২০১৭ পয়লা জুলাইতে এক মাস্টারস্ট্রোকের বর্ণনা দিয়েছিলেন ভারতের মিডিয়ার অ্যাঙ্করেরা। মোদিজি তারও কিছু দিন আগে ২০১৬-র ৮ সেপ্টেম্বর মাঝরাতে সেই আগত সুখের দিনের কথা বলেছিলেন। কিছুদিন পর থেকেই সেই প্রথম জিএসটি লাগু নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা, বিরোধিতা। রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, ‘গব্বর সিং ট্যাক্স’ চালু করেছে মোদি সরকার। কদিন পরেই গুজরাতের ভোটের আগেই বেশ কিছু সংশোধনী আনার পরে মোদিজি গুজরাত গিয়েছিলেন। কেন? কারণ, সেখানে নির্বাচন ছিল। সেখানে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, এক নাদান কংগ্রেস নেতা এখনও মূর্খের মত কথা বলেই যাচ্ছেন, জিএসটি-র সুফল আর ক’মাসের মধ্যে মানুষের চোখের সামনে আসবে, তারা বিরোধীদের দেশ ছাড়া করবে। এরপরেও বার বার বহু সমস্যা এসেছে, আর বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনের আগে মোদিজি নানান জিনিসের জিএসটি কমিয়েছেন, আর সেটাকে প্রচারের বিষয় করে তুলেছেন। কিন্তু বহুদিন ধরেই এই জিএসটি-কে আগাপাশতালা সংশোধন করে আবার নতুন করে আনার দাবি বিভিন্ন মহল থেকে উঠছিল। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন বিভিন্ন দাবি তুলেছেন, রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা তো ছিলই। তো সবাই মিলে বসে কি একটা কিছু ঠিক হল? না, মোদিজির কাছে ইকনমিক্স, মার্কেট, এসব তো জলভাত। উনি তো সেই ছোট্ট বেলা থেকেই ‘এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারে, এক্সট্রা টু এ বি’ খুঁজে পেয়েছিলেন। তাই এসব বিষয়ে কারও সঙ্গে আলাপ আলোচনা করা প্রয়োজন তিনি মনে করেননি। এবারের ক্রোনলজিটা দেখুন। ৭ অগাস্ট ট্রাম্প জানালেন, তিনি ভারতের উপর ৫০ শতাংশ ট্যারিফ বসাতে চলেছেন, যদি তারা রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ না করে। ট্রাম্পের কথা শুনে রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করলে সরকার পড়ে যেত। এবং এটা পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল যে, এক সাংঘাতিক প্রভাব এর ফলে পড়তে চলেছে। সেই চাপানো ট্যারিফের কোপ পড়বেই সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। তাহলে কিছু তো একটা করতে হয়।
দুধ খাবো দুধ খাবো বলে অশ্বথ্বমা কাঁদছিল, তাঁর বাবা দ্রোণাচার্য আর কিছু না পেয়ে পিটুলি জল ধরিয়ে দিয়েছিলেন হাতে, “এই নে বাবা দুধ খা”। মোদিজি দ্রোণাচার্য হতে চেয়েছেন। ৫০ শতাংশ ট্যারিফের ঘা পড়ছে, রক্তাক্ত হচ্ছে শরীর, আর দু-তিন-চার মাসের মধ্যেই এমএসএমই-র উপর বড় চাপ পড়বে। ইতিমধ্যেই ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ফর এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট (Nabard)-এর করা এক সমীক্ষা বলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারতের পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। জুলাই মাসে যে ৭৫ শতাংশ গ্রামীণ পরিবার আশা করেছিল, আগামী ১২ মাসের মধ্যে তাদের আয় বাড়বে। সেপ্টেম্বরে তাদের সংখ্যা কমে ৭২.৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে আয়ের উন্নতির আশা করা মানুষের সংখ্যাও কমেছে। জুলাই মাসে ৫৬.৪ শতাংশ থেকে তা কমে ৫১.৬ শতাংশ হয়েছে। প্রথমবারের মতো ৫৪.৫ শতাংশ পরিবার শুধুমাত্র আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে। এখনও ২০ শতাংশ পরিবার কেবল অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস, যেমন- বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে। যদিও অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সুদের হার এখনও বেশি, গড়ে ১৭-১৮ শতাংশ। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পরিবারকে ২০ শতাংশের বেশি হারে সুদ দিতে হয়, কিন্তু তারা প্রাতিষ্ঠনিক ঋণ নিতেই ভয় পাচ্ছে। কারণ ছোট ছোট ঋণের আদায়ে ব্যাঙ্কের বাড়াবাড়ি সবাই জানে। হ্যাঁ, এখনও সরাসরি প্রভাব দেখাই যায়নি, ডেটা হাতে এসে পৌঁছবে আরও মাস চার পরে। কিন্তু এই ট্যারিফ চাপানোর ফলে ক্ষতি হবে সেই ধারণা জন্মেছে। ‘এইচওয়ানবি ভিসা’র ফি বাড়িয়ে ১ লক্ষ ডলার করার একদিনের মধ্যে শেয়ার বাজারে, আইটি সেক্টরে ঝাঁপ বন্ধ হওয়ার দশা। কাজেই সেই বাস্তব ধারণার পালটা এক ধারণা তৈরি করার জন্যই প্রধানমন্ত্রী ১৫ অগাস্ট লাল কেল্লা থেকে জানিয়ে দিলেন, আসছে আসছে দিপাবলী নবরাত্রির গিফট, আসছে। নতুন জিএসটি-তে ব্যপক ট্যাক্স কমানো হবে, আসিতেছে আসিতেছে।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদিজির নতুন মিথ্যের ঝুড়িটা খোলা যাক
এবার হাতে নাতে ফল। কেউ আর কিছু কেনে না। যাঁরা মনে করেছিলেন গাড়ি কিনবেন বা নিদেন পক্ষে একটা সাইকেল, তাঁরা আর বাজারে গেলেন না। গোটা অগাস্ট থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাজারে কচ্ছপ গতি দেখা গেল। ২২ তারিখ থেকে লাগু, উৎসবের বাজার। আগেই যে উৎসবের ডিসকাউন্ট দেওয়া হচ্ছিল, তা এখন জিএসটি-র ডিসকাউন্ট হয়ে গেল। কিন্তু তার সঙ্গে হাজারো সমস্যা, হাজারো প্রশ্ন, আবার। কারণ আবারও এক ধারণা তৈরি করার জন্যই তাড়াহুড়ো করেই এই সংশোধন করা হল। কার লাভ হবে? এমনিতেই দেখুন ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স মানেই গরীব লোকের ক্ষতি। কারণ তা বসানো হয় তো কনজিউমার প্রোডাক্টে। একটা গরীব মানুষ তার রোজগারের ১০০ শতাংশই খরচ করে খাবার কিনতে, ওষুধ কিনতে, বাসে ট্রেনে চড়তে। আর এই সবকিছুর উপরেই তো থাকে ঐ ট্যাক্স, যা এখন জিএসটি। একজন বড়লোক মানে ধরুন, দু’লক্ষ টাকা রোজগার করেন। তিনি তার আয়ের বড়জোর ২০-৩০ শতাংশ এগুলোর জন্য খরচ করেন, বাকি ইনভেস্ট করেন, বা এমন জিনিসে খরচ করেন যা আম আদমির নাগালের বাইরে। ৩০-৩৫ শতাংশ সেভিংস করেন। আম আদমির ১০০ শতাংশ খরচ, আর খরচের উপরে ট্যাক্স। তাই যে কোনও ভাবেই ট্যাক্স কমলে তো সাধারণ মানুষের সুবিধে হবেই। কিন্তু সেখানেও বহু প্রশ্ন থেকে যায়। ধরুন আটা। আপনার পাড়ার দোকানদার আটা কিনে আনছেন বড় বাজার থেকে ৫ শতাংশ জিএসটি, আনার খরচ আছে। তিনি আপনাকে বেচবেন কততে? শূন্য শতাংশ জিএসটি? তিনি কোনও ইনপুট ক্রেডিট পাবেন না। কিন্তু স্পেন্সার্স প্যাকেটে করে আটা বিক্রি করছে, ৫ শতাংশ জিএসটি, ইনপুট