একটা কথা এখন খুব পরিস্কার যে, মোদি, অমিত শাহ যে কোনও মূল্যে এবারে বাংলা দখল করতে চান। এখানে কোনও নীতীশ কুমার নেই, কোনও একটা ছোট দলও নেই যাদের সঙ্গে বিজেপি কোনও ধরণের অ্যালায়েন্স করতে পারবেন। মানে ওনারা নিজেরাই দখল নিতে চান, আর তার জন্যে যা যা করতে হয় ওনারা করবেন, ‘সাম দান দন্ড ভেদ’- সব ধরণের অস্ত্র নিয়ে তাঁরা ২০২৬-এর প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। বিহারের ফলাফল আসবার সঙ্গে সঙ্গে গিরিরাজ কিশোর সিং বলেছেন, “অব মমতা দিদি কি বারি হ্যায়।” সেদিন বিকেলেই নরেন্দ্র মোদি দলের বিজয় উল্লাসে হাজির হয়ে ঠিক সেই কথাটাই বলেছেন, “এবারে লক্ষ্য বাংলা।” কিন্তু তাঁদের সামনে একমাত্র সমস্যা হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নোট-বন্দী থেকে এসআইআর – প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এক প্রকান্ড দেওয়াল হয়ে, যে দেওয়াল প্রায় দুর্ভেদ্য। বিজেপির দর্শন থেকে হাবভাব সবটাই মধ্যযুগের মতো, সেই সময়ের রাজা, মহারাজা, সম্রাট, নবাবেরা এক রাজ্য দখল করেই জানিয়ে দিতেন পরের কোন রাজ্য দখলে নামবেন। গুজরাত দখল হয়ে গিয়েছে, এবারে চলো মহারাষ্ট্র, খানিকটা সেরকম হাবভাব। ঠিক তাই বিহারের ফল হাতে পেতেই মোদিজি জানিয়ে দিলেন, “বাংলা চাই।” এক শেয়াল ডাকলে মাঠ ভর্তি শেয়ালেরা হুক্কা-হুয়া ডাক ছাড়ে, তো দেখলাম ডিমের কুসুম অ্যাঙ্কর থেকে নকড়া ছকড়া নেতারা নেমে পড়েছেন রাস্তায়, অঙ্গ মানে বিহার দখল হয়ে গিয়েছে, কলিঙ্গও তো সেই কবেই এসেছে বিজেপির ছাতার তলায়, বাকি এই বঙ্গ। সেটা চাই চাই। ডিমের কুসুম থেকে সুকান্ত মজুমদার প্রত্যেকেই এই বঙ্গ দখলের কথা শুনিয়েছেন। আর তার জন্য বিভিন্ন বাহিনী গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। উচ্ছৃষ্টভোগী ইউটিউবার, যিনি ক’দিন আগে জেলে ছিলেন, আবার জেলে না যাওয়ার কড়ারে এখন বৃদ্ধ বাঘের মত শেয়ানাবাজী করছেন, বাকি কয়েকজন তো শান্তিকুঞ্জ থেকেই মাসোহারা পান। কেবল তারাই নন ছুপা রুস্তমেরাও দাঁত নখ বার করছেন, লক্ষ একটাই বাংলা চাই। এদিকে নির্বাচনের মাত্র ৪-৫ মাস আগে এসআইআর এসেই বিজেপির কঙ্কালসার চেহারাটাকে সামনে নিয়ে এল, প্রত্যেকটা বুথে বিএলএ দেওয়ার মতো লোকও তাদের নেই? অর্ধেক আছে? তাও নেই। এই ক্ষমতা নিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে লড়া যায়? এখনও কোনওরকমে একজন সভাপতি যাওবা পাওয়া গেল, তাঁর কমিটি এখনও হাতে আসেনি। এদিকে খবর এসেছে, আগের বারের থেকে তিন, চার, পাঁচ গুণ টাকা খরচ করবে বিজেপি। গতবারে এই নির্বাচন থেকে প্রায় আড়াই-তিন কোটি টাকা কামিয়ে নেওয়া এক প্রাক্তন সাংবাদিক নেতা সমেত আরও অনেকের ‘চো চ চ’, মানে চোখ চক চক করছে। দিল্লি চায় বাংলার দখল যে কোনও মূল্যে, কিন্তু কেন? বাংলাতে কোন মধু আছে? তেলেঙ্গানা চাই? বুঝি, দেশের সবথেকে বেশি টাকার চলাচল সেখানে হয়, অন্ধ্রতে হয়।
বাংলা কেন? মূলত দু’টো কারণে। প্রথমটা হল, খানিক ইতিহাস আর ভূগোলের মিশ্রণ। গোটা উত্তর ভারতের দিকে তাকান, ওই এক পাঞ্জাব আর ঝাড়খণ্ড ছাড়া পুরোটাই বিজেপির দখলে, হয় বিজেপি নিজেই বা একটা কোয়ালিশন সরকার চলছে। মানে বাংলা দখলে এলে সেই প্রস্থে ও দৈর্ঘ্যে সমান হবে। তাই হাঁক পাড়ছেন, ‘বুঝেছো উপেন, এ জমি লইব কিনে।’ আর ইতিহাস দেখলে পাবেন, এই কলকাতাতেই ডাক্তারি পড়েছিলেন কেশব বলিরাম হেডগেওয়র, যিনি আরএসএস-এর প্রথম সরসংঘচালক ছিলেন, ১৯২১-এ আনুষ্ঠানিকভাবে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা কাজ শুরু করে, যার সভাপতি ছিলেন এই বাংলার মণিন্দ্র চন্দ্র নন্দী আর এই বাংলার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৫১-তে জনসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতার সঙ্গে আরএসএস, হিন্দু মহাসভা, জনসংঘের এক প্রগাঢ় ঐতিহাসিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কলকাতা বা এই বাংলা কোনওদিনও হিন্দুত্ববাদীদের জায়গা করে দেয়নি, তার মূল কারণ হল বাংলার নবজাগরণ। ঠিক যেভাবে ইউরোপের নবজাগরণের সঙ্গেই জন্ম নিয়েছিল যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, ঠিক সেরকমভাবেই বাংলার নবজাগরণ হিন্দুত্ববাদের সামনে এক প্রকান্ড দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যার এক ভিত্তি ছিল চৈতন্যের ভক্তিবাদে, দলিত, শুদ্র, নমশুদ্রদের সঙ্গে নিয়ে সেদিন চৈতন্যের ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এই নবজাগরণের ভিত্তি ছিল। যে ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে শিকাগো ধর্মুসভায় দাঁড়িয়ে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “I am proud to belong to a religion which has taught the world both tolerance and universal acceptance. We believe not only in universal toleration, but we accept all religions as true. I am proud to belong to a nation which has sheltered the persecuted and the refugees of all religions and all nations of the earth.” হ্যাঁ কেবল সহনশীল নয়, আমরা অন্য ধর্মকে গ্রহণ করেছি, রামকৃষ্ণ কলমা পড়ে মুসলমানও হয়েছেন। কাজেই এ রাজ্যে আরএসএস বা হিন্দু মহাসভা, জনসংঘ বা বিজেপির হিন্দুত্বের জায়গা হয়নি। কাজেই আজ বিজেপি নেতাদের মনে হতেই পারে যে, সেই বাংলাকে দখল করাটা এক অগ্রাধিকার। কিন্তু এগুলো এমন কিছু নয়, যা বিজেপির আসল লক্ষ্যকে কোথাও আটকে দিচ্ছে, তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মমতা কেন ক্ষমতায়? নবীন পট্টনায়ক কেন আজ ইতিহাস?
এবারে দ্বিতীয় কারণটাতে আসা যাক, এটাই আসল কারণ। আসলে ঐ হিন্দুত্বকে নিজেদের মত করেই প্রতিষ্ঠা করতে চায় বিজেপি আর সেই ক্ষেত্রে তাদের কাছে প্রথম লক্ষ্য হল এক হিন্দুরাষ্ট্র। হ্যাঁ, মুখে তারা যাই বলুন না কেন, এটাই তাদের লক্ষ্য, আর সেই লক্ষ্যে তারা অবিচল। কিন্তু হিন্দুরাষ্ট্র করতে বাধাটা কোথায়? কে আটকাচ্ছে? আটকাচ্ছে সংবিধান। বিজেপি সংবিধানকে সংশোধন করে, আমূল সংশোধন করেই এক হিন্ধু রাষ্ট্রের সূচনা করতে চায়। কীভাবে তা সম্ভব? ২০২৪-এ ২৪০ হয়েছে, ২০২৯-এ তা ৩২০ হতেই পারে, বিজেপির দুই তৃতীয়াংশ সাংসদ জিতে আসতেই পারেন। কিন্তু তাতেও কি সংবিধানের আমূল সংশোধন সম্ভব? দেশের অতত ১৪টা রাজ্যের সায় থাকতে হবে। হ্যাঁ, সংবিধান সংশোধনের এটাই নিয়ম। তো আপনি বলবেন এনডিএ-র হাতে ১৯টা রাজ্য আছে, আটকাচ্ছে কোথায়? আটকাচ্ছে, এর মধ্যে ৬টা রাজ্য বিজেপির একার নয়, সেখানে তাদের কোথাও নীতীশ কুমার, কোথাও চন্দ্রবাবু নাইডু, কোথাও তিপ্রা মথার উপরে নির্ভর করতে হয়, মহারাষ্ট্রে দুই শরিক। কাজেই বিজেপির দরকার ছিল একটা বড় রাজ্য। এবারে বিহারের নির্বাচনের আগে বিজেপির ধারণা ছিল নীতীশ কুমার গোটা ৫০ আসন পাবে, বিজেপি একাই ৯০, আর বাকিটা আসবে ছোট দলগুলো থেকে, আর সেটা হলে তারা নিজেদের মুখ্যমন্ত্রী করবে, প্রয়োজনে ঐ ৪০ জনের ৩০ জনকে কিনে নেবে। কিন্তু