Monday, November 17, 2025
HomeScrollFourth Pillar |ভোট লুঠ আর নির্বাচন কমিশনের সাহায্যেই কি নিতীশ কুমার ফিরলেন...
Fourth Pillar

Fourth Pillar |ভোট লুঠ আর নির্বাচন কমিশনের সাহায্যেই কি নিতীশ কুমার ফিরলেন মসনদে?

বিহারের রাজনীতিতে নারীরা যে কেবল ভোটার নন, বরং সবচেয়ে "নির্ণায়ক ভোটার"

বিহারের ২০২৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনের (Bihar Assembly Election 2025) ফলাফল এক অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক ভূমিকম্প। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা নীতিশ কুমারের নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে ভোটারদের মধ্যে সামান্য হলেও anti-incumbency তো থাকার কথাই ছিল । অনেকে আশা করেছিলেন, মহাগটবন্ধন (MGB) হয়তো হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সুযোগ পাবে। কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফল জোটের নিজেদের প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে এন ডি এ, তারা এক “ঐতিহাসিক জয়”  ছিনিয়ে নিয়েছে। এই জয় একতরফাই বলা যায়, বিজেপি, জেডিইউ বা চিরাগ পাশওয়ানের এলজেপির স্ট্রাইক রেট তো তাই বলছে। প্রায় ৯০% স্ট্রাইক রেট শেষ কবে দেখেছি আমরা? সেই ২০১০ এ, আর কিছুটা হলেও ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে। হ্যাঁ এবারে এনডিএ লোকসভা নির্বাচনের ভোট শতাংশকে কেবল ধরেই রাখেনি, বাড়িয়েছে। বিরোধীদের প্রথম চেহারা তেজস্বী এখন ঘরের ঝামেলা মেটাতেই নাজেহাল। কিন্তু রাহুল গান্ধী প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভোট চুরি, নির্বাচন কমিশনের (Election Commission) দিকে আঙুল তুলেছেন, কেউ কেউ ঠিক ভোটের আগে মহিলাদের অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকার দিকেও আঙুল তুলেছেন। কিন্তু সেইজন্য এই ফলাফল? সম্ভব নাকি? একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে এই বিপুল সাফল্যের পেছনে কোনও একক কারণ ছিল না, বরং ছিল একাধিক কৌশলগত ফ্যাক্টরের নিপুণ, নিখুঁত সমন্বয়। ভোটাররা শেষ পর্যন্ত ‘সুশাসন ও স্থিতিশীলতা’র মূল্য দিয়েছেন, এবং এন ডি এ-র জামানায় উন্নয়নমূলক কাজগুলো মাথায় রেখেই ভোট দিয়েছে।  কিন্তু তারপরেও এই জয়ের মূল চালিকাশক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল নারী ভোটারদের অভূতপূর্ব সমর্থন, জাতি সমীকরণের সম্প্রসারণ, জোটের মধ্যে নিখুঁত সাংগঠনিক ঐক্য এবং বিরোধীদের ‘জঙ্গল রাজ’-এর ভয়ের সফল রেজারেকশন,পুনরুজ্জীবন, সেই ভয়ের ছবিকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন এন ডি এ নেতারা, তেজস্বী যাদবের মুখ্যমন্ত্রীত্বের ঘোষণা ব্যুমেরাং হয়েছে। একে একে আসুন জয়ের কারণগুলো দেখে নিই। ১)নারী শক্তির নীরব বিপ্লব: নীতিশ ফ্যাক্টর ও শেষ মুহূর্তের ১০০০০ টাকার চমক।

বিহারের রাজনীতিতে নারীরা যে কেবল ভোটার নন, বরং সবচেয়ে “নির্ণায়ক ভোটার” (most decisive voters)  হিসেবে গত বেশ কয়েকটা ভোটেই উঠে এসেছেন, তা আবার এই নির্বাচন স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে। এন ডি এ-র জয়ের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো মহিলাদের একচেটিয়া সমর্থন। নীতিশ কুমারের এই যে প্রায় ২০ বছরের শাসন জুড়েই মহিলারা তাঁকে ‘নিরাপত্তা’ এবং ‘মর্যাদা’র প্রতীক হিসেবে দেখেছেন। ঐতিহাসিক ডেটা দেখায় যে এই নির্বাচনে মহিলাদের ভোটদানের হার পুরুষদের চেয়ে ৫% থেকে ২০% পর্যন্ত বেশি ছিল, যা সুপাল, কিষাণগঞ্জ এবং মধুবনীর মতো অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ জেলায় ভোটের সমীকরণকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে । যা এনডিএ র পক্ষে গেছে। এই আস্থার ভিত্তিঘঠাৎ তৈরি হয়নি, তৈরি হয়েছিল বহু বছর ধরে চালানো তাঁর কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে। স্কুলছাত্রীদের জন্য ‘সাইকেল প্রকল্প’, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে ‘জীবিকা দিদি’দের উত্থান এবং সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন আনা ‘মদ্যপান নিষেধ’ (Prohibition) আইন মহিলাদের মধ্যে তাঁর জন্য এক দীর্ঘমেয়াদী ‘আস্থা’ তৈরি করেছিল ।

