হাফ ইন্টেলেকচুয়ালদের সমস্যা হল তারা হাফ জানে আর হাফ জানে না, কিন্তু ফুল বলে। মানে তাদের বলতেই হবে, যে কোনও বিষয়ে তাদের যে অগাধ পাণ্ডিত্য আছে তা জানান দেওয়াটা খুব জরুরি। দেখুন না দিলীপ ঘোষকে, সিনেমা নিয়ে কিছু বলতে বলুন। সাফ বলে দেবেন ওসব আমার ব্যাপার নয়। শুভেন্দু অধিকারীকে জিজ্ঞেস করুন, আপনার দিকে তাকাবেন, তারপর চলে যাবেন। কিন্তু আপাতত বঙ্গ বিজেপির সভাপতিকে জিজ্ঞেস করুন, তিনি বলবেন, তাঁকে বলতেই হবে, তিনি এ বঙ্গের একমাত্র ইন্টেলেকচুয়াল বিজেপি বলে কথা। তিনি বিড়ালের জন্মরহস্য থেকে পদি পিসির বর্মিবাক্সের সব রহস্য জানেন, সে সব অনর্গল বলেন আর তৃণমূলের জন্ম নিয়ে কিছু বলবেন না? বলেছেন। বলেছেন যে পদ্মফুল, মানে বিজেপিই নাকি জন্ম দিয়েছে তৃণমূলের। তো জন্ম দেওয়ার সময়ে শমীক কোথায় ছিলেন? তখন হাফপ্যান্ট পরে আরএসএস-এর শাখা চালান ৩৬ বছরের যুবক। তো তিনি কি সেদিন শুনেছিলেন “তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে?” কারণ এই বাংলাতে এখনও বিজেপির সমস্ত অগ্রগতির চেষ্টাকে রুখে দিয়েছেন ওই তৃণমূল দল আর তাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠিক এই মুহূর্তে যা অবস্থা তাতে করে বিরাট কোনও উথাল পাথাল না হলে ২০২৬-এর বিধানসভা ভোটে বিজেপির পক্ষে ৩৫-৪০ পার করাটাও কঠিন হবে। আর সেটা যদি হয় তাহলে কিন্তু সেই নির্বাচনের পরে এ রাজ্যে বিজেপিকে টিকিয়ে রাখাটাই কঠিন হয়ে যাবে। সেই আর্চ রাইভ্যাল তৃণমূলের জন্ম নাকি বিজেপিই দিয়েছিল? সত্যিটা কী? সেটাই বিষয় আজকে, পদ্মের থেকে জন্ম ঘাসফুলের? বিজেপি তৃণমূলের জন্মদাতা?
বিজেপির জন্ম কবে? ৬ এপ্রিল ১৯৮০। প্রথমবার নির্বাচনে লড়ে ক’জন সাংসদ জিতেছিলেন? দু’জন। ১৯৮৯ থেকে রামজন্মভূমি আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই বিজেপি উত্তর ভারতে তাদের সাফল্য পেতে শুরু করে। কিন্তু কিছুদিন পরেই বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝতে পারেন যে কেবল বিজেপির পক্ষে কংগ্রেসকে হারানো সম্ভব নয়। ওদিকে বাম এবং অন্যান্য কংগ্রেস বিরোধী কিছু দল থাকলেও তাদের সঙ্গে জোট করাও সম্ভব ছিল না কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু নেতাদের সঙ্গে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব কথা বলতে শুরু করে।
আরও পড়ুন: হ্যাঁ, ওই জাদুঘরেই ঠাঁই হবে মোদিজির, রাজ্য বিজেপির সিদ্ধান্ত ১০০% ঠিক
এই সময়েই বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব দেশের আঞ্চলিক দলগুলোর দিকে নজর দেয় কারণ সেগুলো সবক’টা বা বেশিরভাগটাই ছিল কংগ্রেস থেকে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসা দল। তাদের কংগ্রেস বিরোধিতাকে কাজে লাগিয়ে সারা দেশে কংগ্রেসকে হারানোর এক নীল নকশা আঁকা হয়, দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে প্রমোদ মহাজন প্রমুখের উপরে দায়িত্ব দেওয়া হয় এদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। হ্যাঁ, এরাই যেদিন বিজু জনতা দলের সূচনা হচ্ছিল সেদিনে এক্কেবারে সামনের আসনে বসেছিল, এবং শুরুয়াতি দিনগুলোতে নবীন পট্টনায়কের দলকে দাঁড় করাতে অর্থ সাহায্যও করেছিল বলে শোনা যায়। কিন্তু এমনকী বিজেডির কংগ্রেস ভেঙে নতুন দল তৈরি করার ক্ষেত্রেও বিজেপির কোনও হাত ছিল না বরং বলা যায় কংগ্রেস