প স্থাপন, পরিকাঠামো নির্মাণ নিয়ে কথা বলেন, তখন তিনি সেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মূল অর্থনৈতিক সংগ্রামকে এড়িয়ে যান, যারা চরম বঞ্চনা এবং দারিদ্র্যের শিকার, ৪০ শতাংশের বেশি পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে। মানে ওনার সেই কল্পিত উন্নয়ন যদি বা হয়ও, তাহলেও এই হাঘরে মানুষের জীবনে কোনও পরিবর্তন আসতেই পারে না, যতক্ষণ না তাঁরা নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে পাচ্ছে। তাই এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে ‘উন্নয়ন’ এর চেয়েও জরুরি ‘বন্টন’ (Distribution) আর সীমিত সরকারি সম্পদ (চাকরি, কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোর সুবিধে গ্যারান্টি করা অনেক বেশি জরুরি। কিন্তু এসবের পরেও পিকের বাক্সে যদি ৫ থেকে ৬ শতাংশ ভোটও পড়ে, তাহলে সেটাও কিন্তু এবারের নির্বাচনের ফলাফলকে এক্কেবারে আলাদা করে দিতেই পারে। আর সম্ভবত পিকের কাটা ভোটের জন্যই বিহার এক ক্লাসিকাল হাং অ্যাসেম্বলির দিকে এগোচ্ছে, যদি তাই হয় তাহলে সরকার তো ভোট ফলাফল বের হওয়ার দিনে নয়, তার বহু পরে বহু লেনদেনের পরেই তৈরি হবে। আর সেক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে এনডিএ।

দেখুন ভিডিও:

Read More

Latest News