৫০০ দিনের বেশি হয়ে গেল জেএনইউর মেধাবী ছাত্র সমেত একদল যুবক যুবতী জেলে, এঁদেরকেই মোদি অমিত শাহ বহুদিন ধরেই টুকরে টুকরে গ্যাং বলেই চলেছেন। না এঁরা জামিন পান নি। কিন্তু নাথুরাম গডসে কে, গান্ধী হত্যাকারীকে দেশপ্রেমিক বলা চরম দেশ দ্রোহী কিন্তু ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। সোনম ওয়াংচুক অনশন করছিলেন, যে সময়ে নেপালের ঘটনা ঘটে, তিনি ওখান থেকেই স্পষ্ট বলেছিলেন যে ভারত নেপাল নয়, এখানে অমন নৈরাজ্য সম্ভব নয়, উচিত নয়। কিন্তু লেহ, কার্গিল জুড়ে মানুষের ক্ষোভ দেখা গেল, তারপরে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এ গ্রেফতার করে জেলে পোরা হয়েছে সোনম ওয়াংচুক কে, যিনি দেশের জওয়ানদের জন্য ওই সাব জিরো টেম্পারেচারে গরম বাঙ্কার বানানোর ডিজাইন টা তৈরি করেছেন। এখন তিনি দেশের কাছে বিপদ, হ্যাঁ মোদি শাহ সেই কথাই বলছে, তিনি জামিন পান নি। আদালত নির্দেশ দিচ্ছে আদানীর বিরুদ্ধে কিছু বলাই যাবে না। যে আইনে আটকে যাচ্ছে আদানির কারখানা সেই আইনকেই বদলে দেওয়া হচ্ছে। তার মানে কি এটাই যে আইন আদালত আজ সবটাই আরএসএস – বিজেপির হাতে? হ্যাঁ এই প্রশ্ন তো উঠছে। আরও উঠছে কারণ একের পর এক বিচারপতির বিভিন্ন কাজকর্ম দেখে।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বাংলো পেয়ে থাকেন, অবসর নিলে সেই বাংলো ছেড়ে দিতে হয়। হ্যাঁ লুটিয়েন দিল্লির মাঝবরাবর অমন বাংলো তো ভারা দিলেও পাওয়া যায় না। তো আমাদের প্রাক্তন বিচারপতি চন্দ্রচূড় জানালেন যে তিনি ছেড়ে দেবেন কিন্তু কিছুটা সময় চান, তাঁর এই আবেদন শুনে মনে হয়েছিল তিনি সত্যিই কিছু অসুবিধেতে আছেন, সময় চাইছেন, কিন্তু মাথাতে ঘুরছিল যে ইনিই তো সব নৈতিকতা কে একপাশে রেখেই ঘরে ডেকে এনেছিলেন নরেন্দ্র মোদিকে (Narendra Modi)। কিন্তু তাঁর এই আবেদন যে আদতে টাইম কিলিং, মানে সময় কাটানো তা বোঝা গেল কদিন আগেই সরকারের ঘোষণায়, নতুন বাংলো দেওয়া হল তাঁকে, আমি নিশ্চিত, মিলিয়ে নেবেন এরপরে তাঁকে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হবে। এবার আবার প্রতিদান দেবার পালা। বাবরি মসজিদের তৈরি করাটাই এক অপবিত্র কাজ। মন্তব্য করলেন সুপ্রিম কোর্টের (Supreme Court) প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। মানে খুব পরিস্কার করে বললে তিনি দেশের কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের সুরেই বলতে চেয়েছেন, একটা মন্দির ভেঙেই মসজিদ তৈরি হয়েছিল, এবং তাই শুরু থেকেই তা ছিল অপবিত্র। আর হিন্দুরা যখন মনেই করছে যে সেই বাবরি মসজিদ অপবিত্র তাহলে তাকে ভাঙাই ঠিক হয়েছে। ৯ নভেম্বার তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের যে বেঞ্চ বাবরি মসজিদ- রামজন্মভূমি