২৬-এর নির্বাচন? তার প্রস্তুতি? বুথ লেবেলে কমিটি? পন্না প্রভারি? সেসব দুরস্থান। আপাতত ইন্টেলেকচুয়াল শক্তি চাটুজ্যের সাড়ে তিনখানা কবিতা মুখস্থ বিজেপি রাজ্য সভাপতির ঘুম ছুটে যাচ্ছে দল সামলাতে। ক’দিন আগেই দমদমের সভাতে কেন লকেট নেই? জানতে চাওয়া হয়েছে দিল্লি থেকে। অসতর্ক সাহিত্য চর্চার কোন ফাঁকে, কোন বেয়াক্কেলে এই কাজ করে গিয়েছে তা নাকি খুঁজে বার করতে হবে। না, এমনিতে যে সেসব খুঁজে বার করতে খুব ঘাম ঝরাতে হবে তা তো নয়, সব্বাই জানে, মুরলি মনোহর লেনের চায়ের দোকানের চাওলাও জানেন যে, কার হাতযশ কাজ করেছে। যেমন আমরা সব্বাই জানি কোন সূত্রে, কার উসকানিতে দিলীপ ঘোষের ব্যক্তিগত মূহুর্তের ছবি ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। এসব ওপেন সিক্রেট, কিন্তু ধুম করে নাম জানিয়ে দিলে যে নিউটনের ‘থার্ড ল’ কাজ করবে সেটাও শমীক ভট্টাচার্য বিলক্ষণ জানেন। জানেন বলেই তাই নাকি? কী করিয়া হইল? তদন্ত হইবেই গোছের কথাবার্তা বলে টাল সামলানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। আর তারই মাঝে ভগ্নদূত মারফত জানতে পেরেছেন যে ঠাকুরবাড়িতে, মানে মতুয়াদের ঠাকুরবাড়িতে জোর কোন্দল শুরু হয়েছে। এমনিতে ধরুন সে বাড়িতে আপাতত ‘টু ইস টু ওয়ান’ চলছিল। মানে মমতাবালা ঠাকুর তৃণমূলে, আর সুব্রত ঠাকুর এবং শান্তনু ঠাকুর বিজেপিতে। কিন্তু সমস্যা হল এবারের ক্যাচালটা সেম সাইডের, বিজেপি বনাম বিজেপি। তাই সেদিকে নজর পড়েছে দল সভাপতির। কিন্তু যে কারণে সমস্যা, তা মেটানো আর যাঁরই হোক ওনার কম্ম নয়। এদিকে রোজ যে টেনশন বাড়ছে, সেই বাড়তে থাকা টেনশন যদি একটা পাকা ঘুটি কাঁচিয়ে দেয়, তাহলে ২৬-এর আগে সমস্যা বাড়বে বৈ তো কমবে না। সেটাই বিষয় আজকে, মতুয়া পাড়ায় জমাটি লড়াই, এদিকেও বিজেপি, ওদিকেও বিজেপি।
মতুয়াদের অন্যতম পবিত্র তীর্থস্থান ঠাকুরনগরে দলে দলে মানুষ ভিড় করছেন মতুয়া কার্ড এবং ধর্মীয় শংসাপত্র সংগ্রহের জন্য, কেন? ওই সার্টিফিকেট থাকলেই নাকি ভোটার তালিকা থেকে নাম কাটা যাবে না। মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে এক নোংরা রাজনীতির খেলা চলছে সেখানে। ঠাকুরবাড়িতে ঢোকার মুখে নাট মন্দির থেকেই শুরু হয়েছে মানুষের লাইন। নাট মন্দিরে যে শিবির করা হয়েছে, তার দখল রয়েছে শান্তনু ঠাকুরের হাতে। চেয়ার, টেবিল পেতে কম্পিউটার নিয়ে বসে আছেন শান্তনু ঘনিষ্ঠরা। প্রতিটি টেবিলের সামনেই জমজমাট ভিড়। নাট মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে ফ্লেক্স লাগিয়ে ছয়লাপ করে দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য মতুয়া কার্ড এবং ধর্মীয় শংসাপত্র সংগ্রহ করতে মাইকে সবাই অনুরোধ করা হয়েছে। এই লোকজনেরা একবারও ভাবছেন না যে, তাঁরা তো এই দেশেরই নাগরিক, তাঁরা এদেশে আছেন, আধার কার্ড আছে, ভোট দিচ্ছেন এতদিন ধরে। কিন্তু এক আতঙ্ক তাঁদের এইখানে ঠেলে নিয়ে এসেছে। একই কারণে গাইঘাটার বিজেপি বিধায়ক তথা শান্তনু ঠাকুরের বড় ভাই সুব্রত ঠাকুর শিবির করেছেন নিজের বাড়ির সামনে। সেখানেও অজস্র ফ্লেক্স লাগানো রয়েছে। ফ্লেক্সের উপরে মতুয়াদের লাল নিশান। তার মধ্যে লেখা, ‘অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসংঘ’। পাশেই লেখা রয়েছে, ‘এই অফিস হইতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ‘হিন্দুত্ব ধর্মীয় সার্টিফিকেট’ প্রদান করা হয়’। ভূ-ভারতে এমন সার্টিফিকেট যে হয়, তা কেউ জানে? আর এই সার্টিফিকেট বিলিকে কেন্দ্র করেই ঠাকুর বাড়িতে এখন আড়াআড়ি বিভাজন, বিধানসভা নির্বাচনের আগেই মতুয়া মহাসংঘের অধিকার, ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে ঠাকুর পরিবারের দুই মাথার মধ্যে এই কোন্দলে সবথেকে বেশি বিড়ম্বনায় বিজেপি।
আরও পড়ুন: Aajke | এমএলএ জীবনকৃষ্ণ কি তাঁর নিজেরই মোবাইল ছুড়ে ফেলেছেন ঝোপে?
