Friday, September 12, 2025
বাঙালি কাউন্টডাউন
HomeFourth Pillar | ইজরায়েল ধ্বংসের মুখে অথবা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ?

Fourth Pillar | ইজরায়েল ধ্বংসের মুখে অথবা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ?

খেয়াল করে দেখেছেন যে বিজ্ঞান এখন যুদ্ধের লক্ষ্যবস্তু, আসলে যে কোনও যুদ্ধই সভ্যতার বিরুদ্ধে লড়া হয়, আগ্রাসী ফাসিস্ত হিটলারকে আটকাতেও যে যুদ্ধ হয়েছিল তা জার্মানির বিজ্ঞান গবেষণাকে ধ্বংস করেছিল, এক বেড়ে উঠতে থাকা জাতি, এক সভ্য শিক্ষিত জাতি তার নেতার পাপের, অন্যায়ের বিরাট খেসারত দিয়েছিল। এই মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যাবে, অনেক বছর ধরে ইজরায়েল ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করে আসছিল, যাতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি থেমে যায়। এমনকী এই সাম্প্রতিক যুদ্ধ শুরুই হয়েছিল ১৩ জুন, বেশ কিছু ইরানের বৈজ্ঞানিককে হত্যা করেই। এবার উল্টো ঘটনা ঘটেছে— ইজরায়েলের বিজ্ঞানীরাই টার্গেটে। গত রবিবার, ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ইজরায়েলের অন্যতম নামকরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউটে আঘাত হানে। কেউ মারা না গেলেও একাধিক গবেষণাগার ধ্বংস হয়ে যায়। বছরের পর বছর ধরে চলা বহু গবেষকের গবেষণা মুহূর্তেই মুছে গেছে। ইজরায়েলি বিজ্ঞানীরা এখন বুঝতে পারছেন, যুদ্ধ শুধু সেনাদের নয়, তাদের মতো গবেষকরাও যুদ্ধের টার্গেট। ইজরায়েলের মলিকিউলার সেল বায়োলজির অধ্যাপক ওরেন শুলডিনার বলেন, “এটা ইরানের কাছে এক ধরনের নৈতিক জয়। ওরা ইজরায়েলের বিজ্ঞানের মুকুট রত্নে আঘাত করেছে।”

কিন্তু তাতে কি যুদ্ধ থামবে? উলটে আরও বাড়ার কিছু ইঙ্গিত তো এখনই পাওয়া যাচ্ছে। গত সপ্তাহে ইজরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করে। সেনাবাহিনীর প্রধান, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের বৈজ্ঞানিকদের বেছে বেছে খুন করে, তো এটার পরে ইরান তো চুপ করে বসে থাকবে না, সেটা ইজরায়েল জানত, আমেরিকাও জানত। অতএব সেই হত্যাকাণ্ড আর হামলার জবাবে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে। আর সেই যুদ্ধ চলছে, দুই দেশের আকাশে মিসাইল, রকেট, ঘরবাড়ি ধ্বংসের ছবি আমরা দেখছি আর সেই যুদ্ধের মাঝেই রাশিয়া আমেরিকাকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে— এই যুদ্ধে জড়ালে তার ভয়াবহ পরিণতি হবে। আগে ততটা ছিল না কিন্তু রাশিয়া ও ইরানের সম্পর্ক এখন বেশ ঘনিষ্ঠ। কিছুদিন আগেই তারা কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তবে এখনও রাশিয়া ইরানকে অন্তত প্রকাশ্যে কোনও সামরিক সহায়তা দেয়নি। কিন্তু চুপ করে বসেও নেই। ক্রেমলিন জানায়, “আমরা আমেরিকাকে স্পষ্টভাবে জানাচ্ছি— এই যুদ্ধে সামরিকভাবে জড়ানো খুবই বিপজ্জনক হবে।” পুতিন বলেছেন, ইরান এখনও তাদের কাছে সামরিক সাহায্য চায়নি, এবং জানুয়ারিতে সই হওয়া চুক্তিটাও সামরিক জোট নয়। তাই এখনও কোনও সামরিক সাহায্য দেওয়ার প্রশ্নও নেই কিন্তু “খামেইনি যদি নিহত হন, হ্যাঁ এইটুকু বলেই থমকে গেছেন পুতিন, বলেছেন, এই প্রসঙ্গ নিয়েই আলোচনা করতে চাই না।” বরং জানিয়েছেব, ইরান চাইলে তারা মানবিক সহায়তা পাঠাতে রাজি।

