সব্বাই জানে সামনে ভোট, অতএব ত্রাণ বিতরণে কোনও কমতি অন্তত এবারে হবে না, কারণ ভোট বড় বিষম বস্তু। শুনে হাসি পাবে, বিজেপির রাজ্য সভাপতি ইনটেলেকচুয়াল শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন ত্রাণ বিতরণে যেন বাছ-বিচার না করা হয়। ভাবা যায়! যে দলের সর্বোচ্চ নেতা থেকে সর্বনিম্নস্তরের নেতারাও রোজ হিন্দু-মুসলমান করেই যাচ্ছেন, সেই দল নাকি বাছ-বিচার না করেই ত্রাণ দেবে। যে দল শাসিত উত্তরপ্রদেশে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার সোচ্চারে জানিয়ে দেন আসন্ন প্রসবা মুসলমান মেয়েটির চিকিৎসা তিনি করবেন না, সেই দলের এক এবং একমাত্র বুদ্ধিজীবী রাজ্য সভাপতি বলছেন, ত্রাণের সময় কোনও বাছ-বিচার করব না। ভোট বড় বালাই। কিন্তু কপাল, কপাল, কপালের নাম গোপাল, কিম্বা অনায়াসে মমতাও রাখা যেতেই পারে। কলকাতার আকাশভাঙা বৃষ্টি থেমে গেল একদিনেই, জল নেমে গেল ৩৬ থেকে ৪৮ ঘন্টা পরে, সবে চাগিয়ে ওঠা শুদ্ধ জনরোষ ভুলে, এমনকি শুভেন্দু অধিকারীও ফুচকা খেলেন, পাঁপড় খাবার স্টাইলে। সে যাই হোক, খেলেন তো। এদিকে উত্তরবঙ্গের বৃষ্টিও এল ঝেপে, গেলেও আরও তাড়াতাড়ি, বিরাট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু আকাশে আবার রোদ্দুর, লক্ষ্মীপুজোর দিনেই ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি পোস্টিয়েছেন ট্যুরিস্টরা, মমতা নিজেই বসে থেকে দু’দিন ধরে কেবল ত্রাণ সামলাননি, হাসপাতালে গিয়ে আহত খগেন মুর্মুর সঙ্গে দেখা করে এমএলএ, এমপি পেটানোর পরে একটা মমতাময়ী অপটিকস তো সামনে এনেছেন। এবং এর মধ্যে এমনকী জলদাপাড়াও ট্যুরিস্টদের জন্য খুলে যাওয়ার মুখেই। সেটাই বিষয় আজকে, জলদাপাড়ার গন্ডারেরাও ঘরে ফিরল, বিজেপির ভাগ্য ফিরল না।
তোর্সা নদীর জলে ভেসে যাওয়া পাঁচটা গন্ডারকে ৪০ ঘণ্টা পরে ফেরানো হল জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানে। শনিবার রাতে আকাশভাঙা বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছিল ৬টা গন্ডার। কোচবিহারের পাতলাখাওয়ায় চলে যায় দু’টো, ঘোকসাডাঙার খট্টিমারিতে একটা, আলিপুরদুয়ারের পূর্ব কাঁঠালবাড়িতে দুটো ও শিমলাবাড়িতে একটা। তাদের ঘরে ফেরাতে রবিবার দুপুরে শুরু হয়েছিল ‘অপারেশন রাইনো’। শেষ হয় মঙ্গলবার দুপুরে। জলদাপারাতে ফেরত এসেছে ৫টা, একটা ফিরবে শিগগির। গন্ডারেরা যেমন ফিরেছে, তেমনই ফিরেছে পাহাড়ের লোকজন, ক্ষয় ক্ষতির হিসেব চলছে। হ্যাঁ, ত্রাণের কোনও অভাবের কথা এখনও নেই। এবারে বিজেপি ঐ বন্যা পরিদর্শন ছেড়ে বিপুল কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়েই, এমনকি মোদি সরকারের মন্ত্রী কিরণ রিজিজুকে নিয়েই ত্রাণ বন্টনে নেমেছেন, তবুও দু’এক জায়গাতে ধাক্কাধাক্কির কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এত বড় এক দুর্যোগের পরে অন্তত দূর থেকে হলেও একটা কালো পতাকা বা বিক্ষোভ দেখানোর জন্য কিছু শ্লোগান চোখে পড়ল না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাত্রাপথে। তিনি গিয়েছেন, গাড়ি থেকে নেমেছেন, মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন, চেক আর ত্রাণ বিতরণ করেছেন। কিন্তু ‘নাকি সবচেয়ে শক্তিশালী গড় বিজেপির’ এই উত্তরবঙ্গে এই দু’দিনের মুখ্যমন্ত্রীর সফরে একটা বিক্ষোভ অ্যারেঞ্জ করে উঠতে পারলেন না বিজেপি নেতারা। তার মধ্যে আবার রাহুল লোহার তৃণমূলে যোগ দিলেন।
