জয়নগর: ঘাসের আগায় শিশির বিন্দু আর শিউলি ফুলের গন্ধে আকাশে বাতাস ভরে উঠেছে। শরতের মেঘ আর কাশফুলকে সাক্ষী রেখে উমা আসছে বাপের বাড়িতে। দেবী দুর্গার আগমনের আনন্দে চারিদিক সেজে উঠছে। হাতে আর মাত্র ৯ দিন! এই মুহূর্তে প্রতিমা গড়ার কাজে চরম ব্যস্ত মৃৎশিল্পীরা। আর দুর্গাপুজোর সঙ্গে বনেদি বাড়ির ইতিহাস মিলেমিশে একাকার হয়ে রয়েছে। তেমনই জয়নগরের মিত্র বাড়ির দুর্গাপুজোর (Jaynagar Mitrabari Durga Puja) সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অলৌকিক সব কাহিনী। কথিত আছে, জয়নগরের মিত্র বাড়িতে দুর্গাপুজোর সূচনা করেন স্বয়ং দেবী দুর্গা (Maa Durga Started Durga Puja)। দেবীর স্বপ্নাদেশে শুরু হয় দুর্গাপুজো (Durga Puja)।
শোনা যায়, স্বয়ং মা দুর্গা সাধারণ মহিলার বেশে ধরা দিয়ে জমিদার বাড়ির গৃহকর্তা অন্নদাপ্রসাদ মিত্রের স্ত্রী ভুবনমোহিনী মিত্রকে পুজো শুরু করার কথা বলেন৷ প্রায় কয়েক শতাব্দী ধরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরের মিত্র জমিদার বাড়িতে পুজো হয়ে আসছে৷ প্রায় ৩৫১ বছরেরও বেশি পুরনো মিত্রবাড়ির দুর্গাপুজো৷ জমিদারি প্রথা না থাকলেও অতীতের নিয়ম মেনে প্রতি বছর পুজো হয়।
এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অদ্ভুত কাকতালীয় ঘটনা। সাধারণত শরৎকালে কাঁঠাল দেখা যায় না। কিন্তু প্রতিবছর জয়নগরের মিত্র বাড়িতেই ঘটে সেই কাকতালীয় ঘটনা! বাড়ির একটি কাঁঠাল গাছে দুর্গাপুজোর সময় কাঁঠাল ফলবেই৷ সেই কাঁঠাল সন্ধি পুজোয় নৈবেদ্য হিসাবে মা দুর্গাকে নিবেদন করা হয়। অন্যদিকে, জমিদার বাড়ির বিশাল ঠাকুর দালানে জন্মাষ্টমীতে কাঠামো পুজোর দু’দিন পর থেকেই মূর্তি তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়৷ তৎকালীন সময়ে জমিদারির সুবাদে সুন্দরবনের কাকদ্বীপ, জয়নগর, কুলতলি, গোসাবা, নামখানা, রায়দিঘি, মথুরাপুর ইত্যাদি এলাকাজুড়ে জমিদারি প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার করেছিল মিত্ররা ।
জানা গিয়েছে, অতীতে জমিদার বাড়িতে প্রজারাই পুজোর যাবতীয় জিনিসপত্র পাঠাতেন। পুজোর ক’দিন ভিড়ে গমগম করত মিত্রবাড়ি৷ কিন্তু, জমিদারির অবসান ঘটার পর অতীতের জৌলুস হারিয়েছে মিত্রবাড়ির পুজোতে। এখনও প্রাচীন নিয়ম মেনে জন্মাষ্টমীতে কাঠামো পুজো ও মহালয়ায় দেবীর চক্ষুদান করা হয়। পূর্বে সাতটি করে পাঁঠাবলির ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে দুটি করে পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। বাড়ির সামনেই সুবিশাল জলাশয়ে কলা-বৌ স্নান থেকে শুরু করে প্রতিমা বিসর্জন সবটাই হয়ে থাকে। কর্মসূত্রে পরিবারের সদস্যরা ভিনরাজ্যে ও ভিনদেশে থাকলেও, পুজোর চারদিন সকলে বাড়ি ফেরেন৷ বংশ পরম্পরায় মৃৎশিল্পীরা মিত্রবাড়িতে প্রতিমা গড়েন৷ প্রতিবছর বহু মানুষ ভিড় জমান জমিদার বাড়ির এই পুজো দেখতে।
আরও পড়ুন: মহানগরের মহাপুজো, ৬৬ পল্লী
মিত্র পরিবারের সদস্য শুভেন্দু মিত্র তিনি জানান, জমিদারি পতনের পর ধীরে ধীরে পুজোর জৌলুস কমে গিয়েছে। যদিও জৌলুস কবে গেলেও নিয়ম নিষ্ঠায় কোনও ভাটা পড়েনি। এখনও বলিদান প্রথা রয়েছে। আগে প্রতিদিনই বলিদান হত। এখন দুটি করে বলিদান হয়। এছাড়াও এই পুজোর ১৭ দিন চলে। এক সময় পুজোয় প্রতিদিনই মোষ বলি হত। পরে মোট ৯টা পাঁঠা বলি হত।
তবে এখন মাত্র দুটো বা তিনটে পাঁঠা বলি দেওয়া হয়।
তিনি আরও জানিয়েছেন, এই বাড়ির পুজোতে কোনও অন্নভোগ হয় না। পরিবর্তে লুচি, ফল বা মিষ্টির ভোগ দেওয়া হয়। বর্তমান প্রজন্ম অতীতের সেই জৌলুস ধরে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছি আমরা। পুজোর আগে আমাদের এই জয়নগরের মিত্র বাড়িতে পরিবারের সদস্যরা চরম ব্যস্ত। ঠাকুরদালান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থেকে শুরু করে পুজোর অন্যান্য সামগ্রী এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগাড় জান্তি করতে ব্যস্ত। ভক্তি ও নিষ্ঠা মেনে এখনও এই পুজোর চালাই আমরা।
এ বিষয়ে মিত্র পরিবারের সদস্য শিউলি ঘোষ জানান, পুজোর কয়েকটা দিন এই পরিবারে মহিলারা চরম ব্যস্ত থাকে। এমনকি এখন থেকেই ব্যস্ততা শুরু হয়ে গিয়েছে আমাদের। পুজোর সময় নাড়ু থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম মিষ্টি বানাতে হয় আমাদের। এখানে জন্মাষ্টমীর পরের নবমীতে বোধন শুরু হয়৷ তখন থেকেই ব্যস্ততার শুরু৷ সেই নবমী থেকে বিজয়া দশমীর আগের নবমী পর্যন্ত প্রতিদিন ৪০টা করে বেলপাতা দিয়ে দেবীর পুজো হয়৷ বলতে গেলে, এখানে পুজো চলে প্রায় ১৭ দিন ধরে৷
দেখুন অন্য খবর