Wednesday, November 19, 2025
HomeScrollFourth Pillar | মমতা কেন ক্ষমতায়? নবীন পট্টনায়ক কেন আজ ইতিহাস?
Fourth Pillar

Fourth Pillar | মমতা কেন ক্ষমতায়? নবীন পট্টনায়ক কেন আজ ইতিহাস?

২০১৪-র পর থেকে লাগাতার ১৯টা দল এনডিএ ছেড়েছে! কিন্তু কেন?

Written By
অনিকেত চট্টোপাধ্যায়

বিজু পট্টনায়ক এক দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলেন, আর কতগুলো কথা তাঁর সম্পর্কে বলা হত – (১) তিনি স্বল্পভাষী, (২) তিনি নীরবে রাজ্যের উন্নয়নের কাজ করেন, (৩) তাঁর সময়ে ওড়িশাতে বড় দুর্নীতির অভিযোগ নেই, (৪) তিনি ইউনিয়ন সরকার, মানে মোদি–শাহের সরকারের সঙ্গে কোনও কনফ্লিক্ট, কোনও সংঘাতে যাননি, (৫) তিনি বিরোধী জোটের সঙ্গেও ছিলেন না, (৬) তিনি মনে করেছিলেন, তিনি রাজ্যে শাসন চালাবেন আর ওড়িশা থেকে নির্বাচিত সাংসদেরা দিল্লিতে সরকারে না গিয়ে বাইরে থেকেই সরকারকে সমর্থন দেবেন, (৭) এটাই ছিল তাঁর পরিকল্পনা যা দিয়ে তাঁর মনে হয়েছিল বিজেডি, বিজু জনতা দলই থেকে যাবে ওড়িশার ক্ষমতায়। কিন্তু তিনি একবারও ধারণাই করতে পারেননি যে, বিজেপি তাঁর দলকে ভাঙবে। রাজ্যে আরএসএস বেড়েছিল, তিনি খেয়ালও করেননি, রাজ্যজুড়ে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার হয়েছে, এবং শেষমেষ ওড়িশার দখল নিয়েছে বিজেপি। যখন তিনি এটা বুঝতে পারলেন, তখন ইন-ফ্যাক্ট তাঁর আর কিছু করার নেই। বিহার নির্বাচনের উচ্চগ্রামের রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যে চাপা পড়ে গিয়েছে কিছু তথ্য। ওই একই দিনে ওড়িশার নুয়াপাড়ার উপনির্বাচনের ফলও বেরিয়েছে। একদা বিজেডির দূর্গ ওই আসন বিজেপি জিতেছে। সেটাও খুব বড় কথা নয়, সেখানে বিজেডি নেমে গিয়েছে তিন নম্বরে, উঠে এসেছে কংগ্রেস। হ্যাঁ, সেটাই খবর।

