যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন।
বহুদিন আগে সেও ছিল এক সিপিএম রাজ্য সম্মেলন, আমাদের এক সিনিয়র সাংবাদিক, নামটা বলেই ফেলি, প্রয়াত দেবাশিস ভট্টাচার্য, তিনি দফতরে এসেই বললেন যে রাজ্য কমিটির নামের লিস্ট দেখেছ। বিজ্ঞ ও সর্বজ্ঞ সাংবাদিকের মতোই আমি বললেম সে তো গতকাল রাতেই পেয়ে গেছি। তো তিনি বললেন কী বুঝলে। আমি আমার জ্ঞানের ভান্ডার উজাড় করে দিয়ে জানালাম কে কে বাদ গেছে কারা কারা নতুন এলেন, কাদেরকে বাদ দিয়েও আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে রাখা হল ইত্যাদি। তো তিনি বলেছিলেন, ব্যাপারটা অত সোজা নয়। আগেরবারের তালিকা বের করে মিলিয়ে নাও কার নাম তালিকাতে কত নম্বরে ছিল, এবারে সেটা উঠে এসেছে? না নেমে গেছে? হ্যাঁ কমিউনিস্ট পার্টির তালিকাতে এটাও একটা ব্যাপার। আবার অন্য দলের ক্ষেত্রে নেতা, নেত্রীর ছবি কত বড়, কোথায় আছে, কার সঙ্গে আছে সেগুলোই সব থেকে জরুরি এটা বোঝার জন্য যে সেই নেতা-নেত্রী এখন কোন অবস্থায় আছেন। এখন অবশ্য কিছু মিশেল ঘটছে, যেমন এই সিপিএম রাজ্য সম্মেলনের আশে পাশে দেখা গেল ক্যাপ্টেন মীনাক্ষীর ছবি, না শতরুপ বা সুজন বা রবীন দেবের নয়, ছবি সেলিমের, ছবি ক্যাপ্টেন মীনাক্ষীর, কাজেই এখন দেখছি কেবল অন্য দলেই নয় সিপিএম এও ছবির রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য সিপিএমে এই ছবির রাজনীতির সূত্রপাত করেছিলেন কমরেড সেলিম, হঠাৎ পার্ক সার্কাস থেকে বাই পাস সেলিমের ছবি ঝোলানো হয়েছিল, দলের নির্দেশে, অনিল বিশ্বাসের নির্দেশে তা আবার নামানো হয়েছিল। অন্য কথায় যাওয়ার আগে, সিপিএম সম্মেলন নিয়ে আরও কয়েকটা কথা। এবারের সিপিএম রাজ্য কমিটির তালিকায় বাদ যাঁরা পড়েছেন তারমধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হলেন বিকাশ ভট্টাচার্য, তাঁর শারিরীক সক্ষমতা দেখার মতন, তিনি এখনও রাজ্যসভা সদস্য, তিনি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সিপিএমের জনসভায় জনপ্রিয় বক্তা, চাকরি থেকে অভয়া আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা আমরা দেখেছি। কিন্তু তিনি ৭৩ এ পা দিয়েছেন বলেই বাদ? আমন্ত্রিত রাজ্য কমিটির সদস্যের তালিকাতেও তাঁর নাম নেই, শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি বিরক্ত আর তাঁকে নিয়ে নাকি বিরক্ত সিপিএমে ইয়ং ব্রিগেড, সেই কারণেই বিকাশবাবু নাকি নিজেই অব্যাহতি চেয়েছেন, আপাতত তিনি পার্টি কংগ্রেসের ডেলিগেট তালিকাতেই শুধু আছেন, তারপরে তিনি রোজকার কাজে থাকবেন না, প্রয়োজনে আইনি সহায়তা দেবেন, এমনই নাকি তিনি দলকে জানিয়েছেন। ২২ জুলাই ২০২০ তিনি রাজ্যসভা সদস্য হয়েছেন, সেই হিসেবে আগামী ২০২৬ জুলাই পর্যন্ত তিনি সদস্য থাকবেন। মানে উনি একজন সিপিএম সাংসদ হিসেবেই ২০২৬ এর রাজ্য নির্বাচনে থাকবেন। এরপরেও তাঁকে রাজ্য কমিটিতে না রাখা, এমনকী আমন্ত্রিত সদস্যও না রাখাটাই এবারের রাজ্য কমিটি গঠনের সবথেকে উল্লেখযোগ্য খবর। তো সে কথা থাক, আমরা বরং ওই ছবির রাজনীতিতে ফিরি।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | মোদিজির আমেরিকা যাত্রা, শুভেন্দু অধিকারীর দিল্লি যাত্রা!
