আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের রাজ্যের বিরোধী দলনেতা এমন একজন যিনি ক’দিন আগেই শাসক দলের তিন কী চার নম্বর নেতা ছিলেন, মন্যত্রী ছিলেন। তাঁর পরিবারের প্রত্যেকে এই শাসক তৃণমূল দলের যাবতীয় লিগ্যাসি, ঐতিহ্য, সে ভালো হোক বা খারাপ হোক, তা বহন করেন। সেই তিনি হঠাৎ এক চড়া সুরের হিন্দু হয়ে উঠেছেন, যিনি ক’দিন আগে পর্যন্ত দেশের প্রধানমন্ত্রী এই নরেন্দ্র মোদিকে সাম্প্রদায়িক বলেছেন। তিনিই আজ নতুন কাকের মত এঁটো কাঁটা নিয়ে মাঠে নেমেছেন, যা এক বিরোধী দলনেতার মর্যাদা, গুরুত্বকে তলানিতে নামিয়ে দেয়। বিধান রায় মুখ্যমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা জ্যোতি বসু। বলতে উঠলে বিধানবাবুই অন্যদের থামিয়ে দিয়ে শুনতেন তাঁর কথা। কারণ তিনি তথ্য প্রমাণ নিয়ে বলতে উঠতেন, রাজ্যের কথা বলতেন, রাজ্যের মানুষের স্বার্থের কথা বলতেন। জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় বিরোধী দলনেতা। সিদ্ধার্থবাবু বলতে উঠলে বাকিরা চুপ করে শুনতেন, একবার একটু ব্যঙ্গ করেই সিদ্ধার্থবাবু বলেছিলেন, “ঐ কালো হাত টাত বাইরে ভাঙবেন, এখন একটু মন দিয়ে যা বলছি শুনুন।” না, তাঁর এই ত্যারচা কথার পরেও কেউ হৈ-হল্লা করেনি, কারণ তিনিও আজেবাজে বকতেন না। মাত্র ক’দিন আগেও বিরোধী দলনেতা ছিলেন সুর্যকান্ত মিশ্র। তিনিও বলতেন, সমালোচনাই তো করতেন, তীব্র সমালোচনা। বিষয় আর তথ্য নিয়ে হাজার একটা প্রশ্ন তুলতেই পারেন, কিন্তু সেগুলো ছিল রাজনৈতিক বিরোধিতা। আজ সেই বিরোধিতা উবে গিয়ে কোন পর্যায়ে রাজনীতিকে নামিয়ে এনেছেন আজকের বিরোধী দলনেতা? সেটাই বিষয় আজকে, শুভেন্দু অধিকারী রাজ্যের বকেয়া টাকা, ঋণ ইত্যাদি নিয়ে নয়, মুখ্যমন্ত্রীর মাথার ঘোমটা নিয়ে চিন্তায় আছেন।
মহালয়ার আগের দিন উত্তর কলকাতার হাতিবাগান থেকে দুর্গাপুজোর মণ্ডপ উদ্বোধন শুরু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর সেদি বৃষ্টির সময়ে তাঁর মাথায় কাপড় টেনে কানের পিছনে আটকে দিয়েছিলেন। হ্যাঁ, এসব আমরা আজ থেকে নয়, বহু আগে থেকেই দেখে আসছি। সেই কবে ১৯৯০ কী ১৯৯১ হবে, দক্ষিণ ২৪ পরগণাতে এক কংগ্রেস কর্মীকে তাঁর জমিতে চাষ করতে দেওয়া হচ্ছিল না, তিনি গাছকোমরে শাড়ি তুলে ঐ কাদায় ধান রুইতে নেমেছিলেন। হ্যাঁ, অয়ানায়াসে তিনি পাশের বাড়ির মহিলা হয়ে উঠতে পারেন, তার জন্য ওনাকে কোনও পরিশ্রম করতে হয় না, বেমানানও লাগে না। কিন্তু জল পড়ছে বলে, মাথার কাপড় কানের পিছনে দেওয়া মানে হিজাব – এরকম এক কথা বলে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা যা বোঝানোর চেষ্টা করলেন, তা আদতে এক নোংরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অনুষঙ্গ ছাড়া কিছুই নয়।
আরও পড়ুন: Aajke | ধর্মের কার্ড খেলেও শুভেন্দু পিছিয়ে, মমতা এগিয়ে কেন?
উনি, আমার ধারণা, পাড়া প্রতিবেশি গ্রাম গঞ্জের মহিলাদের দেখেননি, সম্ভবত তা নিয়ে ওনার কোনও ব্যক্তিগত সমস্যাও থাকতে পারে। কিন্তু আমরা তো জানি, আমরা তো বাড়িতে দিদি, মাসি, কাকিমাকে দেখেছি, ঠিক অমন করেই শাড়ির ঘোমটা বহু সময়েই কানের পিছনে দিতে। অবশ্য তখন হিজাব কাকে বলে ছাই, আমরা তা জানতাম না। রাজ্যের সমস্যা কম? মনরেগার টাকা পড়ে আছে বাকি, সেগুলো গরীব মানুষের টাকা। আবাস যোজনা টাকা বাকি পড়ে আছে। জিএসটি-র ফলে রাজ্যের রেভিনিউ ঘাটতি নিয়ে বহু প্রশ্ন আছে। রাজ্যের বাড়তে থাকা ঋণ নিয়েও কম প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন তো আছে, শিক্ষার মান নিয়ে। প্রশ্ন আছে, ক্রমশ খারাপ হতে থাকা রাস্তাঘাটের অবস্থা নিয়ে। বিরোধী দলনেতার কাজ তো, সেগুলোকে মানুষের সামনে তুলে ধরা। বদলে কী হচ্ছে? বিরোধী দলনেতা দেখছেন মমতার মাথায় হিজাব, দেখছেন মমতা মহালয়ার আগে উদ্বোধন করছেন দুর্গাপুজো। এটাই তাহলে রাজ্যের সমস্যা? এগুলোই তুলে ধরা বিরোধী দলনেতার কাজ? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, রাজ্যের বিরোধী দলনেতা রাজ্যের বাড়তে থাকা ঋণ নিয়ে চিন্তিত নন, রাজ্যের মানুষের প্রাপ্য মনরেগার বকেয়া টাকা নিয়ে চিন্তিত নন, রাজ্যের বিরোধী দলনেতা রাজ্যের আবাস যোজনার টাকা আটকে আছে কেন, তা নিয়ে চিন্তিত নন। তিনি চিন্তিত মমতার মাথার ঘোমটা কেন কানের ওপাশে গোঁজা? মমতা কেন মহালয়ার আগে পুজো উদ্বোধন করছেন? এগুলো কি এক বিরোধী দলনেতার কাজ?
আসলে এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম এই বাংলার সমাজজীবনে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকলেও, তা উত্তর ভারতের মত অন্য ধর্মের জন্য একরাশ ঘেন্না নিয়ে গড়ে ওঠেনি। আমাদের সৌভাগ্য, রেনেসাঁর আলো পড়েছিল এই বাংলাতে, সেই কবেই। আমরা একটা শব্দ ধর্ম ছাড়াই প্রথম পাঠ পড়েছি, বিদ্যাসাগর লিখেছেন। আমাদের এই বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে সেই কবেই ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে, বিধবা-বিবাহের পক্ষে, সতীদাহের পক্ষে কথা বলেছেন বিদ্যাসাগর, রামমোহন। বাংলার মাটিতেই রামকৃষ্ণদেব বলেছেন, যত মত তত পথের কথা। বিবেকানন্দ বলেছেন, ইসলামের শরীর আর হিন্দু মস্তিষ্কের কথা। সেসবের পর, তার থেকে আরও এগিয়ে উত্তরণের পথে না গিয়ে হিজাবেই আটকে গেলেন! তিথি নক্ষত্রেই ভরসা রাখলেন শান্তি কুঞ্জের বিরোধী দলনেতা।