একসময়ে কংগ্রেসের দূর্গ ছিল ওড়িশা, বিজু পট্টনায়কের মতো নেতারা ছিলেন জহরলাল নেহেরুর বন্ধু। তারপর বিজু জনতা দল হল, কংগ্রেস দু’নম্বরে গেল, কিছুদিনের মধ্যেই বিজেপি বাড়তে শুরু করল, কংগ্রেস চলে গেল ডিসট্যান্ট থার্ডে। কিন্তু এখন রাজ্যজুড়েই আবার কংগ্রেস উঠে আসছে দু’নম্বরে। ওড়িশার রাজনৈতিক পন্ডিতদের মতে বিজু জনতা দল নবীন বাবুর পরে সামলানোর মত কেউ নেই। কিন্তু এটা হল কেন? আসলে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলানোর পরে প্রায় সমস্ত আঞ্চলিক দলের এটাই অবসম্ভাবী পরিণতি। বাজপেয়ির সরকারের সময় শরিক দলের সংখ্যা ২১ ছিল, কেরালার সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান পার্টিও ছিল, সিপিএম ছেড়ে আসা নটবর বাগদিও ছিল, তৃণমূল ছিল, তেলেগু দেশম ছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণেই অটল সরকার আবার নির্বাচিত হয়নি, বিজেপি দু’পা পিছিয়েছে, কিন্তু শরিক বেড়েছে, কিছু শরিক ছেড়ে গেলেও, অন্যান্য অনেক শরিক এসেছে। ২০১৪-তে ২৪টা দল ছিল এনডিএ-তে। হ্যাঁ, ২৪টা দল! কেউ কেউ ছেড়ে গিয়েছে বটে, কিন্তু তাদের বিকল্পও খুঁজে নিয়েছে বিজেপি, পারেনি এই বাংলায়। তৃণমূল এই খেলাটা ধরতে পেরেছিল, আর তাদের কাছে রাজ্যের মুসলমান ভোটের বাস্তবতাও ছিল, কাজেই তারা খুব কম সময়ের মধ্যেই বিজেপির হাত ছেড়েছে। কেবল ছাড়েনি, এখন তো ইঞ্চিতে-ইঞ্চিতে লড়াই করছে। ২০১৪-তে একাই বিজেপি ২৮২, সাধারণ সংখ্যাগরিষ্টতা থেকে সামান্য বেশি। কিন্তু সেটা কিছুই নয়, বড় দল বিজেপি। ঠিক এইখান থেকে, এনডিএ-র বড় দলগুলোকে হয় ভাঙা, নয় গিলে খাওয়া শুরু করল বিজেপি। প্রথমে পালা ছিল তেলেগু দেশম-এর, অটল বিহারির সময় এন চন্দ্রবাবু নাইডু ছিল একটা নাম, গোটা দেশে অন্ধ্র মডেলের চর্চা, চন্দ্রবাবুর চর্চা চলছিল, সে কি ব্যাপার, চন্দ্রবাবু কলকাতায় এলেন, সামনের সারিতে সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ উঠে দাঁড়ালেন, প্রত্যেক মানুষ উঠে দাঁড়াল, স্ট্যান্ডিং ওভেশন, সে এক ব্যাপার! কিন্তু অলক্ষে আরেকজনের ভুরু কুঁচকোচ্ছিল, কারণ তিনি গুজরাত মডেলকে সামনে আনতে চান। তো ২০১৪-তে ক্ষমতায় আসার পরেই তেলেগু দেশম বাদ কেবল নয়, সিবিআই মাঠে নামল। যতদিন না বিজেপি বুঝেছে যে, চন্দ্রবাবু নাইডুর তাদের দরকার, আর চন্দ্রবাবু নাইডুর সমর্থন বিজেপির দরকার, ততদিন পর্যন্ত তারা চন্দ্রবাবু নাইডুকে ল্যাজে খেলিয়েছে। এখন যা আছে, সেটা নেহাতই ট্রানজ্যাকশনাল রিলেশন, ‘ফেলো কড়ি, মাখো তেল’ আমি কি তোমার পর? চন্দ্রবাবু নাইডুর রাজধানী সাজাতে রাজ্যের জন্য টাকা চাই, মোদিজি উজাড় করে দিচ্ছেন, দক্ষিণের এই চাণক্যকে সামলে না রাখলে সরকার এক দিনে পড়ে যাবে।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | বাংলা দখলের খেলায় নেমে পড়া সোশ্যাল মিডিয়ার হনুমান বাহিনীকে কীভাবে আটকাবেন?

কিন্তু ২০১৪-র পর থেকে লাগাতার বিভিন্ন সময়ে ১৯টা দল এনডিএ ছেড়েছে, কেন? ওই গিলে খাবার কৌশল বুঝে, এড়াতে গিয়ে চুরমার হয়ে গিয়েছে। বিজেপি বেড়েছে রাজ্যে রাজ্যে, বিজেপির শরিক দল ধারাবাহিকভাবেই কমেছে। বিহারের দিকে তাকান, প্রথম যখন জোট হল বিজেপির সঙ্গে জেডিইউ-র, সেই জোটে বড় দল, ১০০-র বেশি আসন কার? জেডিইউ-র, ৫০ থেকে ৫৫টা আসন বিজেপির, এখন? মুখ্যমন্ত্রী এখনও নীতীশ কুমার, কিন্তু বড় শরিক ঘাড়ের ওপরে বিজেপি ৮৯ কেবল নয়, বিজেপি জানে এলজেপি-র বিধায়ক, জিতন রাম মাঞ্ঝির বিধায়ক, কুশোয়াহার বিধায়কেরা তাদের ধারেই থাকবেন। আজ নীতীশ কুমার চাইলেই পালটি খেলেও সরকার তৈরি করতে দমছুট হয়ে যাবেন। মহারাষ্ট্র? একই খেলা! শিবসেনা ছিল বড় শরিক, তাদেরই মুখ্যমন্ত্রী হত, কোনও প্রশ্নই উঠত না। তারপর ধীরে ধীরে বিজেপি বেড়েছে, শিবসেনা কমেছে, এখন একনাথ সিন্ডের শিবসেনা কাঠপুতুলের চেয়ে বেশি কিছু নয়। ওদিকে উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা নিজেদের বাঁচাতে, এনডিএ-র রাষ্ট্রপতি প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মুকেই সমর্থন করলেন, উপায় নেই, দল শেষ, অজগর গিলে খেয়েছে। ওদিকে দেখুন আকালি দলকে, তাদেরও অবস্থা খারাপ, এক নয়া দলের কাছে হেরে ভুত। কারণ বিজেপি জামানার যাবতীয় দায় তাদের বইতে হচ্ছে, ক্ষীর খাচ্ছে বিজেপি, তারা কংগ্রেস গেলেই খুশি, থাকুক না আপ একটা কি দুটো রাজ্যে। এআইডিএমকে-র দিকে তাকান, তাদেরই সমর্থনে সামান্য জায়গা করার পরে, এখন তাদের দলীয় কোন্দল নিয়ে মাঠে নেমেছে বিজেপি, কিছুদিনের মধ্যেই তারা সম্ভবত দুর্বল গোষ্ঠী বা উঠতি কোনও নতুন দলের সাহায্য নিয়ে একলাই বেড়ে উঠবে, অন্তত চেষ্টা করবে। উত্তরপ্রদেশে রাজভরের সুহেলদেভ সমাজ পার্টি, হরিয়ানার রাজ কুমার সাইনির দল লোকতন্ত্র সুরক্ষা পার্টি, উত্তরপ্রদেশের অপনা দল – এরকম বহু ছোট ছোট জন গোষ্ঠী, জাতি, উপজাতিদের নেতা, দলের সঙ্গে বিজেপি ছিল। একে একে তাদের হয় গিলে খেয়েছে, না হলে তারা এখন কেবল কাঠপুতুল, শাহ–মোদি যেমন নাচাবেন, তেমন নাচবে। এটাই তাদের ভবিষ্যত, তারা লুঠমার চালাবে, তাদের লুঠমার চালাতে দেওয়া হবে, এক চোখ বুজে তাদের দিকে নজর রাখবে বিজেপি, সব খাতায় লেখা থাকবে, কথা না শুনলে ইডি আসবে দুর্নীতি বার করতে, আবার ‘পূনর্মুশিক ভব’।

ঠিক এই মূহুর্তে নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহের ন্যাশন্যাল ডেমোক্রাটিক অ্যালায়েন্সে, বড় শরিক দল বলতে আছে কেবল নীতীশ কুমারের জেডিইউ, আর চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম। সেটাও কতদিন থাকবে বলা মুশকিল, নীতীশের অবর্তমানে জেডিইউ যে উবে যাবে, তা বলাই বাহুল্য। তাহলে দাঁড়াল কী? আদতে এক গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী, ক্যাডার বেসড বিজেপি দল, যা নাকি আরএসএস-এর নির্দেশে ভারতের রাজনীতিতে আছে, তাদের যুক্তফ্রন্টের কৌশল হল নিজেদের ক্ষমতা বাড়ানো, ধীরে ধীরে, কেবল প্রতিদ্বন্দী নয়, সহায়ক দলগুলোতে ভাঙন ধরিয়ে, তাদের নেতাদের ভেঙে এনে গিলে খাওয়া। তাদের লক্ষ্য পরিস্কার, এক হিন্দু জাতি, এক রাজনৈতিক দল বিজেপি, এক নেতা, এক ভাষার ভিত্তিতে এক হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করা। মধ্যের হাইফেন এই শিবসেনা, আকালি দল, সুহেলদেব সমাজ দল, জনতা দল ইউনাইটেড, লোক জনশক্তি পার্টি, অপনা দল, পিএমকে, এমডিএমকে, আরএসপি (বলশেভিক), নাগা পিপলস ফ্রন্ট ইত্যাদিরা ইতিহাস হয়ে যাবে, মিউজিয়ামে এই দলগুলোর ফ্ল্যাগ পাওয়া যাবে। কিন্তু সেই তালিকাতে তৃণমূল বা মমতাকে রাখা যাবে না। ২০২৬-এর পরে মমতা দেশ জুড়ে বিজেপি বিরোধিতার এক মুখ হয়ে উঠবেন, তার একটাই কারণ, হ্যাঁ তিনি বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি হাত ছাড়তে সময় নেননি আর আজ বিজেপির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়ে যাচ্ছেন। বিজেপি এমন এক দল যা এক শক্তিশালী কেন্দ্রে বিশ্বাস করে, এক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে তাদের বিশ্বাস কোনওদিনও ছিল না, তারা আঞ্চলিকদলগুলোর সঙ্গে যে সমঝোতা করেছিল, তা ছিল এক কৌশল, যে কৌশলের ফল হাতেনাতেই পেয়েছে আকালি দল, শিবসেনা, জেডিইউ, বিজেডি। তারা হয় বিস্মৃতিতে চলে গিয়েছে, নাহলে চলে যাওয়ার আগের সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মমতা সেই বাঘবন্দী থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন বলেই দেশের রাজনীতিতে আজও প্রাসঙ্গিক।

দেখুন ভিডিও:

Read More

Latest News