Tuesday, August 26, 2025
HomeScrollঅদিতির সঙ্গে সাদা কালো | হয়েছে যাবজ্জীবন আর হতে পারত ফাঁসি

অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | হয়েছে যাবজ্জীবন আর হতে পারত ফাঁসি

যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। কুলতলি, মাটিগাড়া, ফারাক্কা, গুড়াপ, নামগুলো চেনা চেনা লাগছে? লাগারই তো কথা গত কয়েক মাসে এই জায়গার নাম এসেছে খবরের কাগজের শিরোনামে, চারটে জায়গাতেই ধর্ষণ আর খুনের ব্যাপার ঘটেছিল, চারটে মামলাতেই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশ তদন্ত করেছিল, চারটে ঘটনাতেই তাদের তৈরি করা মামলার উপরে বিচার হয়েছে, চারটে ক্ষেত্রেই ফাঁসির আদেশও দিয়েছেন বিচারক। ঠিক তারপরেই এল আরজি কর মামলার রায়, যেখানে এক এবং একমাত্র অভিযুক্তকে আমৃত্যু জেলের সাজা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিরাট সংখ্যক মানুষ এই রায়ে অখুশি, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অভিযুক্তের ফাঁসি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ, উনি জানিয়েছেন সিবিআই ঠিক করে মামলা না সাজানোর জন্যই ছেলেটিকে ফাঁসির সাজা দেওয়া যায়নি।

সাধারণ মানুষজনের প্রতিক্রিয়া যা আমরা পথেঘাটে দেখেছি তাতে খুব পরিষ্কার যে মানুষ এই মামলায় অপরাধীর ফাঁসি চেয়েছিলেন এবং তা না হওয়াতে ক্ষুব্ধ। শুরু থেকেই এই আরজি কর মামলা খবরের কাগজের প্রথম পাতায় উঠে এসেছে বার বার, শহরের রাজপথে মানুষের মিছিল, রাতজাগা, অনশন মানুষের মনে এক মেধাবী ডাক্তারের এই ধর্ষণ খুন যে অভিঘাত তৈরি করেছিল তা এক ধরনের রাগ, ঘেন্না, কষ্ট মেলানো অনুভূতি, যার উপশমের জন্যই মানুষ চাইছেন চরমতম শাস্তি হোক, ছেলেটির ফাঁসি হোক, কিন্তু বিচারক জানিয়েছেন এই ঘটনা বিরলের মধ্যে বিরলতম নয়, রেয়ারেস্ট অফ দ্য রেয়ার নয়, কাজেই তিনি ছেলেটিকে অন্তত বাঁচার সুযোগ করে দিলেন। মানুষের এক বিরাট অংশই এর সঙ্গে একমত নয়। একজন অভিযুক্ত যে নাকি সিভিক ভলান্টিয়ার, যার কাঁধে মানুষের সুরক্ষার দায়িত্ব, সে একজন মাতাল, উচ্ছৃঙ্খল কেবল নয় একজন ধর্ষক, একজন খুনি, দিনের শেষে ৩৬ ঘণ্টা কাজের পর যে চিকিৎসক ঘুমিয়েছিলেন তাঁকে তাঁর কর্মস্থলে গিয়ে ধর্ষণ খুন করেছে, মানুষের বক্তব্য এ যদি বিরলের মধ্যে বিরলতম না হয়, তাহলে কোন ক্ষেত্রে ফাঁসি দেওয়া হবে। একজন ধর্ষক ধর্ষণ করার আগে যদি এই অভিযুক্তের ফাঁসিতে চড়ার কথাটা মনে করে সেই ঘৃণ্য কাজ থেকে পিছিয়ে আসে তাহলেও তো বিরাট ব্যাপার, এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত এই সঞ্জয় রায়ের ফাঁসি, তা না হওয়ায় মানুষ ক্ষুব্ধ।

আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | আইআইটি বাবা আর কাঁচা বাদামের গান

এবারে আসুন বিষয়টাকে অন্য আর এক দিক থেকে দেখা যাক। ধর্ষণ আর খুনের জন্য ফাঁসি কি এর আগে হয়নি? হয়েছে। আমাদের রাজ্যে তো ধর্ষণ আর খুনের জন্য ফাঁসির দাবিতে মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী এই মহানগরে সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন, মনে আছে সেই ধনঞ্জয়ের ফাঁসি চাই? সেদিন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে সরকারের নির্দেশেই ধনঞ্জয়ের জঘন্য ধর্ষণ আর খুনের জন্য ফাঁসির আবেদন করা হয়েছিল, ফাঁসি হয়েওছিল, কিন্তু তারপরে কি ধর্ষণ হয়নি? খুন হয়নি? দৃষ্টান্তমূলক সাজার পরে কি অপরাধ কমে যায়? অপরাধ বিজ্ঞান বলছে প্রতিটি অপরাধী অপরাধ করার সময়ে ১০০ শতাংশ নিশ্চিত থাকে যে সে ধরা পড়বে না। কাজেই সেই অপরাধের জন্য কে কবে কোন সাজা পেয়েছে তা নিয়ে তার ভাবার প্রয়োজনই তো নেই। শাস্তি কোনও ক্ষেত্রেই অপরাধকে আটকাতে পারে না এটা বার বার প্রমাণিত। সে শাস্তি স্কুলে বিচ্ছু ছেলেকে নিল ডাউন করে বা মুরগা হওয়ার আদেশই হোক বা খুনের মামলাতে ফাঁসিরই হোক। যদি শাস্তি দিয়েই অপরাধ বন্ধ তো ছেড়েই দিন কমানোই যেত, তাহলে তো অপরাধ আর হতই না। কিন্তু অপরাধ হয়, ধর্ষণ হয়, খুন হয়, রাহাজানি হয়, ফেরেব্বাজি হয়, এর প্রত্যেকটার পিছনে আলাদা আলাদা কারণ থাকতে পারে, জাস্টিফাই করার চেষ্টাও হতেই পারে। বলা যেতেই পারে খিদের জ্বালা সহ্য না করতে পেরে ছেলেটি সইফ আলি খানের বাড়িতে চুরি করতে ঢুকেছিল, ধরা পড়ে গিয়ে ভয়ের চোটে বাঁচার জন্য আঘাত করেছে, কিন্তু একবার ভাবুন যে ছেলেটি যখন এই কাজ করতে যাচ্ছিল তখন কি তার এই পরিণতির কথা ভেবেছিল? এবার আসুন এই ফাঁসি আর যাবজ্জীবনের বিষয়টাকে একটু বোঝা যাক। যত দিন গেছে ততই মৃত্যুদণ্ডের পদ্ধতিকে আরও মসৃণ, মোলায়েম, কম কষ্টদায়ক করে তোলার চেষ্টা হয়েছে, এখন তো অনেক দেশেই ইঞ্জেকশন দিয়ে প্রায় বিনা কষ্টে প্রাণদণ্ডের আদেশ কার্যকর করা হয়।

অন্যদিকে ৩৫-৪০-৫০ বছর জেল, বাইরের আকাশ না দেখতে পারা, বাইরের প্রিয়জনদের না দেখতে পাওয়া, বাইরের কারও সঙ্গে কথাবার্তাও না বলতে পাওয়া, ভাবতে পারেন কতটা কষ্টকর? একটা ঘরে সমস্ত সুবিধে নিয়েই, মানে এসি, ফ্যান, গান শোনার, খাওয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়েও একটা ঘরের মধ্যে চার দিন থাকুন, বুঝতে পারবেন। এক নরক যন্ত্রণা আপনাকে বলবে যে এর চেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভালো। কাজেই এই আমৃত্যু জেলে বাসের সাজাও কিন্তু খুব কম সাজা নয়। আর আরও বড় ব্যাপার হল এই বিচার বলুন তদন্ত বলুন বা আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা, এ তো কোনও অঙ্কের খাতা নয়, দুই যোগ দুই চার, এমন তো নয়, কাজেই আমাদের বিচারে কি ভুল হতে পারে না। কলিন ক্যাম্পবেল রস, তাঁকে মেলবোর্ন অস্ট্রেলিয়াতে ১২ বছরের আলমা ত্রিস্কেকে খুন করার অপরাধে ফাঁসি দেওয়া হয়, এই মামলাটা ১৯৯০-এ আবার তদন্ত করা হয়, ২০০৮-এ কলিনকে নির্দোষ হিসেবে ঘোষণাও করা হয়, কিন্তু তার আগেই কলিনের ফাঁসি হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়াতে এখন আর ফাঁসি হয় না, তাদের আইনে ফাঁসির সাজা উঠে গেছে। ১৬৬০-এ ইউকে-তে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে ছিল। জানা গেল, ক্যাম্পডেন ওয়ান্ডার নামে একজন সকালবেলায় মর্নিংওয়াক থেকে আর ফেরেনি, তার কিছু কাপড়জামা রক্তমাখা পাওয়া গেল রাস্তার ধারে। সেই অপরাধে তাঁর গৃহভৃত্য জন পেরি, তার মা এবং তার ভাইকে দোষী হিসেবে ফাঁসি দেওয়া হয়। দু’ বছর পরে সেই ক্যাম্পডেন ডেভিড হঠাৎ উদয় হলেন এবং তাঁর কাছ থেকেই জানা গেল যে তাঁকে নাকি কিডন্যাপ করা হয়েছিল। এরকম বহু ঘটনা সারা বিশ্ব ছড়িয়ে আছে, আছে বলেই বিশ্বে বহু দেশ থেকেই এই মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়া হয়েছে। না, আমি জাজমেন্ট দিচ্ছি না, প্রত্যেকের নিজের ভাবার, মত দেওয়ার অধিকার রয়েছে, আমি কেবল দু’ দিকের বক্তব্য তুলে ধরলাম। শেষ করি এই বলে যে ডাক্তারদের, হ্যাঁ জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠন কিন্তু জানিয়েছে, সেই যাবজ্জীবনই হোক বা ফাঁসি, তাঁদের আন্দোলন চলছে চলবে। কে একজন বলল, না চললে তাঁদের অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকবে কী করে? সে এক অন্য গল্প, আর একদিন বলা যাবে।

Read More

Latest News