Tuesday, September 2, 2025
HomeScrollFourth Pillar | চাপে পড়ে বাপ বলছেন মোদিজি

Fourth Pillar | চাপে পড়ে বাপ বলছেন মোদিজি

চীন কি ভারতের বাণিজ্যভূমি হবে? মানে চীনে প্রচুর রফতানি বাড়বে?

ডোনাল্ড ট্রাম্প আর কিছু পারুন না পারুন, রাশিয়া-চীনের বন্ধুত্বকে মজবুত করলেন আর ভারত-চীন সম্পর্ককে এক নতুন মাত্রা দিলেন। এই ক্রেডিট কিন্তু ট্রাম্প সাহেব দাবি করতেই পারেন। হ্যাঁ, দুনিয়ার রাজনীতিতে এক প্যারাডাইম শিফট আমরা দেখছি। সত্যিই সেই সম্পর্ক কতটা গাঢ় হয়, কতটা আন্তরিক হয় সেটা দেখার, কিন্তু আপাতত ট্রাম্প সাহেবের চাপে দুনিয়ার রাজনৈতিক সমীকরণ বদলাচ্ছে। অতঃপর মোদিজি মাই ডিয়ার দোলান্দ ট্রাম্প থেকে ডিয়ার মিঃ শি জিনপিংয়ে পৌঁছে গেছেন। না, আগের মতো নেতা দেখলেই জড়াজড়ি উনি করেননি, খানিকটা ঠেকে শিখেছেন বলাই যায়, এবারে স্রেফ করমর্দন আর হাসি। বন্ধু ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ ট্যারিফ চাপানোর পরে মোদিজি এখন আমেরিকা ভুলে চীন রাশিয়ার দিকে তাকাচ্ছেন। অসুবিধে কোথায়? সুবিধে কোথায়? আসছি সেই আলোচনায়। ওদিকে শি জিনপিংয়ের কাছে এর থেকে ভালো সময় আর হতে পারে না। গত উইক এন্ডে ভারত আর রাশিয়ার মোদি, পুতিন চীনে এসসিও সম্মেলনে ওঁর সঙ্গে কেবল যোগ দিলেন এমন নয়, বরং যোগ দিতে বাধ্য হলেন। চীনের একলা হয়ে যাওয়ার এক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, সেটার থেকে বেরিয়ে এলেন শি জিনপিং।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য আমেরিকার পণ্য রপ্তানির উপর লাগানো ট্যারিফ ওয়াশিংটন থেকে দূরত্ব তৈরি করে দিল, ভারতকে বাধ্য হয়েই বিকল্প রাস্তা বেছে নিতেই হচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির ভি পুতিনের জন্য, ট্রাম্পের আলাস্কাতে দেওয়া লাল গালিচার সংবর্ধনার পরেও ইউক্রেন আক্রমণের জন্য শাস্তির হুমকি তাঁকে বাধ্য করেছেন নতুন জোট বাঁধার জন্য। আর এই সবকিছুর মধ্যে আছেন শি জিনপিং। তিনি আমেরিকার ভারতকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছেন আর পুতিনের সঙ্গে বা রাশিয়ার সঙ্গে চীনের পুরনো সম্পর্ককে ঝালিয়ে নিচ্ছেন। সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের এই সম্মেলনে ২০ জনের বেশি নেতা যোগ দিয়েছেন, এঁদের বেশিরভাগই মধ্য এশিয়ার। এদের কারও কারও সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ইদানিং কিছুটা বাজে চেহারা নিচ্ছিল, কিন্তু সব্বাই এই সম্মেলনে ভারতের বা মোদিজির অংশগ্রহণকে খানিক রেলিশ করেছেন, উপভোগ করেছেন, অব আয়া উঁট পাহাড়কে নীচে, এরকম একটা ব্যাপার। সম্মেলনের পরে বেজিংয়ে চীনের নতুন মিসাইল আর যুদ্ধবিমান নিয়ে সামরিক কুচকাওয়াজও হয়েছে। আসলে শি জিনপিং কীভাবে ইতিহাস, কূটনীতি আর সামরিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বব্যবস্থাকে নতুন করে সাজাতে চাইছেন, সেটা খুব পরিষ্কার, যেখানে এতদিন আমেরিকারই আধিপত্য ছিল, সেই আধিপত্য ভেঙে ড্রাগনের নাচ দেখব আমরা।

