‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’-এর ট্রেলার লঞ্চ পুলিশেই আটকেছে, সমর্থন করবেন কি করবেন না তা তো পরের ব্যাপার, কিন্তু এই সক্রিয়তাই বলে দেয় এ নিয়ে রাজ্য সরকার কী ভাবছে? আসলে এক মিথ্যে ইতিহাসকে পশরা করে বিবেক অগ্নিহোত্রী যা করতে চাইছেন তা হল এক নোংরা রাজনীতি। এই নোংরা ছবিটা যদি একটা কোথাও ছোট্ট আগুন লাগিয়ে দিতে পারে সেই আশাতেই তো এই ছবি বানানো, আর সেই ছোট্ট আগুনকে কীভাবে বড় করে তোলা যায় তা তাঁর প্রভুরা জানেন বইকী। সেই কাজটাই তো চলছে দেশ জুড়ে। মাঝে মধ্যেই খানিক বুদ্ধ–গান্ধীর কথা বলে, দেশের শান্তি সহাবস্থানের কথা বলে আরএসএস সরসংঘচালক যখন বলেন মু্সলমানদের ব্যস আর দুটো, ওই দুটো মসজিদ ভেঙে ফেলতে হবে, একটা মথুরায়, অন্যটা কাশীতে, তখনই বোঝা যায় আসলে উনি উসকানি দিচ্ছেন, আবার এক উন্মাদনা তৈরি করে তার আড়ালে লোকাতে চাইছেন মানুষের রুজি রুটি পেটের লড়াইকে। এবং এও আমরা নিশ্চিত জানি যে ওই দুটোতেই থামবে না, থামানো হবে না বলেই আর ক’দিন পরে আসবে আরও নতুন ছবি যেখানে আরও বড় দাঙ্গা ছড়ানোর বারুদ থাকবে। তো সেসব ভেবেই সরকার ট্রেলার অনুষ্ঠানে বাধা দিয়েছে, হল মালিকদের বুঝিয়ে দিয়েছে সরকার চায় না এই ছবি রিলিজ হোক। সম্ভবত দু’ একটা ব্যতিক্রম ছাড়া এই ছবি হল ও পাবে না, কিন্তু এসবে কি কাজ হবে? মনে হয় না, কারণ বিবেক অগ্নিহোত্রীর অসম্ভব অশিক্ষিত রিসার্চ টিম দিয়ে বানানো এই ছবি নিয়ে এই বিতর্ক খুব ভেবেচিন্তেই তৈরি করা, তাঁরা চান এক ধরনের আগ্রহ তৈরি করে ছবিটাকে কোনও এক ওটিটিতে রিলিজ করতে সেখানে দর্শক জুটে যাবে, আমি আপনিও দেখব, কী আছে সেই ছবিতে তা জানার জন্য। এবার বিবেক অগ্নিহোত্রী পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু সেই ৪৬-এর দাঙ্গার নায়ক বলে চিহ্নিত গোপাল পাঁঠা এই বাংলার, এই কলকাতার অন্যতম বই প্রকাশক সংস্থারও বই বিক্রির হাতিয়ার হবে? সেটাই বিষয় আজকে, গোপাল পাঁঠার ছবি দেওয়া টি-শার্ট বিক্রি করছে কলকাতার অন্যতম বড় বই প্রকাশক।
এমনিতে কলকাতার ওই অন্ধকার দিনগুলোর কথা তো চর্চা করাই উচিত, সত্যি ইতিহাসটাকে তো বের করে আনা উচিত, কিন্তু তাই বলে সেই বইয়ের সঙ্গে গোপাল পাঁঠার ছবি দিয়ে ফ্যান জার্সি? বই বিক্রি করার জন্য যা খুশি তাই? কে ছিলেন এই গোপাল পাঁঠা? উত্তর কলকাতার মানুষজন কি জানেন না? প্রথমে তো গোপাল মুখার্জির সঙ্গে পাঁঠা শব্দটা জোড়ার একমাত্র কারণ ওনার পাঁঠার মাংসের দোকান, অন্য কিচ্ছু নয়, পাট্টা, পাট্টহা ওসব বাজে কথা, এই সেদিন পর্যন্ত বাঙালি পাঁঠার দোকান লেখা ছিল।
আরও পড়ুন: Aajke | হুলিগানইজম– দিলীপ, শতরূপ আর কুণাল ঘোষ
তিনি কী ছিলেন? সুভাষ বসুর ভক্ত? সেটা ওনার ছেলে মেয়ে নাতি নাতনিরা বললেই মানতে হবে? স্বাধীনতার আগেও কংগ্রেস নেতারা গুন্ডা পুষতেন, জেলায় এবং কলকাতাতেও। ইনু মিত্তির, ভানু বোস, ইত্যাদিদের সঙ্গে ইনিও ছিলেন, গোপাল মুখার্জি। বিশাল করে কালীপুজো করতেন, উত্তমকুমারকেও এনেছিলেন উদ্বোধনে। সাহিত্যিক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে ওনার সাঙ্গপাঙ্গরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল, সঙ্গে ছিলেন সম্ভবত পরিচয় সম্পাদক অমিতাভ দাশগুপ্ত, কেবল গোপাল পাঁঠা বলার জন্য বেধড়ক মার খেয়েছিলেন। সেই গোপাল পাঁঠা ৪৬ এর দাঙ্গায় একটা পাড়া, নিজের এলাকাতে খানিক মাস্তানি দেখিয়েছিলেন, কিন্তু তা এক হিন্দু ত্রাতা বা মুসলমানদের বিরুদ্ধে একা কুম্ভ ইত্যাদিও তো নয়। সেদিন ছিল বিরাট ভূমিকা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের, বিরাট ভূমিকা ছিল কিছু কংগ্রেসি নেতাদের। যাঁরা দাঙ্গা রুখেছিলেন। আজ কলকাতায় সেই ইতিহাস জানানোর জন্য দেজ-এর মত প্রকাশককে গোপাল পাঁঠার ছবি দেওয়া টি শার্ট বিলোতে হবে? বইয়ের নাম কলকাতার কসাইখানা, প্রকাশক দেজ আর সেই বইয়ের প্রথম ১০০ জন ক্রেতা নাকি পাবেন ফ্যান জার্সি। এই উন্মাদনাই কি চাননি বিবেক অগ্নিহোত্রী? সেই উন্মাদনাতেই ধোঁয়া দিচ্ছেন বাংলার বই প্রকাশকদের অন্যতম সংস্থা? সেই ৪৬ এর দাঙ্গার স্মৃতি উসকে দেওয়া বিবেক অগ্নিহোত্রীর হিরো গোপাল পাঁঠার ছবি ছাপানো টি শার্ট পরে ঘুরবেন বাঙালি যুবক যুবতী? বিপণন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাংলার অসাম্প্রদায়িক বিশাল ইতিহাসের পাশেই রয়েছে ব্যতিক্রমী ৪৬ এর দাঙ্গা, এই কলকাতাতেই সেই দাঙ্গা হয়েছিল, সেদিন দাঙ্গা যেমন হয়েছিল, তেমনই দাঙ্গা রুখতেও মানুষ পথে নেমেছিলেন। কিন্তু সেই দাঙ্গার স্মৃতিকে, বুকে টি শার্টে ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো কতটা জরুরি? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
যারা ইতিহাস ভুলে যায় তারা ইতিহাসের পুনরাবৃতি ডেকে আনে, হ্যাঁ এটা সত্যি কথা। তাই প্রয়োজন ইতিহাসের চর্চা, তাই প্রয়োজন ইতিহাসের বিশ্লেষণ। কিন্তু ইতিহাস বিকৃতি? সে এক জঘন্য ব্যাপার। ইতিহাসের বিকৃতি, এক জাতি গোষ্ঠী বা বড় জনসমুদায়কে জাতির ইতিহাস বিকৃত করে পড়ানো হলে জন্ম নেবে হিংসা, জন্ম নেবে সাম্প্রদায়িকতা, জন্ম নেবে বিভ্রান্তি। ছোট থেকে যাকে উত্তর কলকাতার এক গুন্ডা, কংগ্রেসের আশ্রয়ে থাকা এক মাস্তান বলেই জেনে এলাম, চিনে এলাম, হঠাৎ তাকে এক মহান ছবিতে এঁকে তার ছবি লাগানো টি শার্ট পরে বাঙালি ছেলেমেয়েরা ঘুরবে, এটা ভাবতেও লজ্জা লাগে।