Saturday, December 6, 2025
HomeScrollFourth Pillar | রাজা তোর কাপড় কোথায়?
Fourth Pillar

Fourth Pillar | রাজা তোর কাপড় কোথায়?

ভারতীয় টাকা প্রথমবারের মতো প্রতি ডলারে ৯০ টাকা পার করে গেল, তাতেও নীরব সকলে

একেবারে শুরুতেই একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, একটা জিনিস জানতে ইচ্ছে করছে, সেটা হল – রবিশংকরজি এখন কী বলবেন? না আমি মহান সেতার বাদক রবিশংকরের কথা বলছি না। বলছি ধর্মগুরু শ্রী শ্রী রবিশংকরের কথা। কিন্তু কেন? এমন কী বলেছিলেন রবিশংকরজি? বলব সে কথা। কিন্তু তার আগে বলতে চাই, ‘ঘুম পেয়েছে বাড়ি যা’। কেন বলছি একথা? বেশ শুনুন তবে – ৩ ডিসেম্বর, বুধবার সকালে ভারতীয় টাকা প্রথমবারের মতো প্রতি ডলারে ৯০ টাকা পার করে গেল। দিনের শুরুতেই রুপি ৬ পয়সা কমে ৯০.০২–এ নেমে যায়। বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার খবর অনুযায়ী, ব্যাঙ্কগুলো বেশি দামে ডলার কিনতে থাকায় রুপির উপর চাপ বেড়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারী বা এফআইআইদের টানা বিক্রিও রুপিকে আরও দুর্বল করেছে। মঙ্গলবারই রুপি ৮৯.৯৬–এ বন্ধ হয়েছিল, যা তখনও ছিল এক ঐতিহাসিক নিম্নস্তর। এশিয়ার অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় রুপির পারফরম্যান্স অনেক বেশি খারাপ—চীনা ইউয়ান ও ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়াহের চেয়ে এই মুহূর্তে রুপি অনেকটাই দুর্বল শুধু নয়, এশিয়ার বাজারে ভারতীয় টাকার অবস্থাই সব থেকে খারাপ।

বোঝাই যাচ্ছে বেকায়দায় পড়েছেন মোদিজি। আর তাই কি তাকে বাঁচাতে হইহই করে বাজারে নেমে পড়েছেন ‘গদি মিডিয়া’ এবং ‘গদি অর্থনীতিবিদে’রাও? কী বলছেন এইসব অর্থনীতিবিদ? বলছেন, চিন্তার নাকি কোনও কারণ নেই। টাকার দাম পড়ে যাওয়ার সুবিধা হল, ভারতের বাজারে এখন হু হু করে ডলার ঢুকতে শুরু করবে, চাকরি-বাকরি সুযোগ হু হু করেই বেড়ে যাবে। অতএব টাকার দাম কমেছে বলে দেশ শুদ্ধ লোক আনন্দ করো। কথায় আছে, ‘পাগলে কিনা বলে ছাগলে কিনা খায়’। কিন্তু শুধু পাগলই নয় শয়তানেও কিন্তু অনেক কথা বলে। এই দেখুন না হিটলারের ফ্যাসি জামানায় নাজি পার্টির প্রচার সচিব গোয়েবেলস বলেছিলেন, ‘একটা মিথ্যেকে ১০ বার বলো, সেটা সত্যি হয়ে যাবে’। মোদিজি এবং তাঁর ‘গদি মিডিয়া’ এই কথাটা কিন্তু খুব ভালো করেই জানেন এবং মেনেও চলেন। সেই জন্যই টাকার দাম পড়ার সাথে সাথেই, দেশ তরক্কি করছে বলে প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছে। এই মিথ্যেটাকে এখন  ১০ বার বলা হবে, ১০০ বার বলা হবে, ১০০০ বার বলা হবে। কিন্তু এই কথা বিশ্বাস করার আগে একটু খোঁজখবর নেবেন এটাই অনুরোধ।

কী বলছে আমাদের খোঁজখবর? বিশেষজ্ঞ মহলের বক্তব্য, টাকার দাম পড়ার ফলে আমদানির খরচ বাড়বে। বিশেষত ক্রুড অয়েলের মতো জ্বালানির। তার ফলে পেট্রোল ডিজেলের দাম বাড়বে, বেড়ে যাবে শাকসবজি, ফলমূল, শস্য সবকিছু বাজারে আনার খরচ। সোজা কথায় দেশে মূল্যবৃদ্ধি হবে। বাইরে বেড়াতে যাবেন, সেখানেও খরচ হবে অনেক বেশি টাকা। আর যাঁদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, ভারতে যাঁদের সংখ্যাই বেশি, তাঁরা কী করবে? তাঁরা হাহাকার করবে আর মরবে। এই তো সোজা উত্তর। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া কিন্তু এই পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেছিল। গত সপ্তাহেই বিজনেসলাইন জানিয়েছিল, সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে আরবিআই প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলার বাজারে ঢেলে রুপিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু এ বছর ভারতীয় অর্থনীতি নানা চাপে রয়েছে—শুল্কনীতি নিয়ে অনিশ্চয়তা, নিয়োগে স্থবিরতা এবং চাকরির বাজারে মন্থরতা টাকার দামের উপর বড় প্রভাব ফেলেছে। সিঙ্গাপুরের জানুস হেন্ডারসন ইনভেস্টরস–এর পোর্টফোলিও ম্যানেজার সাট ডুহরা বলেছেন, “ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল, বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে, জিডিপি বৃদ্ধির হার কমেছে, এফডিআই কমেছে, বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করছে—সব মিলিয়ে রুপির অবস্থাও খারাপ হয়েছে।”

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বিকাশ উকিলের লক্ষ্যটা কি দুর্নীতি না রাজ্যের ক্ষমতা?

