মহম্মদ বিন তুঘলক একজন সরকারি কর্মচারীকে রাজকীয় দরবারে ফিরতে বলা সত্ত্বেও অস্বীকার করায়, তাঁকে ভয়াবহ অত্যাচার করে গর্দান নেওয়ার হুকুম দিয়েছিলেন এবং তা সর্বসমক্ষে পালন করা হয়। ব্রহ্মসূত্রের মূলত গৌতমধর্মসূত্রে বলা হয়েছে যে, বেদ শেখার উদ্দেশ্যে যে শূদ্র বেদ পাঠ শোনে, তার কানে গলিত সীসা এবং লক্ষ ঢেলে দেওয়ার প্রায়শ্চিত্ত বা শাস্তি, যদি সে বেদ শেখে, তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। এগুলোকেই আমরা মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলি। দিল্লি সুলতানির কিছু শাসক তাদের শাসনকে সুসংহত করার জন্য চরম বর্বরতা এবং গণ-মৃত্যুদণ্ডের পথ বেছে নিয়েছিলেন। গিয়াশ-উদ-দীন বলবন (১২৬৬-৮৬), আলা-উদ-দীন খিলজি (১২৯৬-১৩১৬), এবং মুহাম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫-৫১) এর শাসনের সময়ে বন্দিদেরও ঠান্ডা মাথায় গণহত্যা করা হত। সম্রাট অশোক বা পরবর্তীতে কালাপাহাড়ের বিভিন্ন অভিযানে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন তাঁরা। মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত আদেশ বা তার নৈতিক দায়ভার ছিল, নবাবের, সম্রাটের, রাজার।
কিন্তু মানুষ সেই মধ্যযুগীয় শাসনকে অস্বীকার করেই প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে, যেখানে এমনকী কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠদেরও ইচ্ছেখুশি মতো দেশ চলে না, দেশ চালানোর জন্য এক সংবিধান আছে, বিচার বিভাগ আছে, আইন কানুন আছে। চরমতম অপরাধের অভিযোগের পরেও তাকে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়, বিচারের পদ্ধতি চলে। কাসভকে তো আমরা সবাই লাইভ ফুটেজে দেখেছি, গুলি চালাতে, মানুষ খুন করতে, কিন্তু তাকে তো ধরেই ফাঁসিতে ঝোলানো হয়নি, নিয়ম মেনে বিচার হয়েছে, তার কথাও শোনা হয়েছে। হ্যাঁ, এটাই সভ্য সমাজের নিয়ম। কিন্তু এই কিছুদিন, বা বলা যাক কিছু বছর ধরে শুনছি, জমা খরচের গল্প। মানে ধরো আর মেরে দাও। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা এই কথা সেদিনেই বললেন, ধরা হয়েছে, এবারে এনকাউন্টার করা হোক। প্রাক্তন বিজেপি এমপি বললেন, এনকাউন্টার চাই। বেশ তো একটা আইন আনুন, সংসদে সেই আইন নিয়ে কথা হোক। বলা হোক যে দেশকে এক মধ্যযুগে নিয়ে গিয়ে রাজা নবাবদের মতো গর্দান নেওয়ার ইচ্ছে জেগেছে আপনাদের মনে। সেসব না করে এখানে কথা বলছেন কেন? কেন আশারাম বাপু, ধর্ষণে কনভিকটেড আসামি, শান্তি পেয়ে জেলে, কই শোনা তো গেল না যে তাকে এনকাউন্টার করতে হবে? কেন? তিনি অটলবিহারী, আদবানী আর মোদিজির সঙ্গে নেচেছেন বলে? নাকি তিনি গুজরাটি বলে?
আরও পড়ুন: Aajke | বাংলাকে ভাতে মারতে চায় বিজেপি, মজা দেখছেন শুভেন্দু, শমীক, সুকান্তরা
আসলে বিজেপি এক মধ্যযুগীয় শাসন চায়, আমরা চাই, ধর্ষণ কেন, যে কোনও অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার হোক আদালতে, শাস্তি দিন বিচারকেরা। জমা আর খরচের গর্দান নেওয়ার, মধ্যযুগীয় বর্বরতা আমরা চাই না। মানুষের সভ্য হওয়ার প্রতিটা পদক্ষেপে আছে পুরনো জঞ্জাল সাফ করে, অন্যায়কে সরিয়ে দিয়ে, অনাচারকে সরিয়ে এক সুখী সমাজ তৈরি করা, আর তারজন্যই আমরা আমাদেরও নিয়মের আগড়ে বাঁধি। হ্যাঁ একমাত্র মানুষেরাই আইন করে বিবাহের, আইন করে সম্পত্তির, আইন করে সম্পদ বিতরণের। হ্যাঁ, নিজেরাই নিজেদের জন্যই আইন করি। বাঘ সিংহ ভালুক বা শেয়াল নেকড়ে হায়নারা তা করে না। আমাদের সমাজে সেই আইন কেউ ভাঙলে আমরাই তার বিচার করি আর সেই অপরাধের জন্য পূর্ব নির্ধারিত শাস্তি তাকে দেওয়া হয়। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, দেশে আইন আছে, বিচার ব্যবস্থা আছে, অপরাধের বিচার সেখানে হবে? নাকি রাজ্যের বিরোধী দলনেতা, বা প্রাক্তন বিজেপি সাংসদেরা বিচার করবেন, এনকাউন্টারের দাবি তুলবেন? শুনুন কী বলেছেন মানুষজন।
আমার এক লেখক বন্ধুর এক মজার গল্প দিয়ে শেষ করি। এক দেশের কিছু মানুষ অনেক লড়াই করে দেশ স্বাধীন করেছেন, কিন্তু তারা চিন্তিত, তো আমার বন্ধু লেখক তাদের জিজ্ঞে্স করেছেন যে, ভাইসকল তোমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে তাও তোমরা চিন্তিত কেন? তাদের একজন জবাব দিলেন, বললেন, দেশ তো স্বাধীন হল, কিন্তু আমাদের সংবিধান এখনও তৈরি হয়নি, আর সুবিচার কীভাবে হবে, আমাদের কোনও পেনাল কোড তৈরি নেই। আমার বন্ধু হেসে তাদের জানালেন, এটা কি কোনও সমস্যা নাকি? আমাদের দেশের সংবিধান আর পেনাল কোড দুটোই পড়ে আছে, এত খেটেখুটে তৈরি করা এসব কোনও কাজে লাগছে না, তোমরা মনে করলে নিয়ে যেতেই পারো। তারা আনন্দ সহকারে ওসব নিয়ে গেছে। আমরাও খুশি। সংবিধানের দরকার নেই, পেনাল কোডের দরকার নেই। অভিযোগ আসবে, মিডিয়া বলবে ওরা দোষী, ব্যস মারো গুলি খেল খতম। ও ধর্ষণ করেছে, গুলি মারো। ও চুরি করেছে, গুলি মারো, ও রাস্তা আটকে প্রতিবাদ করছে, গুলি করে মারো, ও ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে, কামান দেগে দাও। মানে ওসব সংবিধান বিচার অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার তার থেকে অনেক সোজা সাতসকালে নিয়ে যাও, গাড়ি থেকে নামাও তারপর ঢিচক্যাঁও গুড়ুম, মামলা খতম। এবার রিভালবারটা অমিতাভ বচ্চনের মতো বাঁ হাতে চালাবেন না বিনোদ খান্নার মতো ডান হাতে সেটা বরং বসে ঠিক করা যাক।