জমি বিতর্ক মামলায় রায় দিয়েছিল, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন এই চন্দ্রচূড়। সুপ্রিম কোর্টের ২০১৯ সালের অযোধ্যা রায়ে বলা হয়েছিল- মসজিদের নিচে একটা হিন্দু স্থাপত্যের উপাদান নিশ্চই পাওয়া গেছে, তবে তা এক মন্দির ছিল কি না, বা মসজিদ নির্মাণের জন্য ওই কাঠামোটি ধ্বংস করা হয়েছিল কি না, তা প্রমাণিত করার মত যথেষ্ট উপাদান মেলেনি, মানে ওই রায়ে সেই সত্য প্রতিষ্টিত হয়নি যা দেশের হিন্দুত্ববাদীরা দীর্ঘদিন ধরে প্রচার করেছে যে এক মন্দির ভেঙেই তৈরি হয়েছিল এই বাবরি মসজিদ। না হয়নি। মসজিদের নির্মাণ ষোড়শ শতকে হয়েছিল আর তার নিচের কাঠামোর সময়কাল দ্বাদশ শতক, এর মধ্যে ৪০০ বছরের ব্যবধান রয়েছে। এই দীর্ঘ ব্যবধানে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে কোনও প্রামাণ্য তথ্যই নেই। হ্যাঁ এসব কথা বলা হয়েছে ওই রায়ে, তবুও ঐ রায়েই এই জমি, মানে বাবরি মসজিদ ভাঙা জমি দেওয়া হয়েছে হিন্দুদের রাম মন্দির বানানোর জন্য আর দূরে জমি দেওয়া হয়েছে এক মসজিদ বানানোর জন্য মুসলমান সংগঠনকে। কেন? কারণ ওই রায়েই বলা হয়েছে বাবরি মসজিদ অন্যায় ভাবেই ভাঙা হয়েছে। তাহলে সেখানে মন্দির কেন হবে?
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | দেশে অসুর শক্তির বিরুদ্ধে চাই মা দুর্গাকে, নতুন করে অসুরবধ প্রয়োজন
কারণ হিন্দু, কোটি কোটি হিন্দু মনে করে যে ওটাই রাম জন্মভূমি। মানে প্রমাণ নয়, ব্যাপারটা আস্থার। আজ এতদিন পরে এক ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সুপ্রিম কোর্টের সর্বোচ্চ বিচারপতি নিজেও জানিয়েই দিলেন যে ঐ বাবরি মসজিদ তৈরি করাটাই ছিল এক অপবিত্র কাজ। পৃথিবীর মানুষের কাছে হিন্দু ধর্মকে যিনি নিয়ে হাজির করলেন সেই হিন্দু চুড়ামণি স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন ‘জগন্নাথ মন্দির একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির। আমরা ঐটিকে এবং অন্যান্য বৌদ্ধ মন্দিরকে হিন্দু মন্দির করিয়া লইয়াছি।’ “To any man who knows anything about Indian history, the temple of Jagannath is an old Buddhistic temple. We took this and others over and re-Hinduised them. We shall have to do many things like that yet.” কোথায় বলেছেন? ‘The Sages of India’ । এটা তাঁর বিখ্যাত ‘Lectures from Colombo to Almora’ সংকলনের অংশ The Complete Works of Swami Vivekananda (CW), Volume 3-এর 264 পাতায় পেয়ে যাবেন। হ্যাঁ বিবেকানন্দ বলেছেন। তাহলে এখন আমাদের কী করা উচিত? জগন্নাথ মন্দির ভেঙে বৌদ্ধ মন্দির তৈরি করা উচিত? কে কাকে অপবিত্র করেছে? প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ জানিয়েছে, বাবরি মসজিদের নীচে একটা অ-ইসলামি কাঠামো ছিল তবে তা মন্দির কিনা তা বলা হয়নি। আদালত জানিয়েছে, ফাঁকা জমিতে বাবরি মসজিদ তৈরি হয়নি, সেখানে অন্য কিছু ইমারত ছিল, তবে তা ইসলামি স্থাপত্য নয়। অ-ইসলামীয় স্থাপত্য হলে সেটা কী, শৈব না বৈষ্ণব, নাকি বৌদ্ধ অথবা ইহুদি-খ্রিস্ট ধর্মের ইমারত তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। পুরাতত্ত্ব সার্ভের যে প্রতিবেদন সুপ্রিম কোর্টে পেশ করা হয়েছে তা নিয়ে আইএসআই-এর খননকার্যের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞদের মতের বিস্তর ফারাক রয়েছে। সে নিয়ে অনেক লেখালেখিও হয়েছে। বহু ঐতিহাসিক মনে করেন, যেখানে বাবরি মসজিদ তৈরি হয়েছে তা সম্ভবত ছিল এক বৌদ্ধ মঠ। অযোধ্যা বিশেষজ্ঞ রোজি এল জোন্স প্রমুখ ইতিহাসবিদ এমন কথা লিখেছেন। আন্তর্জাতিক মানের ইতিহাসবিদেরা এমন কথাও জানিয়েছেন যে মসজিদের নীচে মসজিদই ছিল, তবে তা ছোটো কাঠামোর। অর্থাৎ প্রথম স্তর যদি বাবরি মসজিদ হয় তবে দ্বিতীয় স্তর হল সুলতানি আমলের মসজিদ যার সময়কাল ত্রয়োদশ শতক থেকে ষোড়শ শতক। তারও নীচে ছিল শৈব মন্দির, রাম মন্দির নয়—সেটা তৃতীয় স্তর। ইতিহাসবিদরা জানিয়েছেন, এই যে সাম্প্রতিক কালের রাম কাল্ট তা শুরু হয়েছিল আকবরের সময়, তুলসীদাস গোস্বামীর রামচরিতমানস থেকে। তার আগে উত্তর ভারতে ছিল শৈব ধর্মের প্রাধান্য। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হরিশ ত্রিবেদীর গবেষণা থেকে জানা যায়, তুলসীদাস যখন রামচরিতমানস লিখছিলেন তখন তিনি একটা মসজিদে আশ্রয় নেন, কেন? কারণ ব্রাহ্মণ্যবাদী সনাতনিরা সংস্কৃত, দেবভাষার বদলে ছোটলোকদের মুখের ভাষা মগহিতে রামায়ণ লেখা হচ্ছে শুনে ক্ষেপে গিয়েছিলেন আর সেটা ছিল সম্ভবত অযোধ্যার বাবরি মসজিদ। অথচ রামেরই নামে সেই মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে রাজনীতির কারবারিরা। আর চন্দ্রচূড় আজ যে কথা বললেন তাও অবশ্য খুব অবাক করে দেবার মত কিছু নয়, কারণ এর আগে তিনি বলেছিলেন, ঈশ্বরের সামনে বসেই তিনি অযোধ্যা মামলার রায় খুঁজে পেয়েছিলেন। ভাবুন একবার, আইনের বই ঘেঁটে নয়, সংবিধানের পাতায় নয়, চিফ জাস্টিস মামলার রায়ের সঠিক হদিশ পান ঈশ্বরের সামনে বসে। তাবে ওনার বক্তব্যে আরও একবার সেই সত্য আমাদের সব্বার সামনে যে, অযোধ্যা মামলার রায় তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে নয়, আস্থা বা বিশ্বাসের ভিত্তিতেই দেওয়া হয়। চন্দ্রচূড় ওনার সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক শ্রীনিবাসন জৈনকে বলেছেন আই কোট, “আপনি যখন বললেন যে হিন্দুরাই ভিতরের প্রাঙ্গণে অপবিত্রকরণ করছিল, তাহলে মসজিদ নির্মাণটাই যে মূল অপবিত্রকরণের কাজ সেটা কী হবে? আপনি