নির্বাচন কমিশন ১.৮ লক্ষেরও বেশি ‘জীবিকা দিদি’দের বুথ স্তরে মহিলাদের সংগঠিত করতে এবং তাঁদের ভোটদানে উৎসাহিত করার জন্য নিয়োগ করেছিলেন, যা আসলে বুথ স্তরে এন ডি এর ভোট বাড়িয়েছে। আপনি যদি এটাকে নির্বাচন কমিশনের একচোখোমি বলেন তো বলতেই পারেন, কিন্তু যেহেতু মহিলাদের সেলফ হেল্প গ্রুপ কোনও রাজনৈতিক সংগঠন নয়, তাই অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হবে। আর এই দীর্ঘমেয়াদী আস্থার ওপর ভিত্তি করেই এন ডি এ ভোটের ঠিক আগে এক কৌশলগত ‘মাস্টারস্ট্রোক’ চাল দিল। নির্বাচন ঘোষণার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে, মহিলাদের জন্য ₹১০০০০ টাকা সরাসরি তাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে (DBT) পাঠানো হয় । এটা ছিল এক “নির্ণায়ক ভূমিকা” । এই পদক্ষেপ কেবল তাৎক্ষণিক আর্থিক সহায়তা ছিল না, এটা ছিল কৃতজ্ঞতার সেই ভিত্তির ওপর ‘তাৎক্ষণিক বিনিয়োগ’ শাসক দলের ইনভেস্টমেন্ট। নীতিশ কুমারের সুশাসনের মাধ্যমে মহিলারা যে ‘কৃতজ্ঞতার ভিত্তি’ অনুভব করেছিলেন,১০০০০ টাকার এই ‘তাৎক্ষণিক সুবিধা’ দেবার পরে এন ডি এ ভোটের ঠিক আগে সেই কৃতজ্ঞতাকে ভোটদানের দিকে নিয়ে চলে গেল, ইভিএম উপচে পড়ল মহিলা ভোটে যার সিংহভাগ গেল এন ডি এ র দিকে।   আর মজার কথা হল বিরোধীদেরকে পাল্টা প্রচার চালানোর কোনো সুযোগ না দিয়ে নির্বাচনী ন্যারেটিভকে এক মুহূর্তে নারী-কেন্দ্রিক কল্যাণের দিকে নিয়ে যায়। এর ফলে নারী ভোটাররা এন ডি এ-কে “তাঁদের আশা ও আকাঙ্ক্ষার চ্যাম্পিয়ন” মনে করেই তাঁদের ভোট দিয়েছেন । ২) নতুন সামাজিক জোটের নির্মাণ: ইবিসি ভোটের দুর্গ আর উল্টোদিকে  দুর্বল MY মুসলমান যাদব সমীকরণ।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | প্রশান্ত কিশোরের জন সুরাজ কেন বাংলার সিপিএম হয়ে গেল? কেন ঠেকলেন শূন্যতে?

