ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের চেহারাটা সারা বিশ্বের থেকে অনেকটাই আলাদা। বিশ্বের সব জায়গায় সংসদীয় গণতন্ত্রে মানুষ তার প্রতিনিধিকে নির্বাচন করে, সে সরকারে থাকুক বা না থাকুক, সে ঐ এলাকার, কন্সটিচুয়েন্সির প্রতিনিধি কেবল নয়, দেশের শাসন ব্যবস্থার একজন। মানে দেশ চলে কেবল সরকারে থাকা মন্ত্রী এমপি দিয়েই নয়, দেশ চলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে, আর তাই বহু সময়েই আমরা দেখেছি সরকার বিরোধী সাংসদরাও দেশের ভেতরে বা বাইরে একইসঙ্গে উন্নয়নের কথা বলছেন, তার জন্য কাজ করছেন। আমাদের এখানে সরকার পক্ষের দায় সরকার চালানোর, দেশ চালানোর। বিরোধীরা কেবল তার বিরোধিতা করার জন্য বসে আছে। বহু বহু এমন বিল আছে, যা একদল নিয়ে এসেছিল, অন্যদল তার তুমুল বিরোধিতা করেছিল। পরে আবার সেইদলই ক্ষমতায় এসে, সেই বিল পাস করিয়েছে। আগে যারা শাসক দলে ছিলেন, তাঁরা বিরোধিতা করেছে। আজ নয়, সেই শুরু থেকেই ‘কনস্ট্রাকটিভ অপোজিশন’ বলে কোনও ব্যাপার আমাদের দেশে ছিলই না। বিরোধী মানে বিরোধী, শাসক মানে শাসক। কিন্তু সেটা এই মোদি জামানাতে এসে। অন্য আরেক চেহারা নিয়েছে। কারণ এই প্রথম এক সরকার, যারা দেশের বিরোধী দলকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে চিহ্নিত করেছে। কাজেই খেয়াল করে দেখুন গত দশ বছরে রাজ্যে রাজ্যে এবং অবশ্যই জাতীয় রাজনীতিতে এক অসম্ভব তিক্ততা বেড়েছে। সাধারণ সৌজন্য বোধগুলোও লোপাট হয়ে গিয়েছে। গড়ে ৩০০ মিলিলিটার লিটার বৃষ্টি হয়েছে। দেশের কোন শহর এই পরিমাণ বৃষ্টির পরে জলে ভাসবে না? কিন্তু শহরের বহু জায়গাতেই গতকাল সন্ধ্যের পর থেকেই জল নেমেছে। কিছু জায়গাতে পাম্প চালানো হচ্ছে, নামছে. কয়েকটা জায়গাতে জল ছিল, যা আপাতত নেমে গিয়েছে। কিন্তু তাকিয়ে দেখুন বিরোধী নেতাদের দিকে, গতকাল তাঁরা উল্লসিত, ডুবছে ডুবছে, মমতা ডুবছে। হ্যাঁ, কর্পোরেশনের মেয়র রাস্তায় নেমেছেন, মুখ্যমন্ত্রী সারাদিন সারা রাত জেগে মনিটরিং চালাচ্ছেন, কর্পোরেশনের টিম নেমেছে, তৃণমূলের কাউন্সিলররা নেমেছেন, কর্মীরা নেমেছেন, সামান্য শক্তি কিন্তু বাম কর্মীদেরও দেখা গেল ত্রাণের কাজে। বিজেপি নেতারা উল্লসিত! এতদিনে বাগে পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু ঐ যে ‘অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়’। জল নেমে গেল, সেটাই বিষয় আজকে, জল নেমে গেল ২৪ ঘন্টায়, তাহলে শুভেন্দু, সুকান্ত কী করবেন?