ইন্ডোর স্টেডিয়ামে নেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি, যা ছিল গতবারে। সেই সম্মেলনে সহাস্য নেত্রী এবং অভিষেকের ছবি বলে দিয়েছিল পরবর্তী নেতৃত্বের কথা, হিসেব বুঝে নিয়েছিলেন দলের কর্মী, ছোট মেজ, সেজ বড় নেতারা। কেউ কেউ আগামীর দিকে একটু বেশি ঝুঁকে আগাম বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করছিলেন, কেউ কেউ তত তাড়াহুড়ো না করলেও একটু দূর থেকে জল মাপছিলেন, এক্কেবারে সেই কবেকার, সেই শুরুর দিকের মমতা অনুগামী নেতা আর তাঁদের অনুগামীরা অবশ্য বোঝার চেষ্টা করছিলেন সমীকরণটা।
২০২৪ শেষ হয়েছে, রাজ্যে বিজেপি প্রায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন, তবুও আবার রণদামামা বেজে উঠেছে ভোট ভোট আবার ভোট, ২০২৬-এর কুরুক্ষেত্র। এবং এইখানে এসেই আটারলি কনফিউজড কেবল সাংবাদিকরা নয়, জ্ঞানী পণ্ডিত মমতার অত্যন্ত কাছের সাংবাদিক বলে যাঁরা নানান সুখ সুবিধে পেয়ে থাকেন, প্লেনের টিকিট থেকে ফাইভ স্টার গেস্ট হাউস বা আরও কিছু, তাঁরাও কনফিউজদ। হচ্ছে টা কি? কনফিউজড দলের মেজ সেজ ছোট বড় নেতারাও, ইকুয়েশনটা যে ঠিক কী? ক’জনই বা তা জানেন। সব মিলিয়ে তলার কর্মীরাও খানিক বিপন্ন, মমতা ব্যানার্জি জিন্দাবাদ তো ঠিকই আছে, তারপরে এক নিঃশ্বাসেই যে অভিষেকের নাম আসত, তিনি তো সম্মেলনের ছবিতেই নেই, তাহলে? এটা ঠিক যে তৃণমূল দল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল, এ দলে সব্বাই জানেন যে পোস্ট একটাই বাকি সব আখাম্বা ল্যাম্পপোস্ট। কিন্তু তবুও সেই যুবার উত্থানের সময় থেকে দু’ নম্বর আসনটা তো ছিল অভিষেকের। তিনি ২০২৪-এ দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারপর থেকে আজ অবদি প্রকাশ্যে একটাও দলবিরোধী কথা বলেছেন এমনটাও নয়, পিসি ভাইপোর বিরাট ঝামেলা জানিস তো… কিন্তু আজ অবধি মিডিয়ার সেই আমোদগেঁড়ে আলোচনায় কোনও তথ্য এনে হাজির করা হয়নি, তাহলে? ১) এ এক স্ট্রাটেজি, বংশানুক্রমিক শাসন ইত্যাদি অভিযোগের জবাব। ২) কেমন করে চলবে তৃণমূল, সেই খেরোর খাতা হাতে আদ্যিকালের রাজনৈতিক দল হিসেবে নাকি তার এক কর্পোরেট লুক হবে সেই মতানৈক্য? ৩) দলের মধ্যের যে সমস্ত পাওয়ার সেন্টার গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল, যে ফাঁকফোকর দিয়ে আর একটা শুভেন্দুর জন্ম হতে পারত, তা এক্কেবারে সিল করে দেওয়া হল। ৪) এক অধৈর্য উচ্চাকাঙ্ক্ষার রাজনীতি, যা সামলাচ্ছেন নেত্রী। এই সব সম্ভাবনার মধ্যে আমি বাজি ধরছি প্রথমটায়, এ এক সুচিন্তিত স্ট্রাটেজি, এক পরিকল্পনা, ২০২৬-এর ঢাক বাজলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে, হ্যাঁ এটা আমার মতামত। আপনি কী ভাবছেন?