গতকাল বৃহস্পতিবার, খড়্গপুরে বিড়লা গোষ্ঠীর রংয়ের কারখানা উদ্বোধন করার কথা ছিল মুখ্যমন্ত্রীর। কিন্তু এক্কেবারে শেষমুহুর্তে কর্তৃপক্ষ শীর্ষস্থানীয় এক কর্তার শারীরিক অসুস্থতার কথা মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে সেই কর্মসূচি স্থগিত করেছেন। উদ্বোধনের আধ ঘণ্টা আগে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে খবর এসেছে, ওই কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। এরপরেই মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘আমি ওদের (বিড়লা গোষ্ঠীকে) দোষ দিই না। এর পিছনে হাই লোডেড ভাইরাস রয়েছে! সবাইকে ভয় দেখাচ্ছে।’’ কারখানা কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হয়েছে, কবে উদ্বোধন হবে, তা পরে জানানো হবে। খড়্গপুরের মহকুমাশাসক জানিয়েছেন, “আমাদের পক্ষ থেকে যাবতীয় প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু বিড়লা গোষ্ঠীর থেকেই জানানো হয়েছে, কুমারমঙ্গলম বিড়লা অসুস্থ থাকায় ওই উদ্বোধন আপাতত হচ্ছে না।” মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ অমূলক তো নয়ই, বরং এর পিছনে যে দিল্লির নির্দেশ কাজ করছে, তা খুব স্পষ্ট। এ তো পাড়ার ক্লাবের পুজো উদ্বোধন নয়, আধঘন্টা আগে খবর পাঠিয়ে উদ্বোধন স্থগিত রাখার মানে আমরা বুঝি, বাংলার লোকজন বোঝে। আসলে এ রাজ্যে তৃণমূলকে সরাতে পারলে যে বিজেপিই আসবে, তা একটা বাচ্চা ছেলেও জানে। কাজেই সাম, দান, দন্ড ভেদ, বহুতর চেষ্টা চলছে সেই লক্ষ্যপূরণের জন্য। বিজেপির সেই চেষ্টার এক বড় অস্ত্র হল, ভাতে মারার চক্রান্ত। আজ নয়, বহুকাল ধরেই, ইন-ফ্যাক্ট এই বঞ্চণার ইতিহাস কংগ্রেস আমলেও ছিল। কিন্তু এখন তা আরও নগ্ন, আরও তীব্র। হ্যাঁ, সেটাই বিষয় আজকে, বাংলাকে ভাতে মারতে চায় বিজেপি, মজা দেখছেন শুভেন্দু, শমীক, সুকান্তরা।
কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মূল ভিত্তি হল, বিশ্বাস এবং সহযোগিতা। কিন্তু আমরা দেখছি, সেই বিশ্বাস বা সহযোগিতার তিলমাত্র নেই। তৃণমূল কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে যে, নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের সরকার পশ্চিমবঙ্গের প্রতি কেবল প্রশাসনিক নয়, স্পষ্টতই একটা ‘বিমাতৃসুলভ’ মনোভাব নিয়ে চলছে। চারটে কায়দায় আদতে পেটের ভাত মারার চক্রান্ত চলছে। (১) গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প (MGNREGA)-এর টাকা আটকে রাখা, (২) প্রাকৃতিক দুর্যোগের ত্রাণের বকেয়া টাকা না দেওয়া, (৩) আবাসন প্রকল্পের তহবিল আটকে রাখা, (৪) রাজ্যের অর্থনৈতিক কেন্দ্র কলকাতা থেকে একের পর এক কেন্দ্রীয় দফতর ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে সরিয়ে নেওয়া। এই প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলো লক্ষ লক্ষ গরীব মানুষের জীবনধারণের অধিকারকে সরাসরি আঘাত করছে এবং মজার কথা হল, আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও দিনের পর দিন যখন এই একই কাজ চলতে থাকে, তখন প্রশ্ন তো উঠবেই যে, মোদি-শাহ সরকার কি বাংলাকে ভাতে মারতে চায়? আর ঠিক তার পরের প্রশ্নটাই হল, বাংলার এই বঞ্চনার কথা জানেন না শুভেন্দু, সুকান্ত, শমীকেরা? তাঁরা চুপ করে বসে কি মজা দেখছেন?