কেবল রাশিয়া নাকি, আসরে হাজির চীনও। গত বৃহস্পতিবার রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং টেলিফোনে কথা বলেছেন। দু’জনেই ইজরায়েলের হামলার তীব্র নিন্দা জানান এবং বলেন, যুদ্ধ থামানোর একমাত্র উপায় কূটনৈতিক সমাধান। প্রেসিডেন্ট শি বলেন, “এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হল যুদ্ধবিরতি। অস্ত্র দিয়ে কোনও আন্তর্জাতিক বিরোধের সমাধান হয় না। বিশেষ করে ইজরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধ করতেই হবে, না হলে এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়বে।” মানে হল আমেরিকার সামান্য কথাবার্তায় ইরানের পাশে দাঁড়িয়েছে চীন আর রাশিয়া, এবং খেয়াল করুন, এরা ইসলামিক দেশ নয়। বিপদ তো তখন আরও বড় হবে যখন সারা বিশ্বের ইসলামিক দেশের মানুষের চাপে তাদের সরকারগুলো মাঠে নামবে, পাকিস্তানের মুনির আর ট্রাম্পের যাবতীয় আলোচনা ভেসে যাবে করাচির রাস্তায়। ১৩ জুন থেকে ইজরায়েল সরাসরি ইরানে হামলা চালায়। তেহরানে টার্গেট করে হত্যা করে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, রেভলিউশনারি গার্ডের কমান্ডার, ছয়জনের বেশি পরমাণু বিজ্ঞানী ও শীর্ষ জেনারেলদের। তখন ইজরায়েল বলেছিল, তারা ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করতে চায়। কেন ভাই? পরমাণু বানাবার গ্লোবাল টেন্ডার কি ওয়াশিংটন থেকে ট্রাম্প সাহেব দিচ্ছেন? ইজরায়েল আন-অফিসিয়ালি পরমাণু অস্ত্রধর শক্তি, তাদের কাছে পরমাণু অস্ত্র আছে, তার পাশের দেশ পরমাণু অস্ত্র তৈরি করবে না আপেল চাষ করবে তাতে তাদের কিছু বলার তো অধিকার নেই।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | জরুরি অবস্থা সমর্থনের লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আরএসএস

আসলে এ এক ধরনের ‘ডিসক্যাপিটেশন স্ট্র্যাটেজি’— অর্থাৎ গোটা রাষ্ট্রের মাথা কেটে ফেলার চেষ্টা। স্বাভাবিকভাবেই ইরান দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। একই দিনেই শত শত ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুড়েছে ইজরায়েলে। হাইফার তেল শোধনাগার, ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউট, এবং বিয়ারশেভার সরোকা হাসপাতালসহ বহু জায়গা বিধ্বস্ত। মাথায় রাখুন ইজরায়েলের ম্যাপ আর ইরানের ম্যাপ, মাথায় রাখুন ইজরায়েলের জনসংখ্যা আর ইরানের জনসংখ্যা। মাথায় রাখুন ইরানের হাজার বছরের ইতিহাসে তাতার, মোগল, হুন, শকদের আক্রমণ। তারা এসব পেরিয়েই দেশে আছে। ইজরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের দাবি, “আমরা আকাশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছি, তারা নাকি তেহরানের আকাশে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইরানের এক-তৃতীয়াংশ মিসাইল লঞ্চার ধ্বংস করে দিয়েছে। তবুও, ইরান প্রতিদিন ডজন ডজন ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুড়ে যাচ্ছে, যা ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভীষণভাবে চাপে ফেলছে। অন্য কেউ নয় ১৮ জুন এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, ইজরায়েলের ‘অ্যারো’ মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রায় শেষ হয়ে আসছে, আমেরিকার স্টকও দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, ভেঙে পড়ছে আয়রন ডোম, শেষ হচ্ছে যুদ্ধের রসদ। দেওয়ালে দেওয়ালে আবেদন, মিঃ প্রেসিডেন্ট, নাউ, ফিনিশ দ্য ওয়ার। রাষ্ট্রপতি, এবার আপনি যুদ্ধটাকে শেষ করুন। কোন রাষ্ট্রপতি? পাশে ছবি ডোনাল্ড ট্রাম্পের। হ্যাঁ, আপাতত ইজরায়েলের ভরসা।

