Wednesday, August 27, 2025
HomeScrollFourth Pillar | মোদিজি ঘরে বাইরে খুব দ্রুত তাঁর গুরুত্ব হারাচ্ছেন

Fourth Pillar | মোদিজি ঘরে বাইরে খুব দ্রুত তাঁর গুরুত্ব হারাচ্ছেন

একজন প্রধানমন্ত্রীই সব তালার চাবি হতে পারেন না

সেদিন একটা ছবি দেখলাম, বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে আমাদের নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদিজির। সামনে নীতিন গড়করি ছিলেন, হেঁ হেঁ তো বাদই দিন, গড়কড়িজি হাতজোড় করে নমস্কারটুকুও করলেন না। হ্যাঁ, ২০১৪ সেই হিন্দু হৃদয় সম্রাট মোদিজি ঘরে বাইরে তাঁর গুরুত্ব হারাচ্ছেন। খুব দ্রুত তাঁর উচ্চতা কমে আসছে দ্রুত ক্ষয় হচ্ছে তাঁর সেই জনমোহিনী ক্যারিশমা। এমনিতে আপনার মনে হত এক লৌহমানব, এক কঠিন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সরকার, এক সর্বব্যাপ্ত ক্ষমতার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু তলিয়ে দেখুন অত্যন্ত মিডিওকার এক রাজনৈতিক নেতার চেয়েও বেশিবার নিজের অবস্থা বদলেছেন, নিজের বলা কথা থুতু দিয়ে গিলে নিয়েছেন। আজ নয় সেই শুরু থেকেই। ২০১৪-তে নরেন্দ্র মোদির সরকার, প্রথম দিন থেকেই নয়, তার আগেও নির্বাচনের সময় ওই গোটা ক্যাম্পেন জুড়েই মোদিজির ইমেজ বানানো হয়েছে, মিডিয়াকে কাজে লাগানো হয়েছে, এক লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ, ভারতের নয়া যুগাবতার, হিন্দু হৃদয় সম্রাট। ব্যস, প্রথম দিন থেকেই আমাদের রাজনৈতিক কাঠামো বদলে যেতে থাকল, কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা গেল এমনকী আদবানি, জোশি, উমা ভারতী, অরুণ জেটলি বা সুষমা স্বরাজেরা নেহাতই বামন, ছোট থেকে আরও ছোট হতে থাকা পুতুল। দলের শীর্ষ নেতাদের গিলে ফেলার পরেই মোদিজি মন দিলেন রাজ্যের দিকে, তাকিয়ে দেখুন বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মধ্যে দু’জন মুখ্যমন্ত্রীর নাম দেশের লোক জানেন, আদিত্যনাথ যোগী আর হিমন্ত বিশ্বশর্মা, ব্যস। আর কারও নাম নেই, আর কোনও গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য নেতা নেই, সবটাই নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি।

