বাংলা ব্যান্ড ‘চন্দ্রবিন্দু’র গান মনে আছে? ‘জুজু, জুজু, আমাকে থাবা দিও না। তুমি তো জুজু সোনা!’ তা, এই গানটার কথা হঠাৎ করে বলছি কেন? বলছি এই কারণেই যে, ভোটের বাজারে এরকমই দুই জুজু ছেড়ে দিয়েছে বিজেপি। CAA আর SIR, চলছে খেলা চমৎকার। প্রথমে SIR দিয়ে চাপ তৈরি করার একটা চেষ্টা হল। কিন্তু মুশকিল এই, গাধা যদি সিংহের চামড়া মুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তাহলে লোকে ভয় পায় ঠিকই, কিন্তু যখনই গাধা ডেকে ওঠে, তখনই সবাই হাসতে শুরু করে। এই দেখুন না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার অনুপ্রবেশকারী ঢুকিয়ে ভোটে জিততে চায় বলে কতই না চেঁচামেচি করল বিজেপি। শুভেন্দু তো এখনও সেই ফাটা কাঁসি, কাটা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছেন। কিন্তু বাস্তবে কী হল? নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, নতুন ভোটার ও প্রয়াত ভোটারদের হিসেব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবাংলার ভোটার সংখ্যা যা ছিল তাই আছে। এই ধরুন আনুমানিক সাড়ে আট কোটির কাছাকাছি। যে সংখ্যাটা প্রমাণ করছে এদের ভোটেই মমতা ক্ষমতায় এসেছেন, আর এদের ভোটেই সেই ক্ষমতা ধরে রাখবেন। অর্থাৎ? অর্থাৎ এই, ভোটে জেতার জন্য মমতার অনুপ্রবেশকারী ঢোকানোর কোনও দরকারই নেই। তাহলে কী দাঁড়াল? SIR নামে যে জুজুর ভয় বিজেপি দেখাচ্ছিল, দাঁত-নখ হারিয়ে সেই জুজু হয়ে গেল লক্ষ্মীছানা জুজুসোনা। কিন্তু তাই বলে বিজেপি তো আর বাংলা ব্যান্ডের গান গাইবে না। তারা আবার বাজারে ফিরিয়ে এনেছে জুজু নাম্বার দুই, অর্থাৎ CAA.
কিন্তু কাকে বলে CAA? এই বাজারে এটা কোনও জটিল ক্যুইজের প্রশ্ন নয়, তবু বলে রাখি, CAA বা নাগরিকত্ব সংশোধনী হল একটি বিতর্কিত আইন যা আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে আসা নির্দিষ্ট কিছু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের, যেমন হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিস্টানদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে প্রধান সমস্যাগুলো হল, এ একটা বৈষম্যমূলক এবং বর্জনীয় আইন। কারণ CAA একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্য নাগরিকত্বের পথ খুলে দেয় এবং মুসলিমদের বাদ দেয় যা ভারতের সংবিধানের মৌলিক সাম্যের নীতিকে লঙ্ঘন করে। এছাড়া, উত্তর-পূর্ব ভারতে এর বাস্তবায়ন নিয়ে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক সমস্যা আছে এবং জনসংখ্যার উপর তার প্রভাব নিয়ে উদ্বেগও যথেষ্ট।
আচ্ছা, উত্তর-পূর্ব ভারত নিয়ে যখন কথাই উঠল, তখন অসমে CAA নিয়ে ঠিক কী হয়েছিল, সেটা একটু ফিরে দেখা যাক। অসমে আনুমানিক ১৬ লক্ষ মানুষের নাগরিকত্ব বাদ গিয়েছিল, যার মধ্যে ৯ লক্ষ হিন্দু, আর এর মধ্যে ৫ লক্ষই বাঙালি। বাকি ৭ লক্ষ ছিল মুসলিম। মুশকিল হচ্ছে, তাই তো? এত এত হিন্দু ভোটার বাদ গেলে বিজেপির হাতে তো পেনসিল ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। পশ্চিমবঙ্গ নিয়েও একই সমস্যা। যে বিপুল পরিমাণ হিন্দু সংখ্যালঘুরা এখানে এসেছেন, বসবাস করছেন, SIR করে তাঁদের ছাঁটতে গেলে হিন্দুহৃদয় সম্রাটদের কী হবে? তবুও ভোটের আগে পশ্চিমবাংলায় ফের মাথাচাড়া দিচ্ছে CAA। কিন্তু কেন? কী বলছে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ? আসুন, দেখে নিই।
আরও পড়ুন: Aajke | হিন্দু হিন্দু করে করে ফুটেজ খেতে এসে, জনতার আদালতে গেল হঠাৎ ফেঁসে?
বিরোধীরা দাবি করছে, এই কৌশলের পিছনে বঙ্গ বিজেপির উদ্দেশ্য একটাই। আর সেটা হল, বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফের ভোট হাতানোর খেলা চালু করা, ভোট হাসিলের রাজনীতিতে নতুন করে মেরুকরণের পরিবেশ গড়ে তোলা। কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার এ বিষয়ে সরাসরি বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। CAA-র মাধ্যমেই তাঁদের অধিকার নিশ্চিত হবে। শিবির করে ফর্ম ফিলাপ শুরু হতে চলেছে। এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন অরাজনৈতিক সংগঠন। এগিয়ে এসেছে বিজেপিও।
কিন্তু মুশকিল হল, সেই পুরানো প্রশ্নটা। বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? বিজেপির হাত থেকে নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য কে এগিয়ে এসে বলবে, “না, স্যার, আমি ভারতের নাগরিক নই, আমায় একখানি সাট্টিফিকেট দ্যান দিকি!” তাছাড়া মতুয়াদের নিয়ে ইতিমধ্যেই হাওয়া গরম। এরকম কথাও শোনা গিয়েছে, “একজন মতুয়াও যদি বাদ যায় তো চামড়া গুটিয়ে নেওয়া হবে।” তাহলে কী হচ্ছে? ভয় দেখিয়ে ভোট হাসিল করতে চেয়ে, বিজেপি নিজেই ভয় পাচ্ছে এবার? CAA আর SIR কি তবে ‘উল্টো বুঝলি রাম’ হয়ে ভোট কাড়বে বিজেপির? মানুষ কী বলছে এই নিয়ে?
রাজ্যে মতুয়া জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি উত্তর ২৪ পরগনার বাগদা বিধানসভা কেন্দ্রে। সেখানেই সবার আগে ‘সিএএ সহযোগিতা শিবির’ খোলা হয়েছে। কিন্তু এসব সার্কাস এত দিন পরে কেন? নাগরিকত্বের প্রশ্নে মতুয়াদেরও হেনস্থার মুখে পড়তে হচ্ছে দেখেই কি বিজেপি-র টনক নড়ল? না কি ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের দামামা বাজিয়ে দিয়ে মমতা যে ভাবে ‘বাঙালিয়ানা’র ধ্বজা উড়িয়েছেন, তা দেখেই তড়িঘড়ি পাল্টা ‘CAA তাস’ খেলার চেষ্টা শুরু হয়েছে? কিন্তু বাংলার বিজেপি নেতাদের থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে একটু হলেও বাঙালির ভালোমন্দ বেশি বোঝেন, মানুষের বোধহয় এতে অন্তত কোনও সন্দেহ নেই।