এবং মোদিজির বন্ধুরা, আরএসএস–বিজেপির থিঙ্ক ট্যাঙ্করা, যারা ক’দিন আগেও ড্রাগনের মুখে আগুন ছাড়া কিছুই দেখতেন না, দেশের মানুষকে দেখানোর জন্যই যে সমস্ত মোবাইল অ্যাপ টিকটক ইত্যাদি ব্যান করে চীনকে শিক্ষা দেওয়ার কথা বলছিলেন, তাঁরাই এখন আহা রে চীনপন্থী হয়ে গেছেন। মাত্র ক’ বছর আগে ওই থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, গোদি মিডিয়া, এ রাজ্যের ডিমের কুসুম অ্যাঙ্কর বা দলের কর্মীরা ট্রাম্প সাহেবের জেতার প্রার্থনা করতেন, ট্রাম্প জিতলে কীভাবে দেশের মধ্যে উন্নয়নের বান ডেকে যাবে তা বোঝাতেন, সেই তাঁরাই এখন ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে চীনের প্রশংসা করছেন, রাশিয়ার তেল কী ভালো বলে হাঁক পাড়ছেন, আর মোদিজির চীনের দিকে ঝুঁকে পড়াটাকে মাস্টার স্ট্রোক হিসেবে বর্ণনা করছেন। পাড়ায় পাড়ায় যাঁরা ট্রাম্প সাহেবের জেতার জন্য যজ্ঞ করেছিলেন তাঁরাই এখন শি জিনপিংয়ের আয়ু বাড়ানোর কামনা করছেন। কিন্তু এরই মধ্যে শি জিনপিং যা করার সেটা কিন্তু করে যাচ্ছেন, মানে সীমান্ত থেকে একটা সেনাও সরাননি, যে সেনা ছাউনিগুলো তৈরি হচ্ছিল সেগুলোর কাজ শেষ, ভারতের যে ভূখণ্ড চীনের হাতে, তা ওনাদের হাতেই আছে, যে বোল্ট আন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের চওড়া রাস্তা আমাদের সীমান্ত বরাবর তারা তৈরি করছিল এখন সেই কাজে গতি এসেছে আর আকসাই চীন তাদের দখলেই আছে। সবথেকে বড় কথা এই ক’দিন আগে ভারত-পাক যুদ্ধে পাকিস্তানকে চীন যেভাবে তথ্য আর অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল তা নিয়ে মোদিজি আর কোনও প্রশ্ন তুলছেনই না। এটাই আদতে শি জিনপিংয়ের বিদেশনীতির সাফল্যের প্রমাণ, বিভিন্ন দেশের নেতারা চীনে আসছেন। যাঁরা কিছুদিন আগেও ভরসা রাখতেন আমেরিকার উপরে, সেই তারাই শত্রু মিত্র নির্বিশেষে ভরসা রাখছেন শি জিনপিংয়ের উপরে।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | অসমে বাংলা বললে আর গণতন্ত্রের কথা তুললেই আপনি জেলে

বুধবার শি বেইজিং-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটা সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করবেন। এখানে অবশ্যই বলা হবে যে এই যুদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে জেতা হয়েছিল। তার আগেই নিজের বক্তৃতায় শি জিনপিং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে এমন একটা যুদ্ধ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যেখানে চীন আর সোভিয়েত ইউনিয়নই যুদ্ধের মূল ক্ষেত্র ছিল। যেটার সঙ্গে পুতিনও একমত, পশ্চিমের দেশগুলো দাবি করে তারাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয় এনেছিল, কিন্তু ইতিহাস তো বলছে অন্য কথা, চীন, রাশিয়া, এই দুই দেশে কোটি কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। পশ্চিমা দেশগুলো যুদ্ধের সময় আর পরে যেসব চুক্তি হয়েছিল, সেগুলোকে উপেক্ষা করেছে। বিশেষ করে আমেরিকা একটা জেতা যুদ্ধের উপরে নিজের কৃতিত্বের দাবি ফলানোর জন্যই দু’ দুটো পারমাণবিক বোমা ফেলে এক জঘন্য নরসংহারের কাজ করেছিল। হ্যাঁ, এইসব কথা এখন পুতিন বা শি জিনপিং বলছেন, কিন্তু ভারত? সে তো খ্যাঁচাকলে। এসব এড়ানোর জন্যই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই গত মাসে আলাস্কায় পুতিনের খুব প্রশংসা করেন আর পরে ক্রেমলিনের সেই অবস্থানকেও সমর্থন করেন যেখানে বলা হয়েছিল যে যুদ্ধ শেষ করার জন্য ইউক্রেনকে কিছু জমি ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু তারপরেই ইউরোপের চাপে তাঁর সুর বদলায়, রাশিয়াও সম্ভবত আর দু’ নৌকোতে পা না দিয়ে এক পক্ষ এক জোট তৈরির কাজে হাত দিয়েছে। মানে মোদ্দা কথা হল এই দু’ দেশ তাদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই সমীকরণ বদলাচ্ছে। ভারত সেই জোটে গিয়ে আপাতত আমরা একটা জোটে আছি, ইত্যাদি বুঝিয়ে খানিক মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা হলেও আদৌ কোন লাভটা তাদের হবে দেখা যাক।

চীন কি ভারতের বাণিজ্যভূমি হবে? মানে চীনে প্রচুর রফতানি বাড়বে? কোনও প্রশ্নই নেই। না ডেয়ারি প্রডাক্ট, না চিংড়ি, না চামড়া, না বস্ত্র, কোনওটাই আমরা চীনে পাঠাই না, বরং চীন সেগুলো অন্য দেশে রফতানি করে। আর এমনিতেই চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি ৯৯.২ বিলিয়ন ডলার, আমরা এই বছরে চীন থেকে আমদানি করেছি ১১৩.৪৫ বিলিয়ন ডলার, তার মানে রফতানি করেছি ১৪ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি। কিন্তু আমেরিকার সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল না, ছিল সারপ্লাস, মানে আমরা রফতানি বেশি করতাম, আমদানি কম। কত? ৪৫ বিলিয়ন ডলার আমাদের ঘরে থাকত, ১২৯ বিলিয়ন ডলার আমরা রফতানি করতাম আর ৮৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি করতাম। এবারে সেই ১২৯ বিলিয়ন ডলার রফতানির কী হবে? বিভিন্ন হিসেব বলছে ৭০ থেকে ৭৫ বিলিয়ন ডলার রফতানি কমে যাবে। সেই ফারাকটা, মানে ওই ৭০-৭৫ বিলিয়ন ডলার আসবে কোত্থেকে? সেটা কি আমরা শি জিনপিংয়ের দেশের থেকে পাব? আবার সেই হিসেব বলছে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক যাই হোক না কেন, রফতানির পরিমাণে বিরাট কিছু পরিবর্তন ছেড়েই দিন, সামান্য পরিবর্তনও হবে না। তাহলে? রাশিয়া? সেখানেও আমরা ট্রেড ডেফিসিট মানে বাণিজ্য ঘাটতিতেই আছি, আমদানি বেশি, রপ্তানি কম, ঘাটতির পরিমাণ ৫৮.৯ বিলিয়ন ডলার। তারমানে এটাও নয় যে আমেরিকা যা চাইবে বলবে, যা চাইবে করবে আর আমাদের কেবল বাণিজ্যের কথা ভেবেই সব কিছু মেনে নিতে হবে। না, এরকম এক্কেবারেই নয়। কিন্তু দুটো জিনিষ বিরাটভাবে আমাদের দেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ককে এই জায়গাতে নিয়ে গেছে, ১) ভীষণভাবে এক আদেখলেপনা ট্রাম্পকে ঘিরে, হাউডি মোডি, অবকি বার ট্রাম্প সরকার ইত্যাদি বিষয়গুলো ভারতের মর্যাদা নষ্ট করেছে, সবটাই তেনার মর্জি মাফিক চলেছে। ২) রাশিয়ার থেকে তেল নেওয়ার নাম করে দেশের লাভের কথা ভুলে আম্বানিদের লাভের কথা ভেবেই যদি বিদেশনীতি চলে, তাহলে তা কোনও না কোনওদিন সমস্যা তৈরি করতই। আর এই দুটোই মোদি সরকারের দান। তাহলে এখন কী? সংকটে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করাটাই হল প্রথম কথা।

ট্রাম্প মেরেছে ওমনি শি জিনপিংকে ধরে ঝুলে পড়লাম, এটা তো কোনও কাজের কথা হতে পারে না। কারণ ট্রাম্প সাহেব মানেই আমেরিকা নয়, ট্রাম্প সাহেব থাকবেন আরও দু বছর, তারপরে এক লেম অ্যান্ড ডাক সরকার, নির্বাচনের পর রিপাবলিক বা ডেমোক্র্যাট যেই আসুক অন্য কেউ আসবে, কাজেই সেই পর্যন্ত ধৈর্য ধরে বসে থাকা আর নতুন বাণিজ্যের সম্ভাবনাগুলোকে খতিয়ে দেখা। চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করা, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা আর সবচেয়ে বেশি জরুরি হল প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে, মধ্য এশিয়ার ছোট দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে ভালো করে তোলা। রবিবার মোদির সঙ্গে এক বৈঠকে শি বলেছেন যে চীন আর ভারতকে “প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং একে অপরের অংশীদার” হতে হবে। আর তাদের “একে অন্যের বিকাশের জন্য হুমকি নয়, বরং সুযোগ” দেওয়া উচিত। এটা অবশ্যই ট্রাম্পের জন্যই বলা হয়েছে বলে ধরা যায়। এবং বলেছেন যে দুই দেশের মধ্যেকার সীমান্ত নিয়ে ঝামেলা যেন তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে খারাপ না করে। ভালো প্রতিবেশী আর বন্ধু হওয়া, একে অপরের সাফল্যে অংশীদার হওয়া আর ‘ড্রাগন আর হাতির নাচ’ দেখানো চীন আর ভারত দু’ দেশের জন্যই সঠিক রাস্তা। মোদিজিও জবাবে ভালো ভালো কথা বলেছেন। কিন্তু ভালো কথাই তো কূটনীতি নয়, হিন্দি চীনি ভাই ভাই স্লোগানের এক বছরের মধ্যেই চীন-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল। কাজেই ওই পেন্ডুলামের মতো একবার এদিকে একবার ওদিকে না হেলে পড়ে ভারতের উচিত এক স্বাধীন জোট নিরপেক্ষ নীতিকে তুলে ধরা, দুনিয়ার নিপীড়িত দেশের স্বার্থের দিকে নজর রাখা আর যে কোনও মূল্যে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করা। হ্যাঁ, মোদিজির কাছে দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে হলেও এটাই ছিল স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বিদেশনীতি।

Read More

Latest News