একজন বিতর্কিত রাজ্যপালকে উপরাষ্ট্রপতি করা হল, তিনি পদত্যাগ করলেন, তাঁর বদলে যিনি এলেন, তাঁরা নাম ক’জন জানতেন, কিন্তু জানা গেল নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং এই নাম প্রস্তাব করেছেন। গুগল না করে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী বা উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর নাম বলুন তো? আর রাজ্য নেতাদের নাম? ক’জন জানেন, গোটা দল বসে আছে মোদিজি কব আয়েঙ্গে। কিন্তু তিনি তো করণ-অর্জুন নন, ক্ষয়ে যাচ্ছে তাঁর ধার। একজন প্রধানমন্ত্রীই সব তালার চাবি হতে পারেন না। তিনি প্রধানমন্ত্রী, তিনিই রেল উদ্বোধনে যাবেন, বেশ একটা কোনও বা দুটো গুরুত্বপূর্ণ উদ্বোধনে যাবেন, ইনি সর্বত্র, সব উদ্বোধনে হরা ঝান্ডা নিয়ে হাজির। এবং এক্কেবারে পিএমও-র নির্দেশে তারপরের দিন খবরের কাগজে হাতে ঝান্ডা নিয়ে ওই একজনেরই ছবি। স্বাধীনতার পর থেকে যাবতীয় উদ্বোধন অনুষ্ঠানের ছবি দেখুন, সেখানে জননেতা মানুষের সান্নিধ্য এনজয় করেন, ইনি একলা এক আমি সর্বস্য মেগালোম্যানিয়াক যিনি আর্ক ল্যাম্পের সবটুকু আলো শুষে নিতে চান। এবারে আসুন পরিসংখ্যানে, ২০১৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত মোদিজির প্রচারে বিজেপির ভোট বেড়েছে, হ্যাঁ, সাধারণ নির্বাচনে, রাজ্যের নির্বাচনে মোদিজির প্রচারের এক ট্যানজিবল রেজাল্ট দেখা গেছে। সাধারণ নির্বাচনে বেশি, কিন্তু রাজ্যের নির্বাচনেও মোদি ম্যাজিক কাজ করছিল। কতটা? রাজ্যের নির্বাচনে মোদিজি যে সব কেন্দ্রে নিজে প্রচারে গেছেন সেখানে গড়ে বিজেপির ভোট বৃদ্ধির হার ৪–৭ শতাংশ, কম নয়, বিরাট ব্যাপার। কিন্তু ২০২১ সাল থেকে এই ক্ষয় রীতিমতো চোখে পড়ার মতো, বেশ কিছু জায়গাতে বৃদ্ধির বদলে হ্রাস, মানে ভোট কমে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। মোদিজি নিজের বেনারস কেন্দ্রে ২০১৯ সালে পেয়েছিলেন ৬০.৬২ শতাংশ ভোট, জয়ের ব্যবধান ছিল ৪ লক্ষ ৭৯ হাজার ৫০৫ ভোট। আসুন ২০২৪-এর ফলাফলটা দেখা যাক, ২০২৪-এ মোদিজি পেয়েছিলেন ৫৪.২৪ শতাংশ ভোট আর ব্যবধান প্রায় পাঁচ লক্ষ থেকে কমে এসে দাঁড়িয়েছিল ১ লক্ষ ৫২ হাজার ভোটে।

