ঝাড়গ্রাম: পুজোর বাদ্যি বেজে গিয়েছে৷ আগের মতো জৌলুস না থাকলেও এখনও মাথা উঁচু কের হারিয়েও স্বমহিমায় রয়ে গিয়েছে বনেদী পুজো৷ ডুলুং নদীর চরে গভীর অরণ্যের মাঝে প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন চিল্কিগড় রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর। চিল্কিগড় রাজবাড়ির কুলদেবী কনক দুর্গার পুজো (Kanak Durga Mandir Jhargram) ঘিরে জড়িয়ে আছে নানা গল্পকথা। আর এর সঙ্গে রয়েছে চিল্কিগড়ের রাজ পরিবারের (Kanakdurga Temple Chilkigarh Raj Bari) পাঁচশো বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাস।
ঝাড়গ্রাম শহর থেকে মাত্র ১৪ কিমি দুরে নির্জন অরণ্যের মধ্যে দন্ডায়মান ইতিহাস, যা শহুরে সভ্যতার কাছে এখন অনেকটাই অজানা। নীলবসনা দেবীর এই ঐতিহ্য নিয়ে আজও পর্যটকদের কাছে ব্যতিক্রমী ঠিকানা ঝাড়গ্রামের চিলকিগড়ের কনক দুর্গা মন্দির। ঘন জঙ্গল ঘেরা, ডুলুং নদীর ধারে একান্ত নির্জন স্থানে রাজপরিবারের কনক দুর্গার পুজো শুরু হয়েছিল প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে। দেবী কনক দুর্গা এখানে দুর্গা রূপে পূজিতা হয়ে আসছেন। মত্তগজ রাজবংশের গোপীনাথ সিং এই পুজোর প্রতিষ্ঠা করেন বলে জানা যায়। আজ থেকে প্রায় পাঁচ শত বছর আগে রাজা রানীমার কাঁকন ও বালা দিয়ে তৈরি করেছিলেন দেবী কনকদুর্গার মূর্তি, আর এই মন্দিরই স্থাপন করা হয়েছিল চিল্কিগড়ের ডুলুং নদীর চরে গভীর অরণ্যের মাঝে, প্রথমে এখানে ব্রাহ্মণ রাজা স্বরূপ ত্রিপাঠী পুজো করে আসছিলেন পরবর্তী ক্ষেত্রে সামন্ত রাজা এই পুজো চালিয়ে আসছেন।
সারা বছরই পূণ্যার্থীরা এই মন্দিরে ভিড় করেন। তবে দুর্গাপুজোর সময় বহু পর্যটক ঘুরতে আসেন এখানে। অন্যান্য পূজোর নিয়মাবলী ক্ষেত্রে এখানে পুরোপুরি ভিন্ন, মহাষ্টমীতে হাঁসের ডিমের ভোগ দেওয়া হয়। তবে দুর্গাপুজোর চার দিন বিশেষ রীতি আচার মেনে পুজো চলে ঝাড়গ্রামের কনক দুর্গা মন্দিরে। এই চার দিন দেবীকে হাঁসের ডিম, মাছ পোড়া, শাক ভাজা ও পান্তা ভাতের ভোগ নিবেদন করা হয়। প্রতিবার খাবারের শেষে মায়ের জন্য একটি পান দিয়ে আসেন এখানকার পুরোহিতরা।
চিল্কিগড়ে গিয়ে পৌঁছলেই মনে হবে প্রকৃতি তার সব রূপ যেন ঢেলে দিয়েছে। নদী, ছায়াঘন জঙ্গল, গাছে গাছে রঙবেরঙের প্রজাপতি, কি নেই সেখানে। জঙ্গলের মধ্যে কনকদুর্গা মন্দির, ডুলুং নদী এবং জঙ্গলের টানে পর্যটকের ভিড় এখানে লেগেই থাকে বছরভর। কিন্তু, রাতে থাকার ঠিকঠাক ব্যবস্থা না থাকায় মুখ ফেরাচ্ছিলেন পর্যটকরা। এবার সেই কালিমা ঘুচিয়ে নবরূপে তৈরি চিলকিগড়। জঙ্গল লাগোয়া এলাকায় অতিথিশালা রয়েছে। প্রশাসনের উদ্যোগে মন্দির চত্বরে সৌন্দর্যায়নের কাজ হয়েছে।
আরও পড়ুন: বর্ণালী সংঘের ৬২তম দুর্গোৎসব, ‘প্রবচনের ছোঁয়া’ থিমে সেজে উঠেছে পুজো
রাজা স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন রানির হাতের সোনার কঙ্কণ এবং অষ্টধাতু দিয়ে তৈরি করতে হবে দেবীমূর্তি। জানা যায়, দেবী কনক দুর্গা স্বপ্নে রাজাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রতিমার আকার কেমন হবে এবং কোন স্যাকরা তাঁকে মূর্তির রূপ দেবে। দেবীর নির্দেশ মেনে চিল্কিগড়ের স্যাকরা যোগেন্দ্র কামিল্যাই তাঁকে নির্মাণ করেন এবং দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন রামচন্দ্র ষড়ঙ্গী। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত রামচন্দ্র ষড়ঙ্গীর বংশধররা দেবীর পুজো করে আসছেন। দেবীর নির্দেশ অনুযায়ী, দেবী অশ্ববাহিনী, চতুর্ভুজা।
কথিত আছে এখানে অষ্টমীর বিরাম ভোগ রাঁধেন দেবী নিজে। তিথি-নক্ষত্র মেনেই অষ্টমী পুজোর পর গভীর রাতে জঙ্গলের ভেতরে একটি কক্ষে নতুন মাটির হাঁড়িতে জল ও অন্য়ান্য সামগ্রী ভরে শালপাতা দিয়ে হাঁড়ির মুখ বন্ধ করে উনুনে চাপিয়ে দেন মন্দিরের মূল পুরোহিত। উনুনে তিনটি কাঠে আগুন জ্বেলে ঘরের দরজা তালাচাবি দিয়ে বন্ধ করে রাজ বাড়িতে দিয়ে আসা হয়। সেখানে বাইরের কারও প্রবেশাধিকার থাকে না। নবমী দিন সকালে ফের রাজবাড়ি থেকে চাবি এনে তা খোলা হয় শুরু হয় নবমীর পুজো। স্থানীয়দের বিশ্বাস দেবী স্বয়ং এসে এই ভোগ রান্না করেন। স্থানীয়দের মতে এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রত, মায়ের কাছে কিছু প্রার্থনা করলে তা পূর্ণ হয়।
অন্য খবর দেখুন