গতকাল থেকে বিবৃতির পর বিবৃতিই দিয়ে যাচ্ছেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি, শমীক ভট্টাচার্য, বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বা সুকান্ত মজুমদার। প্রত্যেকটাতে রাজ্য সরকার, তৃণমূল, মমতা ব্যানার্জির ষষ্ঠীপুজো। ভালো, এটাই তো আপাতত কালচার। কিন্তু একবারও একটা বিবৃতি দেখেছেন, দলের কর্মীদের এখনই মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য? যান, আপনারা মানুষের পাশে দাঁড়ান! এটাই তো সুযোগ জনসংযোগের, তাঁরা অনায়াসে টাকা পয়সা যুগিয়ে ত্রাণের ব্যবস্থা করতে পারতেন, মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা তো করতে পারতেন. মানুষ মনে রাখবে তো তাঁদেরই, যারা দুর্যোগের সময় পাশে ছিল। এখনও মানুষের মনে আছে ৭৮-এর বন্যা। না, সেদিন পাশে ছিলনা কংগ্রেস কর্মীরা। বাম কর্মীরা একগলা জলে দাঁড়িয়ে মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন, খিচুড়ি দিয়েছিলেন। হ্যাঁ, এখনও মানুষ সেসব কথা মনে রেখেছে। হ্যাঁ, চার পাঁচ দিন পরে জল নেমেছিল, তখনও খিচুড়ি এসেছিল বাড়ির দরজায়। অনেকেই বলেছিলেন, আর লাগবে না। আর আজ? প্রধান বিরোধী দল সারাটা দিন ধরে কেবল কথা বলে গেলেন, সরকার চোর, মমতা চোর, ববিচোর, তৃণমূল চোর, কিন্তু কাজের কাজটা করলেন না, মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন না। এবং দিনের শেষে জল নামা শুরু হল এবং এখন ৯৫ শতাংশ জায়গাতে আর জল জমে নেই। অতএব মাত্র ২৪ ঘন্টা পরে শুভেন্দু, সুকান্ত, শমীকের হাতে নিটোল পেনসিল ছাড়া কিছুই নেই।
আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, ‘বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সমেত বিজেপি রাজ্য নেতারা গতকাল থেকে তীব্র সমালোচনা করলেন রাক্য সরকারের। এটা জেনেও যে, দেশের প্রত্যেক বড় শহরেই এই ধরণের বৃষ্টি পড়লে জল জমে, জল জমবে। প্রশ্ন হল, কত তাড়াতাড়ি সেই জল বার করা যায়। আমরা কিছুদিন আগেই তিনদিন গোটা মুম্বইকে দেখেছি জলে ভাসছে। দু দিন ধরে জলে ভাসছে রাজস্থানের জয়পুর। দিল্লিতে তো কথাই নেই। বেঙ্গালুরু আছে এই তালিকায়। তাদের তুলনায় অনেক তাড়াতাড়ি ২৪-৩৬ ঘন্টার মধ্যে ৯৫ শতাংশ জল নেমে গিয়েছে কলকাতায়। এর পরেও ঐ বিজেপি নেতাদের সমালোচনা মানুষ কীভাবে নেবে?
অবশ্যই, এই জলজমা কলকাতায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ১০ জনের মারা যাওয়াটা অসম্ভব বেদনাদায়ক। এর মূল দায় অবশ্যই সিইএসসি-র। কিন্তু কিছু দায় তো রাজ্য সরকারেরও থাকে। সিইএসসি-র এই ধরণের অপদার্থতার নজির আমরা আগেও দেখেছি। ওনারা এই কাজ চালিয়ে যাবেন আর রাজ্য সরকার চুপ করে বসে থাকবে, তাও তো হয় না! এবার এখানেও দেখুন, বিজেপি নেতারা সিইএসসি-র কাছে ক্ষতিপূরণের দাবি করতে পারতেন, মৃতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারতেন। সেসব নিয়েও ওনারা একটা কথাও বলেননি, কেবল সমালোচনা করে গিয়েছেন। মানুষ অত গাধা নয়, তাঁরা জানে দুর্যোগে কারা আছে পাশে, কারা থাকে পাশে। হ্যাঁ, ভোটের বুথে যাবার আগে সেই কথাগুলো তাঁদের মাথায় থাকে বৈকি। কেবল এঁরা মমতার পদত্যাগ চেয়েছিল, এটাই যথেষ্ট বিরোধিতা নয়। অবশ্যই, গাফিলতি তো আছেই সিইএসসি-র। আছে বলেই ১০ টা জীবন চলে গেল।