হ্যাঁ, এইভাবেই ওনার ক্ষয় হচ্ছে। আর গণতন্ত্রের মজা হল নেতার জয় এনে দেওয়ার ক্ষমতা আছে, সেই নেতার নামে জয়ধ্বনি উঠবে, না হলে বাপি বাড়ি যা। হ্যাঁ এটা এক কঠিন নিষ্ঠুর সত্য। ভাবুন না লালকৃষ্ণ আদবানির কথা, উত্তর কলকাতার এক বিজেপি প্রার্থী প্রকাশ্যে বলেছিলেন লালকৃষ্ণজি আমার প্রচারে এলে ওনাকে ওজন পাল্লাতে বসিয়ে সমান পরিমাণ রুপো দেব। অবশ্য তিনি টিকিটই পাননি। সে অন্য কথা, কিন্তু সে সময়ে আদবানিজিকে নিয়ে কাড়াকাড়ি হতো। আজ? হ্যাঁ নরেন্দ্র মোদি সেই পরিণতির দিকে এগোচ্ছেন। এখন এমনকী পিএমও-র কিছু ফাইলের নোট নাকি নাগপুরে আগে দেখা হয়। ক’দিন আগেই এই মোদিজির আশকারাতেই জগৎপ্রকাশ নাড্ডা বলেছিলেন বিজেপি এখন সাবালক, তার আরএসএস-এর মার্গদর্শনের সেই প্রয়োজনীয়তা আর নেই। আজ চাকা ঘুরে গেছে। কারণ, আরএসএস দেখিয়ে দিয়েছে তাদের সংগঠন হাত তুলে দেওয়ার ফলে লোকসভাতে দল মহারাষ্ট্রে মুছে যাওয়ার জায়গাতে চলে গিয়েছিল, এবারে তারাই মাঠে নেমেছে, ছবি বদলেছে। হ্যাঁ, দলের মধ্যে কট্টর আরএসএস পন্থীরা, নাগপুরের কাছের মানুষজন নীতিন গড়করি ইত্যাদিরা মোদিজির বিপক্ষ শিবিরেই ছিলেন, কিন্তু এখন সেই শিবির বাড়ছে, প্রত্যেকটা রাজ্যে মোদি শিবির বনাম আরএসএস শিবির তৈরি হয়ে গেছে, আর সেটাই মোদিজির গুরুত্ব কমাচ্ছে। মোদিজি ২০২০ নাগাদ নিজেকে লার্জার দ্যান লাইফ, অযোনিজাত সন্তান, ভগবান, গড সেন্ট, ইশ্বর প্রেরিত দূত ইত্যাদি বলেছেন, বইয়ের দিকে তাকালে বই মুখস্থ হয়ে যায়, ফাইলের দিকে তাকালেই ফাইল বুঝে যান গোছের অলৌকিক এক চেহারা তৈরি করা শুরু করেছিলেন, আজ যা মুখ থুবড়ে পড়েছে। কেন? তার সবচেয়ে বড় কারণ হল তাঁর ওই প্যাথোলজিকাল লায়ারের চরিত্র, উনি মিথ্যে না বলে থাকতেই পারেন না। আর মিথ্যে বলার সবচেয়ে অসুবিধে হল সেই সব মিথ্যেকে মনে রাখতে হয়, না হলেই ক্যাচাল। এক জায়গাতে বলছেন, আমি ছোটবেলা থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত ভিক্ষে করে খেয়েছি, একবার বলেছেন ৩৫ বছর ধরে ভিক্ষে করেছি, আবার সেই উনিই বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছেন সেরকমভাবে রাজনীতিতে আসার আগেই তিনি আমেরিকার ২৬-২৭টা প্রভিন্স ঘুরেছেন। প্রশ্ন তো উঠবেই, ভিক্ষে করে আমেরিকা গেলেন? হ্যাঁ, এই মিথ্যে কথা বলা আর সেই মিথ্যেকে ঢাকতে গিয়ে নতুন মিথ্যে বলার যে চরিত্র, তা তাঁকে আজ হাস্যকর খেলো করে তুলেছে।

