পাটনাতে ছেয়ে গেছে মোদিজির পোস্টার, তো নির্বাচন আসছে, আপনি বলবেন সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু একটু পোস্টারটা দেখুন, হাতে বিমানবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজের হেলমেট, গায়ে সেই বিমানবাহিনীর পোশাক, যুদ্ধে গিয়েছিলেন মোদিজি, পাকিস্তানকে ধ্বংস করে ফিরে এসেছেন, চোখেমুখে সেই বিজয়ের গৌরব। দেশের ১৪তম প্রধানমন্ত্রী একজন যোদ্ধা, তিনি স্থলসেনার পোশাক পরে ছবি তোলাবেন, তিনি নৌবাহিনীর পোশাক পরে পোস্টার ছাপাবেন, এবারে যুদ্ধে তিনি বিমানবাহিনীর যোদ্ধা। তবে ঠিক এইখানেই একটা তথ্য দিই, এর আগের ১৩ জন প্রধানমন্ত্রীর একজনকেও, এই নৌটঙ্কি করতে হয়নি, একজনকেও না। যুদ্ধ দেখেছেন ক’জন? জওহরলাল নেহরু দেখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, জেনারেল ফ্রাঙ্কো বাহিনীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বাহিনী, ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেডে যোগ দিয়েছিলেন, রণাঙ্গন থেকেও ছবি আছে, না, তিনি জানতেন এক রেগুলার আর্মি ছাড়া আর্মি ফ্যাটিগ পরাটা উচিত নয়, তিনি পরেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে চীন-ভারত যুদ্ধ হয়েছে, না ওনাকে কেউ আর্মি পোশাক পরে ছবি তোলাতে দেখেননি। লালবাহাদুর শাস্ত্রী, পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৬৫-র যুদ্ধ, জয় জওয়ান, জয় কিষানের ডাক দিচ্ছেন, তাঁকেও কোনওদিন এই ভণ্ডামি করতে দেখা যায়নি। ৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তানকে হারিয়েছিল ভারত, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, তাঁকে এরকম এক পোস্টারে কি খুব বেমানান লাগত? কিন্তু না, তিনি সেই ভাঁড়ামিতে নামেননি। অটলবিহারী বাজপেয়ী, কার্গিল যুদ্ধের সময়ে প্রধানমন্ত্রী, না তিনিও এমন পোশাক পরে ছবি তুলিয়ে তাঁকে ভোট প্রচারে নিয়ে যাননি। আমাদের ১৪তম প্রধানমন্ত্রী সব অর্থেই দেশের যাবতীয় সাধারণ রীতিনীতি ভেঙে চুরমার করে সেনাবাহিনীর পোশাককেও নির্বাচনের হাতিয়ার বানিয়ে দিলেন।
এরকমটা আমরা হিটলারের ক্ষেত্রে দেখেছি, মুসোলিনির ক্ষেত্রেও দেখেছি, হিটলার ছিলেন হেরো সেনাবাহিনীর এক অখ্যাত সেনা, কিন্তু যুদ্ধের নায়ক হওয়ার ইচ্ছে ছিল ষোলো আনা, তাই প্রায় সবসময়েই ওই মিলিটারি পোশাক পরে থাকতেন। মুসোলিনিও তাই। অপারেশন সিঁদুর এখন বিজেপির রাজনৈতিক হাতিয়ার, কলকাতায় এসে অমিত শাহ ঠিক সেই প্রচার নিয়েই মাঠে নামলেন। কেন? আসুন তার কারণগুলোকে দেখে নিই। প্রথম কারণ হল বিহার নির্বাচন, তারপরে বাংলা বা কেরালা বা তামিলনাড়ুর নির্বাচনে বিজেপির মুখ ফুটে কীই বা বলার আছে? কারণ ওই দেশ চার নম্বর ইকোনমি ইত্যাদির কোনও প্রভাব মানুষের উপরে পড়ছে না, মানে মানুষ তখন সেটাকে এক বিরাট অ্যাচিভিমেন্ট বলে মনে করত যখন সে চোখের সামনে কিছু দেখতে পেত। ধরুন বেকারত্ব কমত, এর ওর তার চাকরি হত, সে খবর ছড়াত, বদলে আজ চূড়ান্ত হতাশা, আর সেই হতাশার টের পেয়েই সরকার বেকারত্বের পরিসংখ্যান বার করা বন্ধ করে দিয়েছে। মানুষ যদি দেখত জিনিসপত্রের দাম কমছে, পেট্রল ডিজেলের দাম কমছে, তাহলে অন্য কোনও ইস্যুর দরকারই হত না, কিন্তু সেখানে তো এক চূড়ান্ত বিপর্যয়। মানে মানুষ যা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে তাতে এমন কিছুই নেই যা নিয়ে বিজেপি খুব গর্ব করে বলতে পারবে যে দেখেছ, আমরা এটা করেছি। ওই ৮০ কোটি মানুষকে রেশন দেওয়ার গপ্পোটাও পুরনো হয়ে গেছে, সেটার রিনিউয়াল হয়নি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | দে গরুর গা ধুইয়ে দিলেন মমতা
দু’ নম্বর বিষয় হল, রামমন্দির ওহি বনেগা, তো রাম মন্দির হয়ে গেছে, অযোধ্যায় বিশাল মন্দির হয়ে গেছে, এখন ওই রামের নামে যে আন্দোলন আর সেই আন্দোলনের যে ডিভিডেন্ড তা কমেছে, তার আকর্ষণ হারিয়েছে, আবার এক অযোধ্যা নয়, কাশী মথুরাতেও হিন্দু জাগরণ ইত্যাদির স্লোগান তাঁরা রেখে দিয়েছেন ২০২৯-এর জন্য, শেষবারের মতো হিন্দু কার্ড তাঁরা খেলবেন, নিশ্চইয়ই খেলবেন, আপাতত সেই অস্ত্র ব্যবহার করতে চান না। তার মানে উন্নয়ন নেই, হিন্দুত্বের কার্ড আপাতত নতুন করে খেলা যাচ্ছে না, তাহলে পড়ে থাকে সেই জঙ্গি জাতীয়তাবাদ, এক জিঙ্গোইজম, যার উপরে ভর করে আগামী খুব গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলোতে বিরোধীদের মুখোমুখি হতে হবে। বিহার, বাংলা, তামিলনাডু, কেরালা। আর খেয়াল করে দেখুন, এর তিনটে রাজ্যেই বিজেপি সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বাংলাতে মমতা, তামিলনাড়ুতে স্তালিন আর কেরালাতে সিপিএম বা কংগ্রেস কেউ জমি ছেড়ে দিতে নারাজ। কিন্তু বিহার? হ্যাঁ, এইখানে এক সম্ভাবনা আছে বইকী, আর সেটা আছে বলেই আরএসএস-বিজেপি সেখানে মোদিজিকে দিয়ে সেই দেশপ্রেমের বান আনতে চাইছেন, আর সেইজন্যই সেনাবাহিনীর পোশাককেও নির্বাচনের হাতিয়ার করে তুলতে তাঁদের কোনও লজ্জা নেই। অনায়াসে এক যুদ্ধকে, এক উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে সারা দেশের মানুষের আবেগকে এক বাণিজ্য করে তুলতে তাদের এতটুকুও সঙ্কোচ নেই। তাই যে লড়াই শুরু হয়েছিল দেশের ২৬ জন নাগরিকের হত্যার বিরুদ্ধে, উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে, পাক হানাদারির বিরুদ্ধে সেই অপারেশন সিঁদুর আজ ১০০ শতাংশ নির্ভেজাল নির্বাচনী প্রচারের হাতিয়ার। এবং প্রতিটা ক্রিয়ার এক বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে, নিউটন সাহেব বলেছিলেন, সেটা আজ দেখতে পাচ্ছি, যে অপারেশন সিঁদুরের পাশে শর্তহীনভাবে দাঁড়িয়েছিল দেশের প্রত্যেক রাজনৈতিক দল, দেশের সংপ্রভুতা অখণ্ডতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে যে দেশপ্রেম, দেশকে নিঃশর্ত ভালোবাসার শপথ নিয়েছেন প্রত্যেক নাগরিক, সেই তারাই আজ জানতে চাইছেন খুলে বলুন হয়েছিলটা কী?
চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ দেশে নয় বিদেশে গিয়ে বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে জানাচ্ছেন, হ্যাঁ, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ৬টা রাফাল ধ্বংস না হলেও রাফাল ধ্বংস হয়েছে, তিনি খুব যৌক্তিকভাবেই বলেছেন যে প্রথম দিনেই সেই ক্ষতির পরে আমরা নিজেদের শুধরেছি, নতুন করে আক্রমণ করেছি আর তার ফল আপনাদের সামনে, পাকিস্তানি এয়ার বেসগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঠিকই তো কোন যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি হয় না? ৬৫-র যুদ্ধে হয়নি? ৭১-এর যুদ্ধে হয়নি? কার্গিল যুদ্ধে হয়নি? হয়েছে এবং তা দেশের সরকার জানিয়েছে, কিন্তু এই প্রথমবার মোদিজিকে যোদ্ধা বানানোর চক্করে সামান্যতম ক্ষতির কথা স্বীকার না করে এক অজেয় ছবি বানানোর চেষ্টা হচ্ছিল যার প্রয়োজন কেবল নির্বাচন প্রচারেই দরকার, আর অন্য কোথাও নয়। কাজেই এবার দেশের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, উঠবেই, ঠিক করে বলুন, ক্ষয়ক্ষতির হিসেব দিন। এবং তারচেয়েও বড় প্রশ্ন কেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে দেশের মানুষ জানতে পারল যে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হয়েছে? একবার নয় ন’ ন’ বার আমেরিকার আমলারা, রাষ্ট্রপতি প্রকাশ্যে এই কথা বলেছেন, এমনকী আমেরিকার আদালতেও এই কথা বলেছেন, তাহলে সত্যিটা কী? এদিকে মোদিজি থেকে বিদেশমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী একটা কথাও বলছেন না। ছবি পোস্টার হবে প্রধানমন্ত্রীর আর আমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা শুনব দেশের পররাষ্ট্র সচিবের কাছ থেকে? সত্যি কথাটা কি মোদিজির মুখে আনতে লজ্জা হচ্ছে?
হ্যাঁ, এই প্রশ্ন তো উঠবেই নির্বাচনে। একমত, এ প্রশ্ন ওঠা উচিত নয়, এক রাজ্যের নির্বাচনে কেন উঠবে এই প্রশ্ন? কিন্তু তা উঠবে কারণ এই অপারেশন সিঁদুর আপাতত বিজেপির রাজনৈতিক প্রচার হয়ে উঠেছে, কাজেই কেবল এটা নয় এরকম আরও বহু প্রশ্ন তো উঠবেই। প্রশ্ন উঠবে না যে কেন আমেরিকার সরাসরি সমর্থনে আইএমএফ-এর লোন পেল পাকিস্তান, হাতে পেয়ে গেছে ২.১ বিলিয়ন ডলার, মোট পাবে ৭ বিলিয়ন ডলার। এবারে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক ১০ বছরের জন্য ৪০ বিলিয়ন, হ্যাঁ ঠিক শুনছেন ৪০ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য বা বিনিয়োগের কথা জানিয়ে দিল, ৫০ শতাংশ সরকারি বিনিয়োগ, ৫০ শতাংশ বেসরকারি বিনিয়োগ। খুলে বলি, বিশ্বব্যাঙ্ক পাকিস্তানের জন্য ২০২৬ থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত এক দশ বছর মেয়াদি নতুন কান্ট্রি পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্ক (CPF) চালু করেছে, যার আওতায় তারা সর্বোচ্চ ৪০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করবে। কেন রাশিয়া নতুন করে ২.৩ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করল পাকিস্তানের সঙ্গে? কেন আপাতত রাশিয়া ভাবছে পাকিস্তানের গদর বন্দর দিয়ে বাণিজ্যের কথা? কেন আমেরিকা থেকে রাশিয়া, চীন থেকে টার্কি, আজারবাইজান থেকে তুর্কমেনিস্তান পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করছে? কী মনে করছেন এই প্রশ্ন উঠবে না? হ্যাঁ, আরএসএস–বিজেপির এক মস্ত ভুল হল তাদের ভয়ঙ্কর আত্মবিশ্বাস, তারা বালাকোটের সময়ে সার্জিকাল স্ট্রাইক ব্যবহার করে ২০১৯-এর ভোটে বিরাট জয় পেয়েছিলেন, কিন্তু এবারে অপারেশন সিঁদুরকে নির্বাচনী প্রচারের হাতিয়ার করে তোলাটা যে কতবড় ভুল হয়ে গেছে তারা সেটা টের পাবে কিছুদিনের মধ্যেই। কারণ এমন সমস্ত প্রশ্ন এবারে উঠতে শুরু করেছে, এমন সমস্ত প্রশ্ন উঠবে যার উত্তর মোদি-শাহ, বিজেপির পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়, সে উত্তর তাঁদের কাছে নেই।