এসব গোলমালের ভিতরেই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভারতে আসছেন পুতিন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে ভারত-রাশিয়া বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন তিনি। যদিও সূত্রের খবর, আসল নজর কিন্তু বাণিজ্যে। বাণিজ্য বিশেষ করে বৈদেশিক বাণিজ্য যে এখন ভারতে ঠিক কোন জায়গায় সে তো আপনাদের একটু আগেই বললাম। তাতে যদি আপনাদের সন্দেহ না মেটে তাহলে আরো একটু জানাই। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত-আমেরিকার বাণিজ্য চুক্তি ঘিরে অনিশ্চয়তা, আমদানিকারীদের কাছে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি, এবং ভারতে বিদেশি লগ্নীকারী সংস্থাগুলোর টানা শেয়ার বিক্রি, টাকার এই পতনের অন্যতম কারণ। কেন্দ্রের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা ভি নাগেশ্বরন কিন্তু এতে মোটেই ঘাবড়াচ্ছেন না। নাগেশ্বরন জানিয়েছেন, টাকার এই অবমূল্যায়ন মূল্যবৃদ্ধি এবং রফতানির উপর কোনও প্রভাব ফেলবে না। তিনি আরও বলেছেন, সামনের বছরই নাকি টাকা আবার ঘুরে দাঁড়াবে। এইচএসবিসির চিফ ইন্ডিয়া ইকোনমিস্ট এবং স্ট্র্যাটিজিস্ট প্রাঞ্জুল ভান্ডারীও কিন্তু মনে করছেন, টাকার দাম পড়ার ফলে আমেরিকার ট্যারিফের সঙ্গে মোকাবিলা করা সহজ হবে। যদিও আপনি একটু খোঁজ করলেই জানতে পারবেন, দেশ জুড়ে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ কিন্তু ঠিক এর উল্টো কথাই বলছেন।

বাদ দিন অর্থনীতির কচাকচি। চলুন, ঘড়ির কাঁটাকে একটু পিছনের দিকে ঘোরাই। একটুখানি ঘুরে আসি ডাউন মেমোরি লেন ধরে। বলছি ২০১৩ সালের কথা। ডঃ মনমোহন সিং তখন প্রধানমন্ত্রী। সেই সময়ে টাকার পতন নিয়ে তৎকালীন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কড়া সমালোচনা করেছিলেন মনমোহনের। তিনি বলেছিলেন, রুপি এবং মনমোহন সিং “দু’জনেই নীরব হয়ে গিয়েছেন।” সেই মন্তব্য প্রতিবারই ভাইরাল হয় যখন টাকার দাম আবার পড়ে যায়। তবে মোদিজি সরকারে আসার পর এই একই বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা আর তেমনভাবে সামনে আসে না।

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, যেখান থেকে গিয়েছিলাম সেখানে ফিরে আসি। শুরু করেছিলাম একটা প্রশ্ন দিয়ে, সেখানেই ফিরে আসছি আবার। প্রশ্নটা ছিল এই, শ্রী শ্রী রবিশংকরজি এখন কি বলবেন? তিনিই তো এক সময় দাবি করেছিলেন, মোদিজি প্রধানমন্ত্রী হলে ডলার ৪০ টাকায় নেমে আসবে। টাকা এখন ৯০–এর উপরে উঠে যাওয়ার পরেও, এ নিয়ে তাঁর তরফে কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। গতকাল মহম্মদ জুবেইরের এক টুইটের উত্তরে, মাহিন্দ্রা কোম্পানির কর্ণধার আনন্দ মাহিন্দ্রা বলেছেন, এর আগে যখন টাকার দাম পড়েছিল তখন আমরা উৎসব করেছিলাম এবার আপনারা উৎসব করুন। আনন্দ মহিন্দ্রার এই মন্তব্য, এ কি ব্যঙ্গ, নাকি সমর্থন, নাকি দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ তা নিয়ে কিন্তু বিতর্ক শুরু হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেশের কোনও শিল্পপতির কি এই নিয়ে মুখ খোলার সাহস আছে? মুখ খুললেই তো জেলে ভরে দেওয়া হবে। একই কথা সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও সত্যি। মোদি জমানায় সাংবাদিকদের জেলে ভরা কোন নতুন কথা নয়। তাতেও যাঁরা না থামেন, তাঁদের কিন্তু গৌরী লঙ্কেশের মতো খুন হয়ে যেতে হয়।

তাহলে? সত্যিটা কে বলবে? উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ানো রাজাকে যে প্রশ্ন করেছিল,  সেই সরল শিশুর মত চিৎকার করে আজ কে বলবে, ‘মোদিজি আপনার কাপড় কোথায়?’

দেখুন ভিডিও:

Read More

Latest News