কি ভুলে গেলেন ইতিহাসে কী ঘটেছিল? আমরা কি ইতিহাসে যা ঘটেছে, সব ভুলে যাব? যখন আপনি মেনে নেন যে ইতিহাসে এই ঘটনা ঘটেছিল এবং আমাদের হাতে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণও আছে তখন কীভাবে আপনি চোখ বুজে থাকতে পারেন? তাই আপনি যে বিশ্লেষকদের কথা বলছেন, তারা ইতিহাসকে খণ্ডিতভাবে ব্যাখ্যা করছেন। তারা ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ের আগের ঘটনাকে উপেক্ষা করেন, তার প্রমাণকে এড়িয়ে যান এবং কেবল তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক প্রমাণের দিকেই তাকাতে শুরু করেন।” আন কোট।
একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সেই কথা যা বিজেপির তাবড় বড় নেতা বহুবার বলেছেন, বলেন। তাদের মোদ্দা কথা এটাই যে, অতীতের ভুলকে এখন ঠিক করতে হবে। তাই অযোধ্যা, কাশী, মথুরা সহ হাজার হাজার মন্দির যা মুসলিম আক্রমণকারীরা ধ্বংস করে মসজিদ বানিয়েছে বলে তারা দাবি করে, তা এখন ভেঙে ফের মন্দির তৈরি করতে হবে। মহামান্য চন্দ্রচূড় সাহেব এখন নিজেই স্বীকার করছেন যে তিনি বাবরি মসজিদের অস্তিত্বকেই ‘অপবিত্রতা’ হিসাবে দেখতেন, মানে তাঁর ধর্মে আস্থাই এক্ষেত্রে রায়ের ভিত্তি, আইন নয়। তিনি আইন বা প্রমাণের ভিত্তিতে নয়, বিশ্বাসের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তখন সেটা রায়ে লিখে বলতে পারেননি। এখন তিনি যা বলেছেন, তাতে আসল সত্য প্রকাশ পেয়ে গেছে। একবিংশ শতকেও ভারতের আদালতে একটা মামলা চলল যেখানে পুরাণকে ইতিহাসের থেকেও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হল। পৌরাণিক নায়ক রামলালা মামলা লড়লেন এবং জিতলেনও। বিশ্ব দেখল, মিথের জয়– ইতিহাসকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে, শুধুমাত্র অন্ধ বিশ্বাসের দোহাই দিয়ে। বিশ্বাস ও জ্ঞানের যে মূল পার্থক্য তা হল প্রথমটাতে কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকে না, দ্বিতীয়টাতে পর্যাপ্ত যুক্তি থাকে। আধুনিক জ্ঞানতত্ত্ব ও যুক্তিবিজ্ঞান এই কথাটাই বলে, সর্বতোভাবে মানে। কিন্তু আদালত, যেখানে যুক্তিপূর্ণ তর্কই আশ্রয়বাক্য হওয়া উচিত এবং সেই থেকে অনিবার্য সিদ্ধান্ত বের হয়ে আসার কথা সেখানে যুক্তিকে কোনও স্থানই দেওয়া হল না। বিশ্বাসই হয়ে উঠল মুখ্য। চন্দ্রচূড় সাহেব যা বললেন সেই আস্থা আর বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে হত্যা, রাহাজানি, ডাকাতি থেকে চুরি সবই কোনও না কোনওদিন আইনের নাগালের বাইরে চলে যাবে, সভ্য সমাজে যা হওয়া উচিত নয়।এবং এতা ক্রমশ পরিস্কার হয়ে আসছে যে বিচার ব্যবস্থার মধ্যে কোথাও তো পচন ধরেছে, ফাদার অফ ডেমোক্রাসির সক্রিয় ব্যবস্থাগুলো ক্রমশ গিলে খাচ্ছে বিচার ব্যবস্থাকেই।