Friday, November 7, 2025
HomeScrollFourth Pillar |  বিজেপির মুখে বন্দেমাতরম ? ওয়াক থু
Fourth Pillar

Fourth Pillar |  বিজেপির মুখে বন্দেমাতরম ? ওয়াক থু

বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড সাহেব ছিলেন রাস্তায়, কংগ্রেসের পিকেটিং সরাতে, ১৯০৭ সাল, এক ১৭ বছরের যুবক, কিংসফোর্ডের সামনে গিয়ে চিৎকার করে শ্লোগান দিলেন বন্দেমাতরম ( Vande Mataram), পাশাপাশি সবাই গলা মেলালো। সাহেব সেপাইদের সুশীল সেন কে গ্রেফতার করতে বললেন আর তিনি তো ম্যাজিস্ট্রেট তাই সঙ্গে সঙ্গে বিধান ১৫ ঘা বেতের বাড়ি, প্রতিটা বাড়ি পড়ছে, ১৭ বছরের সুশীল প্রতিবার বন্দেমাতরম বলছেন। ১৪ /১৫ বছরে টেগরা বল ছিলেন চট্টগ্রাম বিদ্রোহের একজন সৈনিক, অভিযানের পরে সবাই চলে গেলেন জালালাবাদের পাহাড়ে, সেখান থেকে শুরু আরেক লড়াই, লোকনাথ বল, সেই যুদ্ধের কমান্ডার, টেগরার গুলিবিদ্ধ হলেন, মারা যাবার আগে তিনি বলেছিলেন, সোনা ভাই, লোকনাথ বলের ডাক নাম, সোনা ভাই চললাম, তোমরা লড়াই চালিয়ে যাও, বন্দেমাতরম। ৭৩ বছরের মাতঙ্গিনী হাজরা, ৪২ এর আন্দোলনে সেই গান্ধিবুড়ি, কাঁধে পতাকা নিয়ে এগিয়ে চললেন ফৌজদারি আদালত ভবনের দিকে, একটা দুটো নয়, সাত আটটা গুলি করে তাকে ওই রাস্তাতেই মেরে ফেলা হয়, তিনি শ্লোগান দিচ্ছিলেন, বন্দেমাতরম। যে ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য ইংরেজদের সমস্ত সাহায্য দেওয়ার কথা বলেছিলেন এই বিজেপির আইডল শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। যে দেশজোড়া ভারত ছাড়ো আন্দোলনে এই হিন্দু মহাসভার নেতারা খোঁচড়ের ভূমিকাতেই ছিলেন, যে ৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণই করেননি এই আরএসএস। সেই তারা আজ বন্দেমাতরম নিয়ে পথে। দু কানকাটাদের লজ্জা নেই, জানা গেল বাঙালি আবেগকে ধরতে বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে মাঠে নামছে বাংলার গেরুয়া শিবির।

বঙ্গ বিজেপির এই কর্মসূচিতে হুগলিতে বন্দেমাতরম ভবনে যাবেন কেন্দ্রীয় নেতা সুনীল বনসল, উত্তর 28 পরগনার কাঠালপাড়ায় বঙ্কিমচন্দ্রের পৈতৃক বাসভবনে যাবেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব ও সুকান্ত মজুমদার। কলেজ স্ট্রিটে থাকবেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। আসলে বন্দেমাতরমের সার্ধ শতবৎসর পূর্তি নিয়ে ওনারা বন্দেমাতরম নিয়ে মাঠে নামছেন। এবং মূর্খদের বড় জ্বালা, যারা সেদিন স্বাধীনতা আন্দোলন সংগ্রামের ধারে কাছেও ছিল না তাদের নেতা তড়িপার অমিত শাহ আগে বলেছিলেন, এবারে আরেক মিথ্যেবাদী প্রধানমন্ত্রী নেহাত মূর্খের মত  বলেছেন যে এই গানের পরবর্তি স্তবকগুলো বাদ দিয়ে কংগ্রেস আসলে হিন্দু জাতির প্রতি অন্যায় করেছে। তিনি বলেছেন, “১৯৩৭ সালে বন্দে মাতরমের গুরুত্বপূর্ণ স্তবক, যা গানটির প্রাণ, সেগুলো সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বন্দে মাতরমের ওই বিভাজন দেশভাগের বীজ বপন করেছিল।’’ এটা সত্যি যে বন্দে মাতরমের প্রথম স্তবকটাকেই নেহেরু-নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ১৯৩৭-এ জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণ করে, কিন্তু তার দায় যদি কারুর হয়, সেটা রবীন্দ্রনাথের। বন্দে মাতরমের দুর্গা স্তোত্র সমেত গোটা সঙ্গীতটি গ্রহণ করা হবে, না শুধু প্রথম দুই প্যারাগ্রাফ, তা নিয়ে কংগ্রেসের ভেতরে মতবিরোধ ছিল। নেহেরু নেতাজিকে বললেন রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ নিতে। নেতাজী শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবি ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নেতাজিকে জানালেন, তিনি শুধু প্রথম দুই প্যারা গ্রহণ করার পক্ষে, কারণ সেটা দেশ মায়ের বন্দনা; কিন্তু দুর্গা বন্দনার পরের অংশটা যাঁরা মুর্তি পুজায় বিশ্বাসী নন তাঁদের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে, আর তাঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়াও ঠিক হবে না। রবীন্দ্রনাথের মত পাওয়ার পরই এই নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জাতীয় কংগ্রেস। কাজেই ঐ বাদ দেওয়াটা নেহেরু গান্ধীর নয়, রবি ঠাকুরের। আর বঙ্কিমচন্দ্রে লেখা আনন্দমঠ উপন্যাসে এই বন্দেমাতরম কথাটা ছিল, কিন্তু এই শব্দবন্ধ তার প্রেক্ষিতের অনেক বাইরে এসেই দেশ জুড়ে কংগ্রেস কর্মী, দেশের বিপ্লবীদের মন্ত্র হয়ে উঠেছিল, স্বাধীনতা আন্দোলনের মন্ত্র। রাইটার্স কাঁপিয়ে গুলি চালাচ্ছেন তিন যুবক, বিনয় বাদল দীনেশ, শোনা যাচ্ছে গুলির শব্দ আর বন্দেমাতরম, তলায় রাস্তায় ভিড় জমে গিয়েছিল, রাইটার্স এ বিপ্লবীরা? সেই কিংসফোর্ড, অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্যই গিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম প্রফুল্ল চাকী। ক্ষুদিরাম হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি পরেছিলেন, কেঁপে উঠেছিল ফাঁসির মঞ্চ, তিনি উচ্চারণ করেছিলেন বন্দেমাতরম। আমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত, যা আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িত, যা আমাদের সংবিধানের সঙ্গে জড়িত, যে বোধগুলো নিয়ে আমরা ৪৭ সাল থেকে নতুন ভারতের দিকে রওনা দিয়েছিলাম, যে চিন্তা চেতনা নিয়ে ভগত সিং চন্দ্রশেখর আজাদ সূর্য সেন বা আসফাকুল্লা প্রাণ দিয়েছিলেন দেশের জন্য। সেখেন বিজেপি এক বিশ্বাসঘাতক ছাড়া তো কিছু নয়। সেদিনের সেই বোধ চিন্তা সেই চেতনা আদর্শ নিয়ে কথা বলার সময় এসেছে বৈকি। স্বাধীনতার সংগে দেশভাগ এল আমাদের ওপর, বলা ভাল ওধারে পঞ্জাব আর এধারে আমার বাংলাকে ভাগ করে এল দেশের স্বাধীনতা। দেড় কোটি মানুষ এ পার থেকে ওপারে গ্যালো, ওপার থেকে এপারে আসলো।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ভোটার লিস্ট এ নাম কাটা গেলে কতদিন নাগরিক থাকবেন আপনি?