কারণ, দুই ভাইয়ের একজন বিজেপি’র সাংসদ, আর একজন বিধায়ক। কাকে রেখে কাকে ফেলবেন সভাপতি, ফেলতে পারি, কিন্তু কেন ফেলবো? এদিকে অনেকে বলা শুরু করেছেন সিএএ–র নাম করে সাধারণ মতুয়া, উদ্বাস্তুদের বিভ্রান্ত করে টাকার বিনিময়ে শান্তনু ঠাকুর এবং তাঁর অনুগামীরা মতুয়া কার্ড এবং ধর্মীয় শংসাপত্র বিলি করছেন, তৃণমূল নেতা বনগাঁ পুরসভার চেয়ারম্যান গোপাল শেঠ এই দাবিতে কেবল ধুয়োই দেননি, এবার নতুন করে মামলার হুমকি দেওয়ায় সেটা নতুন মাত্রা পেয়েছে। মানে এই সার্টিফিকেট বিতরণ এবার আদালতে যাবে, আর বলাই বাহুল্য এক্কেবারে একচোখো কেউ না হলে যে কোনও বিচারক এই ধরণের সার্টিফিকেট যে এক টুকরো কাগজের চেয়ে বেশি কিছু নয়- তা বলে দেবেন। কাজেই ব্যাপারটা ক্রমশ ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠছে। এবং বিজেপি রাজ্য শিবিরও দু’ভাইয়ের একজনকে বেছে নিচ্ছেন- কেউ শান্তনুর পক্ষে, কেউ বা সুব্রতর পক্ষে। কেউ শান্তনুকে ফোন করে “পাশে আছি” খবর পাঠাচ্ছেন, কেউ আবার সুব্রতকে “লড়াই জারি রাখুন, পাশে আছি,” ফোন করছেন। অ্যাডভানটেজ মমতা বালা ঠাকুরের, তিনি সময় বুঝেই ময়দানে নেমেছেন। কিন্তু একবার ভাবুন সেইসব অসহায় মানুষজনের কথা, যাঁরা আতঙ্কিত, যাঁদের ভয় আবার সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়ার, যা তারা প্রতিদিন শুনছেন। আর তাই নিয়ে এক নোংরা রাজনীতিতে তাঁদের ঠাকুরবাড়ির দুই প্রধান। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করছিলাম, হিন্দু ধর্মীয় সার্টিফিকেট কী? কেউ শুনেছেন? এই ধরণের সার্টিফিকেট দেওয়ার নামে মানুষকে ঠকানোর মানে কী? সুপ্রিম কোর্টের রায়েই এখন আধার কার্ড থাকলেই তো ভোটার তালিকাতে নাম থাকবে, তাহলে মতুয়া ভোটারদের নিয়ে বিজেপি এই নোংরা খেলাটা খেলছে কেন?
মতুয়ারা গুরুচাঁদ হরিচাঁদ ঠাকুরের শিষ্য, যাঁরা হিন্দু সনাতন ধর্মের, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরা ব্রাহ্মণ্যবাদের শোষণ আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। “যদি পুজো করতে একজন পুরুতের দরকার লাগে তাহলে সে পুজো করবোই না,” বলেছিলেন সেই হরিচাঁদ ঠাকুর। আজ সেই তারাই সনাতনীদের সঙ্গে নিজেদের জুড়েছেন, আর তারা নাগরিকত্বের ভয় দেখিয়ে আনুগত্য চাইছে। সেদিন যে সামাজিক বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিলেন গুরুচাঁদ, হরিচাঁদ ঠাকুর, তা আজ এক প্রতিষ্ঠান। আর প্রতিষ্ঠান থাকলেই তার ক্ষমতা আর অর্থ নিয়ে কামড়াকামড়ি হবে, সেটাই আমরা দেখছি, কিন্তু মজার ব্যাপার হল আপাতত সেই লড়াইয়ের এদিকেও বিজেপি, ওদিকেও বিজেপি।