দিল্লি থেকে বাংলার মসনদ দখলের রসদ যে আসতে শুরু করেছে, তা এই নজরকাড়া বিষয়টার দিকে চোখ ফেরালেই বুঝতে পারবেন। অমিত শাহের ট্যাকটিক্স! সব্বাইকে দিয়ে বলাও, এবারে জিতেই গিয়েছি। চাইলে বিজেপির ‘কে হবেন মুখ্যমন্ত্রী’ তাই নিয়ে দলের মধ্যেই একটা গট-আপ আকচা-আকচিও লাগিয়ে দিতে পারো। কিন্তু বড় নেতারা জনসভাতে গিয়ে বলতে শুরু করুন, ‘আগাম ফলাফল, বিজেপি আসছে।’ সেই ধারা মেনেই মাত্র গতকাল এই বাংলাতে বসে নয়, সুদুর দিল্লি থেকে শমীক ভট্টাচার্য বললেন, “মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, পরিবর্তন আসছে।” সেটাই বিষয় আজকে। শমীক ভট্টাচার্যের বাংলার মসনদ দখলের পরিকল্পনাটা বুঝে নিন।
শমীক ভট্টাচার্য দিল্লিতে বসে কেবল পরিবর্তনের কথাই বলেননি, বলেছেন তার ফরমুলা। তিনি বলেছেন যে, ২০১১-তে সিপিএম-এর লৌহকঠিন সংগঠনকে উপড়ে ফেলে মানুষ দুর্বল তৃণমূলকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ এবারে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। জানি না উনি পড়েছেন কী না, মধুবংশীর গলিতে একটা লাইন ছিল, ‘পাগলেরা বলে কী?’ সমীকরণ আপনিই হবে, কোনও এক অনিবার্য অমোঘ মূহুর্তে, ইতিমধ্যে হাত পা ছুঁড়ে যাও, অদৃশ্য কিছু অস্ত্র শানাও, কিছু কিছু মারকাটও চলুক, যে যাই বলুক, গূঢ় স্বার্থের খেয়ালি আবহাওয়ায় পাল তুলে দাও। আসলে বঙ্গ বিজেপির নেতারা অমিত শাহের উপদেশাবলীর কিছু পাতা পড়েছেন, কিছু পাতা পড়েননি। অমিত শাহ জানেন, সংগঠন ছাড়া নির্বাচন জেতা যায় না, আর জেতার জন্য এক আবহাওয়া লাগে, সেই পরিবেশ তৈরির জন্য বলেই যেতে হয়, ‘অবকি বার দো’শো পার’। তো বঙ্গ বিজেপির নেতারা কেবল দ্বিতীয় ভাগের কাজটা মন দিয়ে করছেন। সেই চালচিত্রে রাজ্য সভাপতি হিসেবেই একটু বেড়ে খেলতে গিয়ে শমীকবাবু জানালেন যে, ২০১১-তে তৃণমূল দুর্বল ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ অমন শক্তিশালী সিপিএম-কে হারিয়ে তৃণমূলকে এনেছিল। ওটা তৃণমূলের সংগঠন নয়, ওটা কেবল মানুষের মন। এসব বলে যা বোঝানোর চেষ্টা করলেন তা হল, আমাদের সংগঠন নেই, তাতে কি? আমরা মাত্র ৩০ শতাংশ বিএলএ-কে মাঠে নামাতে পেরেছি তাতে কী? মানুষই তৃণমূলকে হারিয়ে দেবে।
আরও পড়ুন: Aajke | মনে দুঃখ থাকলে শুভেন্দু অধিকারীর ভাষণ শুনতে পারেন, মন হাল্কা হয়ে যাবে
একটু হিসেব দেখুন। ২০০১-এ বামেরা ৪৫ শতাংশের মতো ভোট পেয়েছিল, তৃণমূল আর জাতীয় কংগ্রেস মিলে ৩৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ২০০৬-এ বামেরা ৪৮ শতাংশ ভোট পেল, কংগ্রেস আর তৃণমূল আলাদা আলাদা লড়েছিল, তৃণমূল ২৬.৬৪ শতাংশ ভোট আর কংগ্রেস ১৪.৭১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ২০০৯ কংগ্রেস আর তৃণমূলের জোট হল, সেবারে লোকসভাতে তৃণমূল কংগ্রেস জোট পেয়েছিল ৪৫ শতাংশ ভোট, বামেরা ৪৩ শতাংশ ভোট। মানে সেই রাজ্য জুড়ে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে লড়াই, যা ২০০৬ থেকে শুরু হয়েছিল, সেই সময় থেকেই বামেদের সংগঠন ভাঙতে থাকে, তৃণমূলের সংগঠন বাড়তে থাকে, যার বড় প্রতিফলন হয় ২০০৯-এ, যেখানে মোট আসনে নয়, ভোট শতাংশে এগিয়ে যায় তৃণমূল। বাকি দু’বছর বুদ্ধ ভট্টাচার্যের সরকার ছিল ‘লেম অ্যান্ড ডাক’, সংগঠন মায়ের ভোগে। যার পরিণাম, ২০১১-তে তৃণমূল জোট ৪৮ শতাংশ আর বামফ্রন্ট ৪০ শতাংশ। তাহলে কী কী ছিল? (১) রাজ্য জুড়ে সংগঠন লড়াই, আন্দোলন, আর মানুষের পছন্দের মুখ মমতা। (২) কংগ্রেস থেকে শুরু করে এসইউসিআই ইত্যাদি ছোট দল, বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠনকে এক জায়গাতে নিয়ে আসা। (৩) রাজ্যের বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, লেখক, কবি, নাট্যকারদের এক অংশকে নিয়ে আসা। (৪) বামেদের মুসলমান ভোটকে নিজেদের দিকে নিয়ে আসা, যাদের এক বিরাট ভাগ প্রান্তিক চাষী, জমি হারানোর ভয় পেয়েছিল। (৫) ২০০৯ থেকে কার্যত প্যারালাল শাসন চালানো, পুলিশ থেকে ডিএম, বিডিও-রা তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। হ্যাঁ, মূলত এই ছবিটা ছিল বলেই এক অত্যন্ত দুর্বল বামেরা হেরেছিল হু-হু করে বাড়তে থাকা তৃণমূলের কাছে। কাজেই মানুষ, বিশেষ করে বাংলার মানুষ হুশ করে পরিবর্তন এনে দেবে। সমীকরণ আপনিই হয়ে যাবে, এসব পাগলের প্রলাপ, একটু মাঠে ঘাটে যান, বুঝতে পারবেন। অবশ্য বুঝলেও বা, করবেন কী? বলে তো যেতেই হবে এই কথাগুলোই, ‘কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম’। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, মানুষ নাকি এবারে পালাবদলের সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন, শমীক ভট্টাচার্য এই কথাগুলো বলেছেন, আপনারা ওনার কথার সঙ্গে কতটা একমত?
বাঙালির গেঁতোমি এক সর্বজনস্বীকৃত বিষয়। বাঙালি ঠিক করে ফেলেছে, বিরিয়ানির থেকে সুখাদ্য নেই, ইলিশ আর চিংড়ির থেকে ভালো মাছ নেই, কলগেট ছাড়া মাজন নেই, সুভাষ বসু মারা যাননি আর বছরে একবার দার্জিলিং, পুরী বা দীঘা যেতেই হবে। হ্যাঁ, বাঙালির পছন্দ অপছন্দ খুব রিজিড, পরিবর্তন বদলের ব্যাপারে ভীষণ কনজার্ভেটিভ। ৫০ থেকে মধ্যের ক’টা বছরের উথাল-পাথাল বাদ দিলে ৭৭ পর্যন্ত কংগ্রেস, তারপর সেই যে কংগ্রেসকে ছুঁড়ে ফেলে দিল, তারা এখন জলছবি। তার পর ৩৪ বছর বাম শাসন, অনেকের মনে হয়েছিল নাতির নাতিও জন্মাবে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের শাসনে, কিন্তু ৩৪ বছর পরে সেও গেল, এখন শূন্যের তলায় নামার চেষ্টায় আছে। এখন তৃণমূল? সেও কি অমর-অজর-অক্ষয়? আমার ধারনা, বিজেপির উথ্বান না হলে তৃণমূল হাঁফিয়ে উঠত, কারণ তৃণমূলের শক্তি তার বিরোধিতায়, বিজেপি এসে তৃণমূলকে নতুন অক্সিজেন দিয়েছে। কাজেই রক্ষণশীল বাঙালি এত তাড়াতাড়ি তাদের পছন্দ বদল করবে না। হ্যাঁ, বাঙালির এই মনস্তত্ত্বটাও শমীকবাবু বুঝতেন, যদি বাঙালি হতেন! সাড়ে তিনখানা শক্তি চাটুজ্যে পড়ে ফেললেই তো বাঙালি হওয়া যায় না।
দেখুন ভিডিও:








