ওয়েব ডেস্ক: এই চিত্রনাট্য আসলে অন্য একজন লিখেছে। যে কোনো গল্পের শেষটা আসলে সেই-ই লেখে। তার নাম ‘সময়’। আর সময়ের লেখা সেই চিত্রনাট্যে জয়কে পিছনে ফেলে চলে গেলেন বীরু—ধর্মেন্দ্র দেওল। শোলে পঞ্চাশ বছর পার করে এখন নতুন এক মানে নিয়ে দেখা দিল সেই গান— ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে।
হ্যাঁ, ধর্মেন্দ্রজি আর নেই। বয়স হয়েছিল দু’সপ্তাহ কম নব্বই বছর। দীর্ঘ সময়। সেই কবে, পঞ্চাশের দশকে পাঞ্জাব থেকে এক স্বপ্নের শহরে পাড়ি জমিয়েছিলেন স্বপ্ন দেখা ছেলেটি—যে শহরের নাম তখন বম্বে। দিলীপকুমারের সিনেমা দেখে যিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন ঘুরে ঘুরে টিউবওয়েল বসানোর কাজ, আর সিধে চলে গিয়েছিলেন মায়ানগরীতে—নায়ক হবেন বলে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | স্বাধীন, শিরদাঁড়া আছে, এমন সাংবাদিককে ভয় পাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি
বাকি গল্পটা আপনি-আমি—আমরা সবাই মোটামুটি জানি। লড়াই করে মুম্বাইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে শুধু ধর্মেন্দ্রজি নন, আরও অনেকে পায়ের তলা শক্ত করেছেন। ভবিষ্যতেও করবেন। কিন্তু আসল গল্পটা হলো—ছ’দশকের কেরিয়ারে তিনশোরও বেশি ছবি; ফ্লপ, হিট, সুপারহিট—সবই আছে তার ভিতর। কিন্তু তারপরেও তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়েছে ধর্মেন্দ্রকে। বোধহয় তাঁর পরিবারকেও। নাহলে তিনি কেনই বা বলবেন—“দেওলদের সাফল্য ইন্ডাস্ট্রির ভালো লাগে না।”
ছ’য়ের দশকে ধর্মেন্দ্র যখন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখছেন, তখন দিলীপকুমার, দেব আনন্দের জমানা। উঠতি স্টার শাম্মী কাপুর, রাজেন্দ্রকুমার। এদের মুখোমুখি দাঁড়াল ধর্মেন্দ্রর শোলা আওর শবনম, আনপড়, বন্দিনী-র মতো ছবি। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে গেলেন এক জাঠ যুবক। আবার ধরুন ১৯৬৯-১৯৭৪—রাজেশ খান্নার একচ্ছত্র রাজত্ব চলছে, তখনও লড়াই দিতে হাজির এই জাঠ। ইয়াকিন, আদমি আওর ইনসান, আয়া সাওন ঝুমকে, জীবন মৃত্যু, মেরা গাঁও মেরা দেশ, সীতা আওর গীতা, রাজা জানি, লোফার, জুগনু, ঝিল কে উস পার, ইয়াদোঁ কে বারাত, ব্ল্যাকমেল—লম্বা তালিকা।
এরপর ধর্মেন্দ্রর কেরিয়ারে এল নতুন বাঁক। মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও দেখা দিল নতুন ট্রেন্ড। এতদিন নায়ক-নায়িকার জুটিই জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু ১৯৭৫-এ ধর্মেন্দ্র–অমিতাভ জুটির চুপকে চুপকে এবং শোলের পর দুই নায়কের জুটিও বক্স অফিসে বিজয়ী হলো। ১৯৭৫-এর পর অমিতাভ যখন সুপারস্টারের মুকুট পরে ফেলেছেন, পরে যখন মিঠুন মেগাস্টারের শিরোপা পেয়েছেন—তখনও কিন্তু ধরমজি একের পর এক হিট দিয়ে গিয়েছেন। প্রতিজ্ঞা, চরস, ধরমবীর, শালিমার, ড্রিম গার্ল, কর্তব্য, আস-পাস, রাজপুত, ঝুঁটা সচ, গুলামি, আগ হি আগ, হাতিয়ার, বাটওয়ারা—সিনেমা হলে ঢেউয়ের মতো ভিড় পড়েছিল।