র‍্যাডক্লিফ সাহেব আমার উঠোন আমার খেলার মাঠ জায়নামাজের উদার জমিন আসমানের মধ্য দিয়ে লাইন টেনে বলে দিলেন এটা ভারত ওটা পাকিস্তান।  এল দ্বিখন্ডিত স্বাধীনতা। প্রশ্নগুলো নেহাতই জরুরি কেন না স্বাধীনতার ৭২ বছর পরে দেশের ২৮/২৯ কোটি মানুষ আতঙ্কিত, ভয়ে আছে, ভয় পাচ্ছে কারণ তাদের অতীত তাদের সামনে এসে হাজির, তাদের কি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হবে? তাদের কি ঘাড় ধরে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হবে? তাদের কাছে যে কাগজ আছে তাই কি যথেষ্ট? নাকই এই কাগজগুলো থাকার পরেও তারা থাকবে তালিকার বাইরে? হিন্দু জনসংখ্যার কাছে কি কোনও option ছিল? আর কোনও জায়গা ছিল যাবার, তাদের তো ভারত ছেড়ে কোথাও যাবার উপায়ই ছিল না। কিন্তু যাদের কাছে ছিল? যারা তার পরেও গেল না, গেল না কারণ তারা জিন্নাহ র দ্বিজাতি তত্ত্বে বিশ্বাস করে নি, বিশ্বাস করেছে যে হিন্দু মুসলমান একসঙ্গেই থাকা যায়, থাকতে হয়। তারা নিজেদের ভিটে ছেড়ে যাবার কথাই ভাবে নি। ভাবেনি কারণ আমরা ভারত বাসীরা বলেছিলাম আমরা অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ গড়ে তুলবো, সেকুলার স্টেট। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। আমরা সবাই বলেছিলাম। তারা বিশ্বাস করেছিল। আমরা কি ভুল বলে ছিলাম? আমরা কি মিথ্যে বলেছিলাম? এতদিন পর সেই কথাগুলো, সেই পুরনো দলিল দস্তাবেজ আমাদের ঘেঁটে দেখতে হচ্ছে। লজ্জা। এতদিন পর সেই প্রশ্ন আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। লজ্জা। এতদিন পর আমাদের দেশের ২৮/২৯ কোটি মানুষ আমার সহনাগরিক কিনা সেই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। লজ্জা। তবুও আর এক বার শেষ বারের মত এই বিষয়ের নিষ্পত্তি হয়ে যাক। শেষ বারের মত ঐ বর্বর লোকগুলোর মুখের ওপর পুরোন সত্যি টা আবার বলে দেওয়া যাক। মনে আছে জামাইতুল উলেমা এ হিন্দ, যারা দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধিতা করেছিল, যারা কায়েদে আজম জিন্নাহর বিরোধিতা করেছিল। বলেছিলেন যে ভারত ভাগ করা যাবে না, বলেছিলেন আমরা একসঙ্গেই থাকবো। ওদিকে জিন্নাহ কার কথা ধার করে দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা বলেছিলেন? কে এই হিন্দু মুসলমান দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রথম উদগাতা? বিনায়ক দামোদর সাভারকার, ব্রিটিশ দের সাহায্য করার শর্তে জেল থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন, পেয়েছিলেন। ওই জিন্নার নাতি নসলি ওয়াডিয়া, তাদের ফ্যামিলি ৭০ এর শুরু থেকেই জনসঙ্ঘের সবথেকে বড় আর্থিক সাহায্যদাতা ছিলেন, জরুরি অবস্থার সময়েও ওয়াডিয়া জনসঙ্ঘকে সাহায্য করেছে, প্রমোদ মহাজন বিজেপি কোষাধক্ষ্য হবার সময়েও তাঁর সঙ্গে ওয়াডিয়ার সম্পর্ক দারুণ ছিল আর আরএসএস এর নানাজি দেশমুখকে নসলি ওয়াডিয়া আঙ্কল বলতেন।