তাকিয়ে দেখুন ওই মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে থমথমে অবস্থাটার দিকে, জর্ডন চুপ করে দেখছে মিসাইলের আনাগোনা, হিজবুল্লাহ হামাস থেকে হুথি, কেউ কোনও কথা বলছে না, অন্য কিছু চলছে সেখানে? নিশ্চয়ই চলছে। ঘিরে ধরে মারার পরিকল্পনা চলছে তো নিশ্চয়ই। মুখোমুখি যুদ্ধ হতেই পারে, কিন্তু সেখানে কেবল ইরান আর ইজরায়েল থাকবে কি? কী হবে ভবিষ্যৎ? হ্যাঁ এখনও দু’পক্ষই একে অপরকে আঘাত করে চলেছে। ইরান বড় ক্ষতির মুখে পড়লেও সরকারের মনোবল ভাঙেনি। এমনকী সরকারের সমালোচক, শান্তিতে নোবেলজয়ী নার্গিস মোহাম্মদি পর্যন্ত ইজরায়েলের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। ইজরায়েল আকাশে স্বাধীনভাবে হামলা চালাতে পারছে, কিন্তু ইরান তাদের থেকে ৭৫ গুণ বড়। ইরানের হাতে হাজার হাজার মিসাইল আছে। আর ইজরায়েলের হাতে নেই সেই শক্তিশালী বোমা, যা দিয়ে ইরানের শক্ত দুর্গনির্মিত পরমাণু কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করা যায়। কাজেই এখন সব্বার চোখ যুক্তরাষ্ট্র কী করবে? ট্রাম্পের সিদ্ধান্তই কি নির্ধারণ করবে যুদ্ধের ভবিষ্যৎ? ইজরায়েল চায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে নামুক। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতিমধ্যেই ইরানের কাছে ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’ দাবি করেছেন। জবাবে খামেইনি স্পষ্ট বলেছেন, তাঁরা কখনই আত্মসমর্পণ করবেন না— উল্টে যুক্তরাষ্ট্র জড়ালে তার ভয়ঙ্কর পরিণতি হবে। মানে অন্তত প্রকাশ্যে ইরানকে এতটুকুও ভীত দেখাচ্ছে না।

এখন ট্রাম্পের হাতে দুটি রাস্তা: ১) নেতানিয়াহুকে থামানো, যুদ্ধ বন্ধ করা। ইরান তো বলেছেই, ইজরায়েল হামলা বন্ধ করলেই তারা মিসাইল ছোড়া বন্ধ করবে। ২) যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, কিন্তু তার মানে হবে, ইরান আরও আঘাত করবে, আর নেতানিয়াহুর ঘরে-বাইরে চাপ বাড়বে। একলা ইজরায়েল বেশিদিন এই যুদ্ধ টানতে পারবে না। তাহলে পরের অপশন হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে নেমে পড়া। যদি যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে নেমে পড়ে, ইরানের সামনে তিনটি উপায় তো খোলাই আছে। ১) মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে আক্রমণকে ছড়িয়ে দেওয়া। পশ্চিম এশিয়ায় ৪০,০০০ মার্কিন সেনা আছে। ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিতে ইরান-ঘনিষ্ঠ মিলিশিয়ারা আগে থেকেই সক্রিয়। ২) হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া: এই সমুদ্রপথ দিয়েই বিশ্ব তেলের ২০ শতাংশ পরিবহণ হয়। যদি ইরান এটিকে মাইন পেতে বা নৌবাহিনী দিয়ে বন্ধ করে দেয়, বিশ্ব অর্থনীতিতে ভয়ানক প্রভাব পড়বে। সারা বিশ্ব থেকে চাপ আসবে ইজরায়েল, আমেরিকার উপরে। শেষেরটা আরও সাংঘাতিক, NPT, নন পলিফারেশন ট্রিটি, চুক্তি ত্যাগ করা: পরমাণু অস্ত্র বিস্তার প্রতিরোধ চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলে ইরান আর IAEA-র কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে না। ২০০৩ সালে উত্তর কোরিয়া এই পথেই হেঁটে ২০০৬-এ পারমাণবিক পরীক্ষা করে। এখন উত্তর কোরিয়া যা করার করেই চলেছে, কেউ আটকানোর সাহস করে? করে না, কারণ তাদের হাতে পারমাণবিক হাতিয়ার আছে। আজ মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের কাছে পারমাণবিক হাতিয়ার থাকলে যুদ্ধ হত? কেবল মুখে বাতেলাবাজি চলত। তবে সমস্যা হল, এই তিনটি রাস্তাই যুদ্ধকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলবে। এই যুদ্ধে কোনও থামার রাস্তা নেই— এখনও পর্যন্ত ইরান ও ইজরায়েল কেউই এখনও যুদ্ধ বন্ধ করার রাস্তা খুঁজছে না। দু’পক্ষের মধ্যে ক্রমাগত আঘাত পাল্টা আঘাতে অঞ্চলজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে। আর এখন গোটা দুনিয়ার চোখ ট্রাম্পের দিকে— তিনি কী করেন, সেটাই নির্ধারণ করবে, যুদ্ধ থামবে না আরও জ্বলবে। সমস্যা হল তিনি যদি যুদ্ধে না নামেন তাহলে ইজরায়েল ধ্বংস হয়ে যাবে, আর তিনি যদি যুদ্ধে নামেন, তাহলে রাশিয়া, চীন মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, যা পৃথিবীকে এক তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবেই।

Read More

Latest News