আরও পড়ুন: Aajke | শুভেন্দু, শমীক, সুকান্তবাবু – চুলকাইয়া ঘা করিবেন না
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে রাজ্যসভাতেই স্বীকার করা হয়েছে যে, মনরেগা প্রকল্পের মজুরি বাবদ পশ্চিমবঙ্গের কাছে প্রায় ৩,০০০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। রাজ্যের লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ শ্রমিক, যাঁরা ১০০ দিনের কাজের উপর ভরসা করে নিজেদের জীবনধারণ করতেন, তাঁরা মজুরি না পেয়ে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছেন। ২০২৫ সালের জুনে কলকাতা হাইকোর্ট রায় দেয় যে, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প ১ অগাস্ট, ২০২৫ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আবার শুরু করতে হবে। প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম বলেছেন, এক কল্যাণমূলক প্রকল্প, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনধারণের অধিকারের সঙ্গে জড়িত, তাকে সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখতে পারে না। কিন্তু আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও, আজ পর্যন্ত প্রকল্পের টাকাও আসেনি, কাজও শুরু হয়নি। কেন্দ্র মনরেগার টাকা আটকে রাখাকে নিছক প্রশাসনিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে নয়, বরং রাজ্যের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার চূড়ান্ত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ২০২০-র আমফান আর ২০২১-এর ইয়াসের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। আমফানের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমে পশ্চিমবঙ্গকে ১,০০০ কোটি টাকা অগাম সাহায্য ঘোষণা করেন। পরে হাই লেভেল কমিটি রাজ্যের জন্য ২,৭০৭.৭৭ কোটি টাকা অনুমোদন করেছিল। একইভাবে, ইয়াসের পরে কেন্দ্র ৩০০ কোটি টাকা আগাম সহায়তা ঘোষণা করেছিল। এই চূড়ান্ত হিসেব আর অনুমোদনের পরেও বকেয়া অর্থের বড় অংশই এখনও পায়নি বাংলার সরকার। একইভাবে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পের টাকাও আটকে আছে। গ্রামের অনেক মানুষজন, যাঁরা প্রথম বা দ্বিতীয় কিস্তি পেয়ে বাড়ি তৈরি শুরু করেছিলেন, তাঁদের কাজ মাঝপথে থমকে আছে। কারণ ওই ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা তিনটে কিস্তিতে দেওয়া হয়। এর সঙ্গেই কলকাতা থেকে একের পর এক কেন্দ্রীয় সরকারি দফতর এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সদর দফতর সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে, ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে অন্য ব্যাঙ্কের সঙ্গে মার্জ করার পর এর সদর দফতর কলকাতা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (SBI)-র সেন্ট্রাল অ্যাকাউন্টস হাব কলকাতা থেকে মুম্বইয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কলকাতাতে ইউকো ব্যাঙ্কের সদর দফতর ছাড়া কার্যত আর কোনও বড় PSU ব্যাঙ্কের হেড অফিস নেই। হিন্দুস্তান স্টিল ওয়ার্কস কনস্ট্রাকশন লিমিটেড (HSCL)-এর কর্পোরেট অফিস ২০১৭ সালে কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কোল ইন্ডিয়া তার বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা যেমন—ইস্টার্ন কোলফিল্ডস, সেন্ট্রাল কোলফিল্ডস, ভারত কোকিং কোল, সাউথইস্টার্ন কোলফিল্ডস এবং মহানদী কোলফিল্ডস-এর মার্কেটিং ও সেলস অফিসগুলো কলকাতা থেকে ধানবাদ, বিলাসপুর এবং সম্বলপুরের মতো অন্য রাজ্যে সরিয়ে নিয়েছে। খুব পরিস্কার এক ভাতে মারার চক্রান্ত আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, বাংলার মনরেগার টাকা আটকে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের টাকা আটকে, আবাস যোজনার টাকা আটকে আর বাংলা থেকে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার দফতর সরিয়ে নিচ্ছে দিল্লির সরকার। তার উপরে তারা শিল্পপতিদের হুমকি দিয়ে এই রাজ্যে শিল্প না করার নির্দেশ দিচ্ছে। মানে বাংলাকে ভাতে মারার চেষ্টা করছে। সেই সময়ে চুপ করে বসে মজা দেখছেন শমীক, শুভেন্দু সুকান্তরা। আপনারা কী বলছেন?
সিরাজ হাত জোড় করে মীরজাফর, জগৎশেঠ, রায়দূর্লভদের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, “বাংলার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা”। বলেছিলেন, “ইংরেজরা দখল নিতে চায় বাংলার, আপনারা সাহায্য করুন”। ঐ বিশ্বাসঘাতকেরা চুপ করে বসে দেখে গিয়েছেন, ক্লাইভকে সাহায্য করেছেন। আর তাই বাংলার মানুষ তাঁদের সন্তানদের নাম মীরজাফর, জগৎশেঠ বা রায়দূর্লভ রাখার কথা মাথাতেও আনেননি। তারা বিশ্বাসঘাতক। আজ দিল্লির সরকার যখন বাংলাকে ভাতে মারতে চায়, সেই চক্রান্ত চলছে তখন চরম মমতা-বিরোধী বামেরাও রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে, কিন্তু চুপ করে বসে মজা দেখছেন শুভেন্দু, সুকান্ত, শমীকেরা। ইতিহাসে তাঁদের জায়গা কোথায় হবে, তা সবাই জানে।