এখন আজ, ৭৮ বছর পর সেই দ্বিখন্ডিত ভারতে যাঁরা স্বেচ্ছায় থেকে গেলেন, তাদের ভেতর থেকে প্রশ্ন উঠছে, আমরা একসঙ্গে থাকতে পারবো তো, আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হবে নাতো? তাঁদের অনেকেই বলছেন প্রাণ যায় যাক এবার তো রাস্তাতেই নামতে হবে, প্রাণ গেলেও এ লড়াই এর শেষ দেখে ছাড়বো। কখন মানুষ প্রাণ দেবার কথা বলে? শেষ ভরসাটাও চলে গেলে? দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে? কি এমন হলো যে তাদের ভরসা চলে যাচ্ছে? তাদের পিঠ ঠেকে যাচ্ছে দেওয়ালে? কেন আমার দেশের সহনাগরিক মুসলমান রা এরকম ভয় পাচ্ছেন? রাজনীতি তাদের বিরুদ্ধে? প্রশাসন? বিচার বিভাগ? তাহলে কি আমাদের অজান্তেই ঘটে গেছে কোনও নিঃশব্দ বিপ্লব। সংবধান কি তাহলে আর ধর্ম নিরপেক্ষ নয়? সরকার কি আর ধর্মনিরপেক্ষ নয়? জামাতুল উলেমা র সমর্থকরা বিক্ষোভ প্রদর্শনে নামলে তাদের বলা হচ্ছে আপনারা হিন্দু বিরোধী দেশ বিরোধী, রাস্তায় না নামলে ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে আমরা বিপন্ন। কোথায় যাবে তারা? আমার দেশের ২০% মানুষ বিপন্ন স্বাধীনতার ৭২ বছর পরে? মুসলমান দের পোষাক নিয়ে ইঙ্গিত করছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, পুলিশ অফিসার হুমকি দিচ্ছে রাস্তায় নামলে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেবো। শেখ আবদুল্লা জিন্নাহ র বিরুদ্ধে কথা বলতেন, জিন্নাহ শেখ আবদুল্লাহ কে ইসলাম বিরোধী। সেই শেখ আবদুল্লার কাশ্মীর আজ দ্বিখন্ডিত, তা আর এক পূর্ণ রাজ্যও নয়। আসাম এ সোনার বাংলা গাইলে জেলে পোরার ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে। এদিকে পাঞ্জাব বাংলার মানুষ চিন্তিত কি হবে এন আর সি তে? কী হবে এনপিআর এ? নতুন করে এসে হাজির এস আই আর, লক্ষ্য একই। কারণ বাংলা পঞ্জাবের ক্ষতই তো সবথেকে বেশি।

কজন গুজরাটি কে তার মাতৃভূমী ছাড়তে হয়েছে। যাঁরা চঝেড়েছেন তাঁরা দেশের ব্যাঙ্কের কোটি কোটি টাকা লুঠ করেই দেশ ছেড়েছেন। সব থেকে বিপন্ন বাংলা, এখানেই সব থেকে বেশি বিষ ছড়াচ্ছে। আন্দামানে সেলুলার জেলে চলে যান, কালাপানির সাজা কারা পেয়েছিল, কারা শহীদ হয়েছিল? তালিকা দেখুন। সে তালিকার ৭০ শতাংশ বাঙালি, হ্যাঁ ৭০%, সেই বাঙালির দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলছে কারা? যারা স্বাধীনতার প্রশ্নে ছিলেন গান্ধীর বিরুদ্ধে, যারা গান্ধি হত্যাকারীদের ষড়যন্ত্রে সরাসরি সামিল, তারা আজ দেশপ্রেমিক? ভারত রত্ন? কি আশ্চর্যভাবে ইতিহাস তার গতিপথ পাল্টাচ্ছে। সেদিনের বিশ্বাসঘাতক সাভারকার আজ রাষ্ট্রপ্রধানের আদর্শ, সেদিনের গান্ধী হত্যাকারীদের দল আজকে রাষ্ট্রক্ষমতায়, সেদিন যাঁরা ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ধরিয়ে দিয়েছেন পুলিশের হাতে, সেই তারা আজ বন্দেমাতরম নিয়ে মানুষের কাছে দেশপ্রেমিক হবার চেষ্টা করছে! সেই তারা যারা মুচলেকা নিয়ে জানিয়েছিল জেল থেকে ছাড়লে আর কোনওদিন ব্রিটিশদের বিরোধিতা করবো না, আর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে কথা রেখেছিল, তাদের সব লড়াই তখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে, সেই আর এস এস বিজেপি আজ দেশপ্রেমিকের মুখোশ পরে খ্যামটা নাচ নাচছে, দেখলে শুনলে বিবমিষা জাগে, সহজ বাংলায় বমি পায়।

Read More

Latest News