বসিরহাট: ‘হাল নেই, হেঁতোল নেই, জগবন্ধু ডাক্তার’! বহু বছর ধরে প্রচলিত বাংলার এই বিখ্যাত প্রবাদ বাক্যটি। মূলত অল্প সরঞ্জামে বড় ধরনের কাজ করতে গেলে এই প্রবাদটি ব্যবহার করা হয়। হাল-হেঁতোল কী তা তো সকলেই জানেন। কিন্তু কে এই ‘জগবন্ধু ডাক্তার’? বাংলার অন্যতম প্রথিতযশা চিকিৎসক ছিলেন জগবন্ধু বসু। শুধুমাত্র একটি ব্লেডের সাহায্যেই দুরারোগ্য ব্যাধির অপারেশন এমনকি প্রসূতিদের সন্তান প্রসব নিপুণ হাতে করতেন জগবন্ধু বসু। তাঁর এইসব অসাধ্য সাধনের জন্যই তাঁর নামের সঙ্গেই মিলিয়েই এই প্রবাদটি রাখা হয়েছিল। যা আজও জনপ্রিয়। তিনি বসিরহাটের ঐতিহ্যবাহী বসুবাড়ির সন্তান। তাঁর নামেই বসিরহাটের বসুবাড়ি ‘ডাক্তারবাড়ি’ নামে পরিচিত।
পুজোর আর মাত্র কয়েকটা দিন! বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোয় মাতবে গোটা বাংলা। আধুনিক পুজোগুলির পাশাপাশি, প্রাচীন পুজোগুলিতেও সমানতালে চলছে মণ্ডপসজ্জার কাজ। তালিকায় রয়েছে ঠাকুর দালান মেরামতি, রং ও প্রতিমা তৈরির কাজ। ব্যতিক্রম নয় কলকাতার পাশ্ববর্তী বসিরহাটের প্রাচীন পুজোগুলোও। তার মধ্যে প্রাচীনত্বে অন্যতম বসিরহাটের দণ্ডিরহাটের বসুবাড়ির ‘কলার ছড়া’ দুর্গাপুজো। আজও দেবীর আরাধনার দিন অর্থাৎ মহালয়ার দিন থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বসুবাড়ির সদস্যরা হাজির হন নিজের বাড়িতে। ইতিহাস বলছে, এই পুজো শুরু ১৪৬০ থেকে ১৪৭০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে। যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্যের দ্বিতীয় স্ত্রীর বাবা ঈশ্বরীগুপ্ত বসু এই পুজোর সূচনা করেছিলেন। সেখান থেকেই আজও চলে আসছে এই পুজো।
আরও পড়ুন: বিষ্ণুপুরের ৩৫০ বছরের বনেদি দুর্গাপুজো, ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাক্ষী এই বনেদি বাড়ি
পরিবার সূত্রে খবর, তৎকালীন বাংলাদেশের মাহিনগর থেকে বর্তমান বসিরহাটের দন্ডিরহাটে স্থায়ী ঠিকানা হয় বসুদের। সেখানেই জমিদারি শুরু হয়। প্রথা মেনে পুজো শুরু করেন বসুরা। তবে প্রথম থেকেই এই পুজোর নাম ‘কলার ছড়া দুর্গাপুজো’ ছিল না। এই নামটির পিছনে রয়েছে এক কথকতা। জানা যায়, ১৭৯৩ সালে প্রতিমা তৈরির সময় মহামায়ার পিছনের ৮টি হাত বারবার ভেঙে যেতে থাকে। প্রতিমা তৈরির সময়ে পায়রা গিয়ে হাতগুলির উপর বসার ফলে সেগুলি ভেঙে যাচ্ছিল। তবে পায়রা কোনোভাবেই আটকানো যাচ্ছিল না। বহু চেষ্টার করেও প্রতিমার হাত ভাঙা কিছুতেই আটকানো যায়নি। শেষ মুহূর্তে সেগুলি মেরামতি করে তারপরেই পুজো করতে হয়। ১৭৯৩ থেকে ১৭৯৭ পর্যন্ত পাঁচ বছর এই একই ঘটনা ঘটতে থাকে।
শোনা যায়, ১৭৯৭ সালের পর তৎকালীন বসু পরিবারের প্রধান গোপাল লাল বসু স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন প্রতিমার ১০টি হাতের মধ্যে পিছনের ৮টি হাত ছোট করে দিতে। সেই মতো সামনের দুটি হাত প্রমাণ মাপের হলেও পিছনের ৮টি হাত ছোট করে দেওয়া হয়। স্বপ্নাদেশে প্রতিমার আটটি হাত বাকি হাতের তুলনায় ছোট হয়ে যায়। চিকিৎসক জগবন্ধু বসুর বাবা রাধামাধব বসু ছিলেন ঢাকার নবাবের বাংলাদেশের দেওয়ান। অধুনা মাহিনগর বসু পরিবারের খ্যাতি রাধামাধবের আমল থেকেই। জগবন্ধু বসুর মা বিন্দুবাসিনী দেবীর স্বপ্নাদেশে প্রতিমার আটটি হাত বাকি হাতের তুলনায় ছোট হয়ে যায়। প্রতিমার হাত ভাঙাও বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে চিরাচরিত প্রতিমা নির্মানের বৈশিষ্ট্য আজও চলে আসছে। হাত ছোট হয়ে যাওয়ার ফলে প্রতিমাকে দেখলে ওই ছোট হাতগুলিকে অনেকটা ‘কলার ছড়ার’ মত দেখায়। তাই তখন থেকেই বসু বাড়ির পুজোর প্রতিমার নাম হয়ে যায় ‘কলারছড়া দুর্গাপূজা’।
জমিদার বাড়িতে ভুরিভোজের আয়োজন ছিল। পুজোকে কেন্দ্র করে কালীপুজো পর্যন্ত বিরাট মেলা বসত। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও যাত্রাপালা হত। জমিদার বাবুরা নিজেরা যাত্রাপালায় অংশগ্রহণ করতেন। মহালয়ার আগে আজও নিয়ম করে বাগবাজার মায়ের ঘাট থেকে গঙ্গাজল আনা হয়। আগে গঙ্গাজল আসত নৌকায়, এখন আসে গাড়িতে। প্রতিপদের দিন ঘট বসানো হয়। পঞ্চমী থেকে নবমীর পাঁচ দিনে পাঁচটা পাঠা বলি হয়। একত্রিত হন বসু বাড়ির দেশ-বিদেশে থাকা সদস্যরা। চলে ভোগ বিতরণ।
বসু বাড়ির এই ঠাকুর দালানের সামনেই রয়েছে একটি বেল গাছ। সেই গাছে প্রতিবছরই ঠিক দুর্গা পুজোর সময়ে একটি জোড়া বেল পেকে ওঠে। সেই বেলই উৎসর্গ করা হয় দেবীর আরাধনায়। বনেদী বাড়ির এই পুজো কেন অন্যদের থেকে আলাদা? বসু পরিবারের এই পুজোর ইতিহাস অন্য আর পাঁচটা পরিবারের থেকে আলাদাই বটে। গল্পের ছলে সেই অতীতের ইতিহাস জানা গিয়েছে বসু পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম-এর সদস্য ও গ্রামবাসীদের কাছ থেকে।
বসুবাড়ির পুজোয় হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণের ব্যতিক্রমী নজিরও দীর্ঘদিনের। আজও বিসর্জনের দিন বসুবাড়ির দুর্গাদালান থেকে প্রতিমা বের করে নিয়ে যাওয়া হয় কয়েকশো মিটার দূরে ফুলবাড়ীর এক মুসলিম পরিবারের উঠোনে। সেখানে স্থানীয় রীতিনীতি মেনে হয় সিঁদুর খেলা! এরপর ওই মুসলিম পরিবারের এক সদস্য করাত দিয়ে প্রতিমার কাঠামো কেটে দেওয়ার পরে ১৬ জন বেয়ারার কাঁধে চাপিয়ে বিসর্জনের জন্য ইছামতীর ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় মাকে। সেখানেই হয় ভাসান।
দেখুন অন্য খবর