ক্রেডিট পাবেন, কাজেই দাম কমাতেও পেরেছেন। হ্যাঁ, এই মুহুর্তে স্পেন্সার্স-এ আটা বা ময়দার প্যাকেটের দাম কম, আপনার পাড়ায় শংকর মুদির দোকানে বেশি। সমস্যা শুধু এখানেই নয়, ছোট এমএসএমই, ইস্পাতের রড দিয়ে কিছু তৈরি করে, স্টিলের পাত দিয়ে কিছু তৈরি করে। তিনি ঐ ইস্পাত বা স্টিল কিনছেন ১৮ শতাংশ জিএসটি, বিক্রি করছেন ৫ শতাংশ জিএসটি। এখানে ঐ বাকি টাকাটা পেতে ওনাকে একবছর অপেক্ষা করতে হবে, মানে ওনার টাকা আটকে পড়ে থাকল। মানে দুটো উদাহরণে দেখুন- একদিকে লাভ বড় দোকানের, মলের, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের, ক্ষতি পারার মুদির। অন্যদিকে ছোট এমএসএমই, মানে মিডিয়াম বা স্মল নয়, মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রির পুঁজি আটকে দমবন্ধ হয়ে মরবে তারা। আসলে সব ভাবাই হয়নি। ট্রাম্প ৫০ শতাংশ ট্যারিফ চাপিয়েছে, চাপ বাড়বে, মানুষের ক্ষোভ বাড়বে, আমাদের মোদিজি জিএসটি কমিয়ে একটা ধারণা তৈরি করতে চাইছেন যে, এবার থেকে সব সস্তা হয়ে গেল। ৭ বছর ধরে লুঠ চলছিল, এবার কিছুটা দান-ধ্যান।
কিন্তু গতকালও বলেছিলাম, আজও বলছি এই যে, জিএসটি কম করা হল, এর একটা উল্টোদিকও আছে। যা কমানো হয়েছে, তাতে খুব কনজার্ভেটিভ হিসেব বলছে দেড় লক্ষ কোটি রেভিনিউ কমবে, মানে সরকারের আয় কমবে। দেড় লক্ষ কোটি। সেটা সবে কোথা থেকে? ডেফিসিট বাজেট, ঘাটতি বাজেট, টাকা ছাপা হবে, ইনফ্লেশন বাড়বে। আপনি গোটা মাসে সাধারণ হিসেব অনুযায়ী ৫৭ টাকা বাঁচাতে পারবেন, আর কিছুদিন পরে ৮৭ টাকা দাম বেড়ে যাবে, তখন এই আম জনতাকে সাড়ে তিন কেজি আটার বদলে তিন কেজি আটা কিনে ঘরে ফিরতে হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে, রাজ্যের ২০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি। কোথ্বেকে আসবে? বহু প্রকল্প বন্ধ হবে, হতেই হবে। এমনিতেই তো রাজ্যের ধার বাড়ছে, আর রাজ্য তো টাকা ছাপাতে পারে না। তার মানে হয়তো আপনার লক্ষ্মীর ভান্ডারে এবারে টাকা কমবে, হয়তো বাচ্চারা জামা জুতো পাবে না। কিন্তু আপাতত পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে মোদিজি বোজাতে চাইছেন যে, এই নতুন জিএসটি হল নবরাত্রির উপহার। দেশের মানুষকে হঠাৎ স্বদেশি হওয়ার জ্ঞান দিচ্ছেন, যিনি পকেটে ফ্রান্সের পেন, আর চোখে ইতালির চশমা রাখেন, সেই মোদিজি দেশের মানুষকে চিঠি দিয়ে বলছেন, ‘যত বার আপনি দেশে তৈরি দ্রব্য কিনবেন, তত বার অসংখ্য পরিবারকে আয়ের সুযোগ করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যুব সমাজের জন্য চাকরির দরজা খুলে দেবেন।’ যতবার কিনবেন মানে? কিনবে কী দিয়ে? গত ১০ বছরে ৭০ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে বা বাড়েনি। চাকরির সুযোগ কমছে। তবুও বলি এই জিএসটি-র তথ্য আসবে আরও মাস খানেক পরে। এখন উৎসবের সময়, এমনিই কেনাকাটা বেশি হবে। কিন্তু মাসখানেক পর থেকে যে তথ্য আসবে সেখান থেকেই জানা যাবে, কতটা রেভিনিউ কমল, আর কী দিয়ে সেই ঘাটতি পুরণ করা হবে, সেটাও দেখার। আপাওতত মোদিজির জুমলা শোনা ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর নেই আমাদের।