সব বিষয়ে মিথ্যে, প্রতিটা বিষয়, নিজের ছোটবেলা থেকে পড়াশুনো থেকে, পরিবার, আত্মীয় পরিজন থেকে স্ত্রী পর্যন্ত। অন্তত দুটো নির্বাচনের এফিডেভিটে উনি জানাননি যে উনি বিবাহিত। ভাবা যায়? দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিবাহিত কলাম ফাঁকা। পড়াশুনো তো জানাই আছে, জীবিত এই প্রথম কারও স্কুল জীবনের বন্ধুবান্ধবদের খোঁজ পাওয়া যায় না, কলেজের পাঠ্য বিষয়ের খোঁজ পাওয়া যায় না, বিশ্বের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যাঁর ৩টে জন্মদিন, জানা নেই কোনটা পালন করা হবে! হ্যাঁ তিনি দেশে একলা, কিন্তু সর্বশক্তিমান আর বিদেশে একলা এবং অত্যন্ত দুর্বল, কেউ পোঁছে না, উনি হেঁ হেঁ করে জড়িয়ে ধরেও যে কোনও লাভ হয়নি তা তো এখন সবাই বুঝেছেন। এবং সেই প্রেক্ষিতে নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি, যিনি ঘরে মনের কথা বলতে পারেন না, মনের কথা বলার মানুষই নেই, তিনি তাই রেডিওতেই মনের কথা বলেন। এই দেশ বহু মানুষের, এখানে বহু ধর্ম, বহু মত, বহু স্বর, বহু ভাষা আছে, থাকবে। তাই এদেশের একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ঠিক করেছিলেন, আমাদের সংবিধান প্রণেতারা, তাই উই দ্য পিপল অফ ইন্ডিয়া, তাই সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে, সব্বাইকে সম্মান করতে হবে, ডাবল ইঞ্জিন কা সরকার সমস্যার সমাধান নয়, এটা বুঝতে হবে। তবে এক ইনকরিজিবল নার্সিসিস্ট প্যাথোলজিক্যাল লায়ার, এতটা বুঝবেন বলে মনে হয় না। মোদি আমলের বৈশিষ্ট্য হল এক নেতা, এক দেশ, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক খাদ্যাভ্যাস। তাই উনি ওনার পেটের মধ্যে ঢুকিয়েছেন গোটা দলটাকে। এবার চাইছেন গোটা দেশটাকেই পেটের মধ্যে ঢোকাতে। এতে শুরুর দিকে কিছু লাভ হয়েছে বইকী, কিন্তু এখন, দুটো জিনিস শুরু হয়েছে, পেটের ভিতরে থাকা পুতুলেরা তলায় তলায় বিক্ষুব্ধ, তাদের ক্ষোভ প্রকাশ্যে না এলেও দলের ভেতরে পরিষ্কার দৃশ্যমান আর দু’ নম্বর হল গোটা দেশের বিরোধীদের আক্রমণের একটাই লক্ষ্য, মোদি, মোদি, মোদি। স্বৈরাচারী রাজনৈতিক কাঠামো টেকেনি, বিশ্বে কোথাও টেকেনি, এখানেও টিকবে না, স্বৈরাচার ইতিহাসের আবর্জনা হয়েই থেকে গেছে, রাজনৈতিক কাঠামো হিসেবে নয়। আসলে হয় কী, নিজেকে নিয়েই ব্যস্ততা আসলে এক ধরনের অসুখ, খুব নতুন কিছুও নয়, আপনার চারপাশে অনেকেই আছে। হিমালয়ের কথা বলুন, ইন দ্য ইয়ার ৬৫, আমি গিয়েছিলাম গোমুখ, সে কী বলব, আমাকে দেখে এক সন্ন্যাসী বললেন, তু তো বেটা সাধক হ্যায়…। বিজ্ঞানের কথা বলুন, জগদীশচন্দ্র বোসের নিজের ভাইপোর ছেলের বউ ওনার কীরকম আত্মীয় বলে দেবেন, অসুখের কথা বললে তো কথাই নেই, কবে কোন ডাক্তার ওনাকে বলেছিলেন, আপনার চিকিৎসা করতে আমার লজ্জা করে, আসলে মেডিক্যাল সায়েন্সটা আপনি যেরকম বোঝেন… কুছ ভি। যা বলবেন, সেটা আমিতে শেষ হবে। এদিকে আমাদের সংবিধানের প্রিঅ্যাম্বল শুরু হচ্ছে উই দিয়ে, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেক বক্তব্য শুরু করেন আই দিয়ে, আমি আমি, আমি, যেন হীরক রাজার দেশের সেই জাদুকর। মোদ্দা কথা হল যতই বিরাট লৌহপুরুষের ছবি আঁকা হোক না কেন আদতে ঘরে বাইরে মোদিজি তাঁর গুরুত্ব হারাচ্ছেন, ক্ষয়ে যাচ্ছে তাঁর ক্যারিশমা, বিদেশের মাটিতে সামাল দিতে না পেরে এখন আবার রাস্তা খুঁজছেন। ভাবুন না ভারতের মতো এক বিরাট দেশের, বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী পুরনো পাঁচশো হাজার টাকার নোট দেখলে ভয়ে কেঁপে ওঠেন, আমেরিকার প্রধানমন্ত্রী নাম এখনও তাঁর ঘুম কেড়ে নেয়। হ্যাঁ উনিজি ক্রমশ আকারে, প্রকারে খাটো হচ্ছেন, রোজ ক্ষইছে তাঁর উচ্চতা।

Read More

Latest News