জোহরান মামদানি। বাবা মুসলিম, মা হিন্দু, বিখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্রকার মীরা নায়ার। নিউইয়র্কের মেয়র ইলেকশনে দাঁড়িয়েছিলেন, এবং হ্যাঁ, জিতেছেন। মামদানির এই জয় কিন্তু শুধুমাত্র নিউইয়র্ক বা আমেরিকার চৌহদ্দিতেই আটকে থাকেনি, গোটা দুনিয়ায় চর্চা চলেছে এই নিয়ে। অনেকেই এমনটা মনে করেছেন, ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বামপন্থী ধারার অন্যতম মুখ মামদানি আসলে জিতলেন দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে। আমেরিকায় যে দক্ষিণপন্থার মুখ ডোনাল্ড ট্রাম্প, আর ভারতে নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু কেন বলছি এসব? আজকের চতুর্থে কেন জোহরান মামদানি? সেকথা বলতে হলে, মামদানি ট্রাম্প আর নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে আরো দুএকটা কথা আগে বলে নিতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং নরেন্দ্র মোদিকে পাশাপাশি রেখে সমালোচনা করেছেন জোহরান মামদানি। মামদানির মতে, ট্রাম্প এবং মোদির রাজনীতি হরেদরে একই কথা বলে। দুজনেই চান কর্পোরেটদের সামনের সারিতে নিয়ে আসতে। দুজনেই জাতীয়তাবাদী। ট্রাম্পের জিগির হল ‘আমেরিকা ফার্স্ট’, আর মোদির ‘হিন্দুত্ববাদ’। দুটোর ফলেই সংখ্যালঘু অধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আরো একটা মিল আছে ট্রাম্প আর মোদির– দুজনেই বিরোধী শক্তিকে চেপে দিতে চান। কিন্তু এই একটা জায়গায় মোদিজি কিন্তু ট্রাম্পকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন।
কয়েকদিন আগেই এক প্রেস কনফারেন্সে হাজির ছিলেন ট্রাম্প আর মামদানি। সেখানে প্রেসের সামনেই মামমদানি ট্রাম্পকে ফ্যাসিস্ট বলেন। মামদানিকে মিডিয়ার প্রশ্ন ছিল, তিনি আগে বহুবার ট্রাম্পকে ফ্যাসিস্ট বলেছেন, এখন ট্রাম্পকে পাশে নিয়েও কি একই কথা বলবেন? মামদানি কিছু বলার আগেই কিন্তু মুখ খোলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি সরাসরি মামদানিকে বলেন, ‘হ্যাঁ বলে দাও। আমি কিছুই মনে করব না।’ এবং মামদানিও কিন্তু ট্রাম্পের সামনেই, অর্থাৎ আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সামনেই, প্রেস কনফারেন্সে ক্যামেরার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁকে ফ্যাসিস্ট বলে দিলেন। একে বলে গণতন্ত্র। মত প্রকাশের স্বাধীনতা। একে বলে হিউম্যান ভ্যালু অর্থাৎ মনুষ্যত্বের মর্যাদা। দুঃখের কথা এই, ভারতের গণতন্ত্রে এমন একটা খোলা হাওয়ার কথা আমরা আজো ভাবতে পারি না। আপনি কি ভাবতে পারেন, এখানকার কোনো প্রেস কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীকে বলছেন, ‘আরে, আপনি বলে দিন নরেন্দ্র মোদি ভোট চুরি করেন। আমি কিছুই মনে করব না।’ এবং রাহুলও বলছেন, ‘হ্যাঁ, মোদিজি ভোট চোর।’ না, আমদের দেশে, আমাদের গণতন্ত্রে এসব বোধহয় আশা করাও পাপ। কী আছে এখানে তবে? আছে নীরবতা। পাথরের মতো চুপ করে থাকা। বলব সেই কথা। ছোট একটা বিরতির পর।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | স্বাধীন, শিরদাঁড়া আছে, এমন সাংবাদিককে ভয় পাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি
প্রেস কনফারেন্সে মার্কিনী মিডিয়া নিউইয়র্কের মেয়র জোহরান মামদানিকে প্রশ্ন করছে, ‘আপনি কি আগের মতো এখনো ট্রাম্পকে ফ্যাসিস্ট বলবেন?’ মামদানি কিছু বলার আগেই পাশে বসা ট্রাম্প বলছেন, ‘হ্যাঁ বলে দিন। আমি কিছুই মনে করব না।’ আর মামদানিও বলছেন, হ্যাঁ, ট্রাম্প ফ্যাসিস্ট। ব্যাপারটা শুনতে যত সহজ লাগছে, আদতে ঠিক ততটা নয় কিন্তু। মামদানি যেমন ট্রাম্পকে ফ্যাসিস্ট বলেন, ট্রাম্পও কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে মামদানিকে ‘কমিউনিস্ট লুনাটিক’ বলে আক্রমণ চালিয়ে গেছেন। যে কারণে অনেকেই মনে করেছিলেন, ট্রাম্প-মামদানি বৈঠকে বেশ ভালোরকম গোলমাল হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে কী হল? দুনিয়া দেখল, আমেরিকার লোকতন্ত্র কোনো মুখের কথা নয়। বৈঠকের পর মামদানি জানান,“আমরা আমাদের মতভেদের জায়গাগুলো লুকোইনি। কিন্তু আমরা এটাও নজরে রেখেছি যে কোথায় কোথায় একসাথে কাজ করা যায়।” ট্রাম্পও পালটা জানিয়েছেন যে, তিনি মনে করেন, মামদানি ভালো কাজ করবেন।
আর আমাদের এখানে? অপারেশন সিঁদুর হোক বা আমেরিকান ট্যারিফ বা রাশিয়া থেকে তেল কেনা। মোদিজির মুখে কুলুপ। হাবভাব হল, আমি তো প্রধানমন্ত্রী, আমি কাকে কৈফিয়ত দেব? বাবা, মোদিজি কিন্তু কাউকে কৈফিয়ত দেন না। এটাই একটা বিজ্ঞাপনের ক্যাচ লাইন হতে পারে। অথচ একটা গণতান্ত্রিক দেশে প্রধানমন্ত্রীর, প্রেসিডেন্টের দায় থেকে যায় দেশের মানুষের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার। বিল ক্লিন্টন যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন এমনো হয়েছে, একদিনে সকাল থেকে টানা প্রেস কনফারেন্স করে গেছেন ক্লিন্টন। মুখোমুখি হয়েছেন ঝাঁকে ঝাঁক তিরের মতো প্রশ্নের। আরে, এটুকু তো করতেই হবে। তা নাহলে, দেশবিদেশ ঘুরে ঘুরে ফ্রেন্ডশিপ করাটা কি প্রধানমন্ত্রীর কাজ নাকি? গণতন্ত্রের ভার নিতে হবে তাঁকে। এমনকি তিনি যদি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ফ্যাসিস্ট হন তবুও। কেন না, গণতন্ত্রই তাঁকে নির্বাচিত করেছে। সে কথা ভুলে গিয়ে মনমানি চালানোটাই কিন্তু আসল ফ্যাসিবাদ, স্বৈরাচার, ঠিক যেটা নরেন্দ্র মোদি করছেন।
বলুক বিজেপির লোকেরা, বুকে হাত দিয়ে বলুক, আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ঠিক কটা সাংবাদিক সম্নেলন করেছেন? জবাব দিন, কেন করেননি। জবাব দিন, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে, তার উত্তর দিতে অমিত শাহকে এগিয়ে আসতে হয় কেন? ভারতের প্রধানমন্ত্রী কেন মুখে কুলুপ এঁটে ঘুরে বেড়ান? ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রধানমন্ত্রীর আগেই ভারত সম্পর্কে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন, তখনো মোদি চুপ থাকেন কেন? তিনি কি বোঝেন না, এতে দেশের চরম অপমান হচ্ছে। যারা বন্দে মাতরম নিয়ে লাফান, তারা এটুকু জানেন না, দেশ মানে মা। সেই মাকে বিদেশি অপমান করছে, আর প্রধানমমন্ত্রী চুপ! কেন? কেন? ইতনা সন্নাটা কিঁউ হ্যায় ভাই? কিন্তু এভাবেই চলছে। আমেরিকায় ট্রাম্প-মামদানি একসাথে কাজ করার কথা ভাবছেন। দু’জনই বাড়ি ভাড়া, খাবারের দাম এবং জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে একসাথে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিউইয়র্কের প্রতি দু’জনের ভালোবাসা নিয়েও তারা কথা বলেছেন। ট্রাম্প বলেন, “আমরা অনেক বিষয়েই একমত হয়েছি, যা ভাবতে পারিনি।” সব থেকে বড় কথা, প্রেসমিডিয়ার তীব্র প্রশ্ন থেকে ট্রাম্প নিজে মামদানিকে কয়েকবার আড়ালও করেন। এমনটা হবে? আমাদের এখানে? আমরা কি দেখতে পাব, মোদিজি আড়াল করছেন রাহুল গান্ধীকে? কাজ করছেন একসাথে? কী করে হবে? রাহুল তো কতবার বৈঠকের কথা বলেছেন। জবাব পেয়েছেন তার? মুশকিল হল, মানুষকে শেষমেশ জবাব দিতেই হয়। ইতিহাসের কাছে জবাবদিহি করতেই হয়। মোদিজিকেও হবে। দুদিন আগে আর পরে।