বিহারের জাতিভিত্তিক রাজনীতিতে এন ডি এ কেবল পুরোনো জোটের ওপর নির্ভর করেনি; তারা EBC (Extremely Backward Classes) এবং মহিলাদের একত্রিত করে একটি নতুন ‘ME’ (Mahila-EBC) ফ্যাক্টর তৈরি করে, যা RJD-এর ঐতিহ্যবাহী মুসলিম-যাদব (MY) জোটকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে । বিহারের জনসংখ্যার প্রায় ৩৬ শতাংশ জুড়ে রয়েছে ইবিসি জনগোষ্ঠী, যা ভোটের ফলাফলে এক বিশাল পার্থক্য গড়ে দিতে পারে, আর সেটাই হয়েছে । এই বিশাল সংখ্যক ভোটারকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা এনডিএ-র সাফল্যের  অন্যতম মূল চাবিকাঠি ছিল। বিজেপি উচ্চবর্ণ এবং কিছু অনগ্রসর শ্রেণীর ভোটব্যাঙ্ক কে ধরে রেখেছিল। অন্যদিকে নীতিশ কুমারের নেতৃত্বাধীন জে ডি ইউ দলিত কুর্মি, কৈরি আর ইবিসি ভোটকে নিজেদের ধারে নিয়ে গেছে।  নীতিশ কুমারের সুশাসন এবং ইবিসিদের জন্য সংরক্ষিত কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোর কারণেই এই ইবিসি মানুষজন এন ডি এ-কে সমর্থন জানিয়েছে, এটা অর্ধ সত্য, আসলে এই ইবিসিরা এর আগে ওই যাদব – মুসলমান ক্ষমতার সময়ে চরম অত্যাচার সহ্য করেছেন, কাজেই এবারে তাঁরা ওই  যাদব মুসলমানদের যত উঠে আসতে দেখেছেন, ততটাই শঙ্কিত হয়েছেন, আর তাদের ভোট জটড় হয়েছে এন ডি এর বাক্সে। RJD-এর ট্রাডিশনাল ভোট ব্যাঙ্ক ‘সংকীর্ণ’ MY জোটের কারণে ইবিসি এবং দলিতরা নিজেদের প্রান্তিক মনে করতে শুরু করেছিল, এবং নীতিশ কুমার ঠিক সেই জায়গাটাতেই তাঁর প্রকল্পগুলির মাধ্যমে তাদের আস্থা অর্জন করেন। ৩) দলিত ভোটের ইউনিফিকেশন আর চিরাগ পাসওয়ানের প্রভাব। দলিত ভোটাররা, যারা বিহারের জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ , ঐতিহাসিকভাবে বিভক্ত ছিলেন। কিন্তু এই নির্বাচনে এনডিএ তাদের জোটকে আরও প্রসারিত করে। লোক জনশক্তি পার্টি (রাম বিলাস), হিন্দুস্তানি আওয়াম মোর্চা (HAM(S)) এবং রাষ্ট্রীয় লোক মোর্চা (RLM) -এর মতো ছোট শরিকদের অন্তর্ভুক্তি দলিত এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর মধ্যে এন ডি এ-র গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়। বিশেষত চিরাগ পাসওয়ানকে নেবার ফলে দলিত ভোটের বিভাজনকে এন ডি এ-র দিকে ঘুরিয়ে দেয় । এই জোটের মাধ্যমে RJD-এর ঐতিহ্যবাহী MY জোটকে ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়, কারণ এন ডি এ একটি “বিস্তৃত কাঠামো” তৈরি করতে পেরেছিল, যা ইবিসি, অ-যাদব অনগ্রসর শ্রেণী এবং দলিতদের গুরুত্বপূর্ণ অংশকে ্টেনে এনেছে তাদের ধারে ।

এই বৃহত্তর সামাজিক ঐক্যের ফলেই এন ডি এ মহাগটবন্ধনের ৩৮ শতাংশ ভোটের উল্টোদিকে প্রায় ৪৯ শতাংশ ভোট নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়।  আর মেরুকরণ হওয়া প্রায় দুই জোটের লড়াই এ ৪৯% ভোট আর আর জেডির ওই ৩৮ % ভোটের ব্যবধান এই ঐতিহাসিক জয় এনে দিয়েছে এন ডি এ কে। চিরাগ পাসওয়ান এই নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ‘গেমচেঞ্জার’, তাঁকে NDA-র “তৃতীয় নায়ক”  যায়, তাঁর ভূমিকা ছিল একটা ‘ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার’-এর মতো, যিনি দলিত আরাাাাতারুণ্যের সমর্থন এনে দিয়েছেন এন ডি এ র দিকে।  এক্কেবারে ছোট্ট করে বলতে গেলে এই নির্বাচনে এন ডি এ দু’টি বিপরীত আবেগকে অত্যন্ত কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়েছে  ১) মহিলাদের ১০০০০ দিয়ে ‘আশা ও কৃতজ্ঞতা’ জাগানো এবং ২) ‘জঙ্গল রাজ’-এর ভয় দেখিয়ে ‘সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা’ তুলে ধরা । এই দুটো মেসেজ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে আর সেটাই সমস্ত হিসেব গুবলেট করে ছেড়েছে। এবং তারপরে যোগ হয়েছে নির্বাচন কমিশনের এস আই আর, ভোতার তালিকা যেখানে বহু মানুষের, বৈধ ভোটারের নাম কাটা গেছে, নির্বাচন কমিশন চুপ করে থেকেছে যখন নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ করেই নির্বাচন ঘোষনার ক ঘন্টা আগে টাকা পাঠানো হয়েছে দেড় লক্ষ মহিলার অ্যাকাউন্টে, নির্বাচন কমিশন সরকারি প্রকল্পের বেনিফিসিয়ারি জীবিকা দিদিদের দিয়ে বুথ ম্যানেজমেন্ট করিয়েছে যা সরাসরি এক অন্যায়। কিন্তু এসবের পরেও কেবল এইগুলো দিয়েই এন ডি এর এত বড় জয়কে ব্যাখ্যা করা যায় না। মহিলা ভোট, ইবিসি ভোট, চীরাগ পাশওয়ান কে আনা, প্রচার আর বিশাল খরচ করে সেই প্রচারকে গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দেওয়া, এই সবকিছু মিলেই এক জঙ্গল রাজের উথ্বানের ভয় কে সামনে রেখেই এন ডি এ এই বিপুল ভোটে বিহারে জিতেছে ।

Read More

Latest News