রেজাল্ট আসার পরে তারাও চমকে গিয়েছেন! আপাতত বিহার নীতীশের হাতেই থাকবে, যদিও নীতীশ কুমারেরও বার্গেনিং পাওয়ার কমেছে, তবুও এই মুহুর্তে নীতীশকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। আর নীতীশ বা চন্দ্রবাবু নাইডুকে দিয়ে সংবিধানে আমূল পরিবর্তন করানো সম্ভব নয়, হিন্দুরাষ্ট্র তো দুরের কথা। কাজেই টার্গেট বাংলা, যে কোনওভাবে বাংলা চাই। বিজেপির বাকি ১৩টা রাজ্যে দেখুন কোনও জনপ্রিয় নেতা নেই, আছে এক্কেবারে নির্দেশ মেনে কাজ করার ম্যানেজার, দু’টো রাজ্য আছে যেখানে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যে জনপ্রিয়, যোগী আদিত্যনাথ আর হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। এঁদের কথা শুনলেই বুঝবেন যে, এনারা হিন্দুরাষ্ট্র পারলে কালকেই বানিয়ে ফেলেন। কিন্তু ঐ ১৪ নম্বর রাজ্যটা চাই, সেখানে শুভেন্দু বা সুকান্তের মত ম্যানেজার দরকার। সেটাই আসল কারণ যার জন্য বিজেপি বাংলার দখল নিতে চায়।
গোটা দেশকে মধ্যযুগে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনায় বাংলার দখল নেওয়াটা খুব জরুরি, আর তাই বিজেপি তাদের সবকটা ঘুটি সাজিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু বিজেপির এই পরিকল্পনা কি বামেরা জানে না? কংগ্রেস কি এই পরিকল্পনা নিয়ে ওয়াকিবহাল নয়? সংবিধান যদি তাদের মত করে বদলে নিতে পারে, তাহলে তারপর যে অন্ধকারে দেশকে নিয়ে যাবে ওরা, তার আভাস কি বামেদের কাছে নেই? তার আভাস কি কংগ্রেসের কাছে নেই? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এসেছিল। তারা বাণিজ্যের ফরমান নিয়ে এসেই বুঝেছিল, চেষ্টা করলে এই ভারত তাদের অধীনে নিয়ে আসতেই পারবে। পেরেছিল, খুব সামান্য সামরিক শক্তি নিয়েও পেরেছিল। কারণ তারা ভাগ করতে পেরেছিল স্থানীয় শক্তিগুলোকে, কিছু বিশ্বাসঘাতকও পেয়ে গিয়েছিল। এখানে বিজেপি কিছু বিশ্বাসঘাতক পেয়ে গিয়েছে, সরকারের অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি আছে, আছে অনেক অনেক দুর্নীতির অভিযোগ। কিন্তু সমস্যা হল, বিজেপির একটা বিশ্বাসযোগ্য মুখ নেই, আর তাদের স্বপ্নের দোরগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন রামমোহন, বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, বিদ্যাসাগর, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ এবং আছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ আবার বিজেপিকে না বলার সময় এসেছে, বিজেপি বাংলা জিতলে এটাই হবে তার ১৪ নম্বর রাজ্য, খুলে যাবে সংবিধানকে আমূল সংশোধনের যাবতীয় রাস্তা, বাংলার মানুষকে সেটা রুখতে হবে। ২০২৬-এর ভোট একটা সরকার আনার নয়, একজনের বদলে আরেকজন মুখ্যমন্ত্রী করার নয়, ২০২৬-এ বাংলা দখল রুখে দিলে কিছুটা সময় দেশের মানুষ পাবে, আরও কিছুটা সময়, বিজেপির এই উলটো রথের চাকা থামিয়ে দেবার। বাংলার সংস্কৃতিকে অস্বীকার করা, বাংলার মনিষীদের অসন্মান করা, আদতে বাংলা বিরোধী বিজেপির চোখে এখন কেবল বাংলা দখলের খোয়াব। স্বপ্ন ভাঙলে দেখবেন, বাংলার মানুষ বাংলাকে অপমানের, রবি ঠাকুর, রামমোহন, বিদ্যাসাগরকে অপমানের দাম সুদে-আসলে চুকিয়ে দিয়েছেন। হ্যাঁ, সেদিনটার জন্যও তৈরি থাকুন। তৈরি থাকুন, কারণ আপনাদের স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের মধ্যেই আছে এক বিশাল দেওয়াল, দেওয়ালের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
দেখুন ভিডিও:








