বাংলার সিনেমাজগৎ থেকে গিয়ে এক্কেবারে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক চেহারা তৈরি করতে পেরেছেন এমন নাম কিন্তু একটাই, লকেট চট্টোপাধ্যায়। প্রায় শেষের দিকে একটা সিনেমাতে তাঁর রাজনীতিতে নামার একটা আভাস ছিল, তাঁকে প্ল্যাকার্ড হাতে মিছিলে দেখা গিয়েছিল। তারপর থেকে তিনি শুধু রাজনীতিতে নেমেছেন তাই নয়, সিরিয়াসলিই নেমেছেন। আপাতত স্ক্রিপ্ট ছাড়া কথা বলা, ভাষণ দেওয়া বাঙালি অভিনেতাদের মধ্যেও তিনিই এগিয়ে, এক্কেবারে প্রথম সারিতে। সেই লকেট চট্টোপাধ্যায়কে আমরা বেশ ক’বারই দেখেছি বিজেপির বড় সভাগুলোতে, বিশেষ করে যেখানে প্রধানমন্ত্রী থাকেন, সেখানে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতে। যশস্বী, স্বাগতম, কার্যকর্তা, মণ্ডল প্রভারী ইত্যাদি ভারি ভড়কম বিজেপি জারগনগুলোও তিনি রপ্ত করেছিলেন ভালোই। সেই তিনি দমদমে প্রধানমন্ত্রীর জনসভাতে সঞ্চালনা তো দূরস্থান, ডাকও পাননি। আর বিজেপি এবং কমিউনিস্ট পার্টির এক এবং অভিন্ন ক্যাডারকুলে প্রচলিত নিয়ম হল, ডাকলে যাবে, ডাক না পেলে যাবে না। তো তিনি ডাক পাননি, অতএব যাননি। সভা সঞ্চালনা করেছেন জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়। তিনি কিনি? তিনি নাকি বহু আগে থেকেই আরএসএস-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন, যা আমরা কেউই জানতাম না কিন্তু এটা জানতাম যে তিনি আবাপ, মানে আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক। তিনি বাম আমলে বাম ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তৃণমূল আমলের শুরুর দিকে তৃণমূল ঘনিষ্ঠ ছিলেন, পরবর্তীতে তিনি যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে এবং খুব দ্রুত উত্থান, তিনি আপাতত বিজেপির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক। এদিকে শোনা যাচ্ছে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে রাজ্য সরকারের কাছে তাঁর হিসেব বহির্ভূত রোজগার নিয়ে তদন্ত করে দেখার জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে। দুষ্টু লোকজন বলছে এ চিঠি বেশ কসরৎ করেই দিল্লি থেকে আনিয়েছেন রাজ্যের এক বড় বিজেপি নেতা। তো সেই জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়কে দেখা গেল দমদমে প্রধানমন্ত্রীর জনসভাতে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতে। সেটাই বিষয় আজকে, লকেট চট্টোপাধ্যায়ের জায়গাতে জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়?
যদিও এসেছিলেন মেট্রো রেলের কিছু সম্প্রসারণের উদ্বোধন করতে, কিন্তু আমরা তো জানিই যে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর দুটো সুইচ, দুটো মোড। একটা হল দেশে থাকলে নির্বাচন মোড, অন্যটা হল বিশ্বগুরু মোড, যখন তিনি বিদেশে যান। দেশে থাকলে পুরোটা সময়েই মানে ২৪ ইন্টু সেভেন উনি নির্বাচনী প্রচারই করেন, সংসদে, সংসদের বাইরে, কুম্ভস্নান বা বিভিন্ন উদ্বোধন ইত্যাদি আসলে তাঁর নির্বাচনী প্রচারের অঙ্গ। তো সেই হিসেবেই তাঁর সভা সাজানো হয়েছিল দমদমে। কিন্তু সে সভার অবস্থাকে গোবলয়ে শূন্য বটে সন্নাটা বলে, মানে ইদানিং কালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর জনসভাতে এত কম লোক দেখিনি আমরা।
দিলীপ ঘোষও ডাক পাননি, মনের দুঃখে গিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুতে আর্ট অফ লিভিং বুঝতে, কিন্তু নিশ্চিত চোখ ছিল টিভি বা মোবাইলের পর্দাতে, তো সেই তিনি বাংলার এক দৈনিক কাগজকে জানিয়েছেন মঞ্চে যেসব দলবদলুরা বসে রয়েছে তাঁদের দেখতে কেন মানুষ আসবেন বলুন তো? ইঙ্গিত খুব পরিষ্কার কারণ মঞ্চেই তো ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী, অর্জুন সিং, তাপস রায়, সজল ঘোষ। হ্যাঁ, এদের নাম করেই তিনি বলেছেন এসব দলবদলুদের দেখতে কেন মানুষ আসবে। তাই সভা ফাঁকা থেকে গেছে। তিনি বলেছেন আমরা মিটিং মিছিল করলেও তো এর থেকে বেশি লোকজন আসে। কেন আসবে? এই লোকজনদের বিরুদ্ধেই তো বিজেপি একসময়ে লড়েছে। মানে দিলু ঘোষ এক্কেবারে কাপড় খুলে ধুয়ে দিয়েছেন যাকে বলা যায়। কিন্তু মঞ্চে তো ছিলেন শমীক ভট্টাচার্য, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা মুখস্থ ওনার, সম্ভবত সেই সাহিত্যচর্চায় ব্যস্ত ছিলেন বলেই কারা মঞ্চে থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর এই জনসভাতে, সেটার খোঁজ নিতে পারেননি। ডাক পাননি সৌমিত্র খান, ডাক পাননি জগন্নাথ সরকার। আর সেটা দলের রাজ্য সভাপতি জানতে পেরেছেন মঞ্চে গিয়ে, এবং তাই মঞ্চে বসেই তিনি লকেট চট্টোপাধ্যায়কে ফোন করেছেন। তো কী বলেছেন? রাজ্য সভাপতি জিজ্ঞেস করেছেন আপনাকে মঞ্চে দেখা যাচ্ছে না কেন? উনি বলেছেন আমাকে তো ডাকা হয়নি। আচ্ছা ব্যাপারটা কি এতই সরল? এসব শিশু ভোলানাথের পাঠ কাকে পড়াচ্ছেন? রাজ্যের সভাপতি জানেন না প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চে কে কে থাকবে? যদি সত্যিই না জানেন তাহলে তো সাংঘাতিক ব্যাপার। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় থাকার জন্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক লকেট চট্টোপাধ্যায়, প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষ, সাংসদ সৌমিত্র খান, জগন্নাথ সরকারেরা ডাক পেলেন না। দলের মধ্যে চরম গোষ্ঠীকোন্দলের জন্যই এসব হয়েছে বলে অনেকে বলছেন। এই দল নিয়ে ২০২৬-এর নির্বাচনে বিজেপি কি তার আগের ফলাফল ধরে রাখতে পারবে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
সেই যে ২০২১ থেকে দলের মধ্যে কোন্দল শুরু হয়েছে তা এখন তুঙ্গে। শোনা যাচ্ছে সেপ্টেম্বরে অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদি আবার আসবেন। আবার তাঁরা ডেইলি প্যাসেঞ্জারির কাজটা শুরু করছেন। কিন্তু মাটিতে এমন আকচা আকচির খবর কি তাঁরা রাখেন? তাঁরা কি জানেন যে অমন সাহিত্যপ্রেমী বাঙালি শমীক ভট্টাচার্য, যিনি ঘটনাচক্রে দলের রাজ্য সভাপতি, তিনিও জানতেন না মঞ্চে কাদের ঠাঁই হয়েছে, কারা ডাকই পাননি। হ্যাঁ বিজেপির মধ্যে তৃণমূলের কয়েকজন নাকি দারুণ সক্রিয়, তাঁরা নাকি ভিতরে থেকেই দলকে টুকরো টুকরো করার একটা পরিকল্পনা মাফিকই কাজ করছেন, এরকমটা আমাদের ধারণা নয়, বিজেপি সলের মধ্যেই বেশ কিছু মানুষ বলছেন। যদি তা সত্যি হয় তাহলে বিজেপির কপালে দুঃখ তো আছেই, দলের নতুন সাহিত্যপ্রেমী সভাপতির কপালেও যথেষ্ট দুঃখ লেখা আছে, একথা হলফ করেই বলা যায়।