হাইকমান্ডের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধেই আঞ্চলিক দল গড়ে উঠছিল, বিজেপি সেই ক্ষোভকে এক চরম সুযোগসন্ধানীর মতো কাজে লাগিয়েছে আর কাজ শেষ হয়ে গেলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। বাংলার ইতিহাসও তাই, কংগ্রেস হাইকমান্ডের যা ইচ্ছে খুশি সিদ্ধান্ত আর এ রাজ্যের বাম সরকারের সঙ্গে একটা গোপন সমঝোতার বিরুদ্ধেই গড়ে ওঠে তৃণমূল। আর গাছ থেকে পাকা আম পড়লেই যেমন হ্যাংলার দল হাজির হয়, এসেছিল বিজেপি। একমাত্র সিপিএম-এর মতো এক বিরাট শক্তির বিরুদ্ধে লড়ার জন্যই তৃণমূল নেত্রী বিজেপির হাত ধরেছিলেন, এটা খানিকটা দেশ স্বাধীন করার জন্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সুভাষচন্দ্র বসুর হিটলারের সাহায্য নেওয়ার মতো ব্যাপার ছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মমতা বুঝতে পারেন, বিজেপি এক মস্ত বোঝা, রাজ্যের ৩৩ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট তাঁর কাছে অধরাই থেকে যাবে যদি তিনি বিজেপির সঙ্গ না ছাড়েন, কাজেই ওই তৃণমূলের মধ্যে যথেষ্ট বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করেই মমতা বিজেপির হাত ছাড়েন। হ্যাঁ, এটা ইতিহাস। বিজেপি তৃণমূলের জন্ম দেয়নি, বিজেপি তৃণমূলকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, সেখানে ডাহা ফেল করে এখন হাত কামড়াচ্ছে, আর ক’দিন পরে মুখ পুড়িয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। তাকিয়ে দেখুন বিজেপির দিকে, আজও সারা দেশে তাদের আদর্শের এক্কেবারে বিপরীত দুই দল, জেডিইউ আর তেলুগু দেশমের উপরে নির্ভর করেই দেশ চালাচ্ছে, আজই যদি তারা কাশী মথুরা দখলের দাক দেয়, সরকার ভেঙে যাবে, আজও তারা এক দেশ এক নির্বাচনের বিল আনতে পারছে না, আজও তারা যে কোনও মুহূর্তে ক্ষমতা হারিয়ে এক গাড্ডায় পড়তেই পারে। সেই দলের এক হাফ ইন্টেলেকচুয়াল নেতা বাংলাতেই বসে এক ভুল রাজনৈতিক ইতিহাস আওড়াচ্ছেন। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, রাজ্য বিজেপি সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন যে তৃণমূলের জন্ম দিয়েছে বিজেপি, যে তৃণমূলের জন্যই বিজেপি আজ বাংলাতে দাঁত ফোটাতে পারছে না, সেই তৃণমূলের জন্ম নাকি বিজেপিই দিয়েছে। আপনাদের মতামত কী? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
এবং এই বিতর্কে যোগ দিয়ে কমরেড সুজন ভট্টাচার্যও কিছু বলেছেন। রাস্তাতে ওনারা নেই, বিধানসভাতে নেই, সংসদে সবেধন নীলমণি বিকাশ ভট্টাচার্যের মেয়াদ শেষ হবে ২ এপ্রিল ২০২৬-এ। কাজেই ওনাদের সন্ধে হলে টিভি ক্যামেরার সামনে কিছু তো বলতেই হয়। শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ওনারা তৃণমূলের জন্ম দিয়েছেন, কমরেড সুজন ভট্টাচার্য বলেছেন রাজ্য বিজেপি সভাপতি নাকি অর্ধেক সত্যি বলেছেন, পুরোটা হল, হ্যাঁ, বিজেপি তৃণমূলের জন্ম দিয়েছে, আর বিজেপিই নাকি তৃণমূলকে টিকিয়ে রেখেছে। বোঝো কাণ্ড, এই সেদিনে এক সঙ্গে সংসদের বাইরে ধর্না দিলেন, হ্যাঁ, সেখানে কমরেড ভট্টাচার্যও ছিলেন, জন ব্রিটাসও ছিলেন, অভিষেক ব্যানার্জি ছিলেন, মহুয়া মৈত্রও ছিলেন। এখনও ওই ইন্ডিয়া জোটে, বিজেপিকে হারানোর জন্য যে জোট তৈরি হয়েছে, সেই জোটে সিপিএমও আছে, তৃণমূলও আছে। কিন্তু কমরেড সুজন হয় সেসব জানেন না, বা বোঝেন না, আর না হলে উনি এখনও পুরনো ঘায়ের যন্ত্রণা ভুলতেই পারছেন না।