সেই ভিড় সোমবারেও ছিল—জুহুর বাংলোর সামনে। হাজির ছিলেন জয়—অমিতাভ বচ্চন। শোলেতে যাঁর মৃত্যুর পর ধর্মেন্দ্রর মুখে যে ডায়লগ—“চুন চুনকে মারুঙ্গা”—আজ প্রায় প্রবাদ হয়ে গেছে। আর আমরা জানি—প্রবাদের মৃত্যু নেই।
কেন সফল ছিলেন ধর্মেন্দ্র? সিনে-আঁতেলদের কথা বলছি না—যাদের পকেটের জোরে সিনেমা হিট হয়, তাদের নয়; সেই আম-আদমির কাছে ধর্মেন্দ্র হিট কেন? তার বড় কারণ রাগ। এই রাগ অমিতাভের মতো সিস্টেমের বিরুদ্ধে আগুন জ্বালায় না—ধর্মেন্দ্রর রাগ তাঁরই মতো সরল, প্রাকৃতিক, ইন্সটিংকটিভ। এই রাগ যুক্তিতর্কের ধার ধারে না। ধর্মেন্দ্রর রাগ দর্শকের মনে আবেশ জাগায়। জে.পি. দত্তের গুলামি-তে হাত বাঁধা অবস্থায় ধর্মেন্দ্র যখন নাসিরুদ্দিন শাহকে বলেন—“তুমনে রণজিৎ সিং চৌধুরী পর হাত উঠায়া। লেকিন তব ইয়ে গলতি মাত করনা, যিস দিন রণজিতে কে দোনো হাত খুলে হোঙ্গে”—তখন দেশি সরল ক্রোধের সামনে আন্তর্জাতিক মানের অভিনেতা নাসিরুদ্দিনও যেন একটু ফিকে হয়ে যান।
হ্যাঁ—সরলতা। এটাই ধর্মেন্দ্রর দুর্বলতা, আবার এটাই তাঁর শক্তি। শোলে-র জয় যেখানে চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেয়, সেখানে বীরু আপাদমস্তক সরল। সে অ্যাকশন, রোম্যান্স, কমেডি—সবই করে; আর সবই তাকে মানায়। সত্যিটা হলো, শোলেতে বাকি সবাই টাইপ-ক্যারেক্টার—একমাত্র ধর্মেন্দ্রর চরিত্রই রামধনুর মতো রঙিন।
সেই সরলতার দামও চুকোতে হয়েছে তাকে। শুধু মারদাঙ্গা নয়—সত্যকাম, গুড্ডি-র মতো ছবিও করেছেন তিনি। কিন্তু পুরস্কারওয়ালারা ফিরেও তাকাননি। ছবি হিট—তার মানে কী? ধরমজি তো ‘দেশোয়ালি অ্যাক্টর’। “উসে ছোড়ো ইয়ার।” গুলামি-র মতো ছবির জন্য কোনো সম্মান পাননি। অথচ সেই বছরই অমিতাভ মর্দ-এর মতো মশলা ছবির জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন। এই কারণেই কি রাজনীতিতেও ধরমজিকে ঠিক জায়গা করা গেল না?
জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ফিল্মফেয়ার লাইফটাইম অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় ধর্মেন্দ্রকে। আর তিনি বলেছিলেন—“৩৭ বছর ধরে এই পুরস্কারের জন্য অপেক্ষা করেছি। প্রত্যেকবার অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের আগে স্যুট বানাতাম—কিন্তু ডাক আসত না। তারপর স্যুট বানানো বন্ধ করলাম।”
এই দেশোয়ালি সরলতার ইতি হলো গত সোমবার। শেষ হল মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এক অধ্যায়। চলে গেলেন তিনি। লাভ ইউ ধরমজি।
দেখুন আরও খবর:







