কলকাতা: জীবনের শিকড় হারানো মানুষের গল্প তুলে ধরেছেন এক বাঙালি লেখিকা(Bengali Writer)। নেদারল্যান্ডসে(Netharlands) শিক্ষকতা করেন কলকাতার মেয়ে শতরূপা বসু রায়(Satarupa Bose Roy)। সেখানেই শরণার্থীদের জীবনের নানা দিক নিয়ে বই লিখেছেন- ‘যাদের দেশ বলে কিছু নেই'(Jader Desh Bole Kichu Nei)। সম্প্রতি বইটি অক্সফোর্ড বুক স্টোরে প্রকাশিত হলো। বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাবেক আমলা তথা তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ জওহর সরকার, ডাচ কনসুলার জেনারেল নামিত শাহ, টেকনো ইন্ডিয়ার সিইও শঙ্কু বোস,পলিটিকাল এনালিস্ট রবিন রায় এবং বাচিক শিল্পী-অভিনেতা সুজয় প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।। উপস্থিত সকলেই বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বইটির প্রাসঙ্গিকতার উপর যথেষ্ট জোর দেন।
আরও পড়ুন:প্যালেস্টাইন সংগঠনকে সন্ত্রাসবাদী তকমা, বিক্ষোভ ইংল্যান্ডে
জওহর সরকার জানিয়েছেন, আজকাল তো রাজনীতি ইতিহাসকেই অবজ্ঞা করছে। তিনি বলেন, “তাজমহল মুঘলরা তৈরি করেছিলেন,যাদেরকে বর্তমানে রাইট-উইংরা বহিরাগত বলে আখ্যা দেয়। যদি তাদের ক্ষমতা থাকতো, তবে তাজমহলকেও বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতো, কারণ এটি বহিরাগতদের গৌরব বাড়ায়।” রবিন রায় বলেন, ভারতবর্ষের মধ্যে আমাদেরই বা কোথায় দেশ? বিহারে গেলে বলে, আপকে পাস্ কালকাত্তা কা আধার হ্যায়? ভারতবর্ষের মধ্যেই এতো বিভেদ! দেশ বলে সত্যি কি আর কিছু আছে!
শতরূপা কলকাতার চেতলায় বড় হয়েছেন এবং এখন নেদারল্যান্ডসের ফ্লেভোল্যান্ড প্রদেশের আলমের শহরে থাকেন। নেদারল্যান্ডসের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ইংরেজি ভাষা শেখানোর কাজ করেন তিনি। লেখক হিসেবে তিনি গত দুই বছর ধরে নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে গিয়ে সেখানকার আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের জীবনযাত্রা, দুর্ভোগ এবং নতুন করে বাঁচার লড়াইয়ের গল্পগুলো তিনি সযত্নে লিপিবদ্ধ করেছেন। শতরূপা জানান, সিরিয়া, ইউক্রেন, সোমালিয়া, তুরস্ক, আফগানিস্তান এবং তিউনিসিয়ার মতো বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের ব্যক্তিগত কাহিনিগুলো বইটিতে সংকলিত হয়েছে।
কলকাতার মেয়ে শতরূপা নিজেও একজন প্রবাসী। তিনি বলেন, “একজন সহ-অভিবাসী হিসেবে আমি নতুন একটি শহরকে নিজের বাড়ি করে তোলার জটিলতাগুলো বুঝতে পারি। যদিও আমার অভিজ্ঞতা শরণার্থীদের দুর্দশার তুলনায় একেবারেই নগণ্য, তবুও মাঝে মাঝে নিজেকেও শিকড়হীন মনে হয়। আমি আশা করি, এই বইটির মাধ্যমে আমি এই শরণার্থীদের অভিজ্ঞতাগুলো আরও ভালোভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারব এবং তাদের দৃঢ়তার প্রতি সম্মান জানাতে পারব।” শতরূপার মতে, শরণার্থীরা শুধু খবরের শিরোনামের কিছু সংখ্যা নয়,তারা এমন মানুষ যাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব স্বপ্ন, ভয় এবং সুপ্ত প্রতিভা রয়েছে।
বর্তমানে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসন একটি রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয়। অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও অনেককে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। শতরূপা বসু রায়ের এই বইটি এমন সময়ে মানুষের কাছে মানবিকতার এক নতুন বার্তা দেবে বলে বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেকের আশা। ‘যাদের দেশ বলে কিছু নেই’ কেবল একটা বই নয়। এটি বর্তমানের একটা গুরুত্বপূর্ণ সত্যকে শক্তিশালীভাবে তুলে ধরে। যে কোন দেশেই অশ্রয়প্রার্থীরা কেবল ক্রমিক সংখ্যা নয়, তারা স্বপ্ন,ভয় এবং মানবহৃদয়ের সমগ্র ইন্দ্রিয়, প্রতিভা সব কিছু নিয়ে এক একজন পরিপূর্ণ মানুষ। এই দেশহীন মানুষগুলোর গল্পগুলো আমাদের মানবতাবোধ এবং আমাদের অস্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করে এক গভীর সংগ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন:রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষে আর মধ্যস্ততা করতে চান না ট্রাম্প!
এখন চার পাশে যা ঘটে চলেছে, তাতে বার বার মনে হয় কোথাও যেন এই মানবিকতারই অবক্ষয়। লেখক নিজে একজন গ্লোবাল সিটিজেন। তিনি পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, কথা বলেছেন আর একমাত্র মানবিকতার নিরিখেই তাদের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ হয়েছে। ভৌগোলিক কোন সীমানা সেখানে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক।
কিন্তু বর্তমান রাজনীতি তো সেই কথা বলে না, ভাষার নিরিখে, জাতের নিরিখে, ধর্মের নিরিখে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে। আর তাই এই বইটি এখন, এই দেশ কালে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ এই বইটি নানা প্রশ্ন উত্থাপন করেছে, কথোপকথনের সূত্রপাত করেছে এবং পাঠকদের এই প্রান্তিক মানুষগুলোকে মানুষ হিসেবে দেখার জন্য আবেদন করেছে। এবং পরিশেষে, এটি একটি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সৃষ্টি হয়েছে, যা অভিবাসন সম্পর্কে জটিল আলোচনায় বোঝাপড়া এবং মানবিকতার গুরুত্বের উপর জোর দেয়।