আরও পড়ুন: Aajke | শঙ্কর ঘোষ, খগেন মুর্মুর উত্তরবঙ্গ অভিযান
এই দুর্যোগ না আসলে এমনকী উত্তরবঙ্গেও বিজেপির এই কঙ্কালসার চেহারাটা দেখতেই পেতাম না। হবে না জানি, তবুও তো মানুষ তুলনা করতে চায়। ধরে নিন মমতা বিরোধী দলে, এরকম একটা দুর্যোগ হলে, কার্নিভালে সন্ধে কাটিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সকালে উত্তরবঙ্গ আসা আর দু’দিনের সফর সেরে ফেরার মধ্যে নয় নয় করেও গোটা চল্লিশ বিক্ষোভের মুখোমুখি হতে হত শাসককে। আর সেই আন্দোলন আর বিক্ষভ থেকে জন্ম নেওয়া মমতার বিরুদ্ধে বালির বাঁধও খাড়া করতে পারছেনা বিজেপি। মমতা বললেন, ডিভিসি জল ছাড়ছে, ড্রেজিং না করার ফলে তাদের জল ছাড়তেই হচ্ছে আর তাই ভাসছে দক্ষিণবঙ্গ। ডিভিসিই জানাল, গত ৪০ বছর ড্রেজিং হয়নি, ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হবে। মমতা উত্তরবঙ্গে গিয়ে বললেন, সিকিম, ভুটানের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর জন্য ভাসছে ডুয়ার্স, দার্জিলিং। হ্যাঁ, উত্তর ভারতের ধস আর বন্যার পরে এটাই বিশেষজ্ঞদের রিপোর্ট। গোটা উত্তর ভারতজুড়ে যেখানে সেখানে নদী বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ তৈরি করার চেষ্টা করেছে, সেগুলো একের পর এক বিপর্যয় ডেকে আনছে, চুং থাং জলাধারের বিপর্যয় আমাদের নজর এড়িয়ে গিয়েছে। মিডিয়া কিনে, সাংবাদিক পুষেও এই সারসত্যগুলোকে লুকোনো যাচ্ছে না। কাজেই এই বিপর্যয়ের দায় নিতে হবে মোদি সরকারকে। হ্যাঁ, অসংখ্য অপরিকল্পিত, সাধারণ অনুমোদনও না পাওয়া বাড়ি, মল, বহুতল গড়ে উঠেছে দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্সিয়াং মিরিকে, ডুয়ার্সেও, তার দায় রাজ্য সরকারেরও আছে। কিন্তু গত বেশ কিছু বছর জুড়ে সেই দার্জিলিংয়ের সাংসদ, এমএলএ-রা কী করছিলেন? পার্বত্য পরিষদ কী করছিল, সেই প্রশ্নও তো আছে। সব মিলিয়ে এ দুর্যোগ আপাতত কেটে গেল, গন্ডারেরাও ঘরে ফিরল, কিন্তু বিজেপির ভাগ্য ফিরল কি? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, বিপর্যয়ের পরে দার্জিলিং জেলা জুড়ে জরুরি ত্রাণ ব্যবস্থাকে যেভাবে সামলালেন মুখ্যমন্ত্রী, তাতে কি উত্তরবঙ্গে মানুষের কাছে তৃণমূল নিজেদেরকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারল? নাকি বিজেপিই এখনও উত্তরবঙ্গে বেশি গ্রহণযোগ্য?
প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাড়ছে নগরায়ণের ফলে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ভঙ্গুর হিমালয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, আর গাছ কাটা সারা উত্তরভারত জুড়েই একের পর এক বিপর্যয়কে ডেকে এনেছে। বিপর্যয় আরও বাড়বে যদি আমরা এই বিষয়গুলোতে মনোযোগ না দিই। কিন্তু এটাও ঘটনা, কবে সেই পরিবেশ আমরা ফিরে পাব, কবে রোধ হবে ভূমিক্ষয়, এসব তো আমরা জানি না। জানি যে, এসবের কোনও চটজলদি সমাধান নেই। তাই দরকার অন্তত একটা শক্তপোক্ত ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের, দুর্যোগের পরে একটা স্বচ্ছ ত্রাণ বিলি ব্যবস্থার। দার্জিলিংয়ে এই দুর্যোগের পরে সবটা না হলেও সেই দিক থেকে এক অন্য ছবি আমরা দেখলাম – মানুষকে উদ্ধার করে ঘরে ফেরানো হল, ত্রাণ পৌঁছল মানুষের কাছে, এমনকি গন্ডারেরাও ফিরল তাদের ঘরে, আর ঠিক সেই কারণেই বিজেপির ভাগ্য ফিরল না।