কেউ কেউ মাঝে-মধ্যেই বলেন যে সিপিএম তো শূন্য তাহলে তাদের নিয়ে আলোচনা কেন? তাদের সমালোচনাই বা কেন? আসলে কী জানেন, মাঝে-মধ্যে না বিশ্বাসই হয় না যে, সিপিএম বিধানসভাতে শূন্য, পাড়ার মোড়ে শূন্য। এলসি অফিস থেকে আর ডাক আসবে না, ঘন্টা’দা এসে বলে যাবে না যে, কমরেড এলসিএস বিকেলে ডেকে পাঠিয়েছে, সেই কাঁপতে কাঁপতে বলির পাঁঠার মত গিয়ে দাঁড়ানোর দিন শেষ। তো সেসব গিয়ে যে এক স্বর্গরাজ্য তৈরি হয়েছে তাও তো নয়, এখন এলসি অফিসে যেতে হয় না। কিন্তু তেনারাই চলে আসেন, বাড়ি করলে স্কোয়ার ফুট ইঞ্চি মেপেই পয়সা নিয়ে যান, কোথাও কোথাও একের বেশি সাধারণ সম্পাদক আছে, সেখানে দু’জন, কখনও সখনও তিনজনকেই প্রণামী বুঝিয়ে দিতে হয়। সেসব আছে। কিন্তু সিপিএম নেই এটা তো একটা ব্যাপার, সেটা এক আশ্চর্য ব্যাপারও বটে। সবে যখন আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম যে, আমাদের নাত জামাইয়ের নাত বৌ এসে দেওয়ালে কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে সিপিএম-এর লেখা স্লোগান দেখবে, ঠিক তখনই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল সিপিএম সাম্রাজ্য, এবং সেই সেন, পাল, গুপ্ত বা মোঘল সাম্রাজ্যের মতোই আজ তার চিহ্ন মাত্র নেই। বিধানসভায় গতকাল কত কেলো। এ ওকে চোর বলছে, সে তাকে চোর বলছে, কিন্তু সেখানে সিপিএম অনুপস্থিত। তাহলে কেন আলোচনা হবে? হবে কারণ বাইরে সুজন চক্রবর্তী আছেন। নিয়ম করে বিধানসভায় কী কী হল খবর নিয়েই তিনি সাংবাদিকদের জানিয়ে দেন, ওনারা থাকলে কী কী হত। সেটাই বিষয় আজকে, বিধানসভা এবং কমরেড সুজন চক্রবর্তীর কিছু কথা।
বিধানসভায় দাঁড়িয়েই প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-সহ বিজেপিকে ‘চোর’, ‘ডাকাত’ এবং ‘লুটেরা’ বললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগেই তাঁকে আর তাঁর দলকে ‘চাকরি চোর’, ‘বালি চোর’, ‘কয়লা চোর’ বলে পাল্টা আক্রমণ করলেন বিরোধী দল বিজেপির বিধায়কেরা। মানে ‘খাপে-খাপ, পঞ্চুর বাপ’। আর এসবের মাঝখানে মার্শাল দিয়ে সভা থেকে কিছু বিজেপি বিধায়ককে বার করা, বার করতে গিয়ে শঙ্কর ঘোষের অসুস্থ হয়ে পড়া – এসব ছবি পাবলিক দেখে ফেলেছে। দু’জনের কাছে অন্যরা যে চোর তার ঘড়া-ঘড়া উদাহরণ আছে, আর সেসব বহুচর্চিত কাজেই সংবাদমাধ্যম কতক্ষণ আর সেই একই ছবি দেখাবে। ‘কহানি মে টুইস্ট’ আনার জন্যই তাঁরা এইরকম এক মুহুর্তে বিভিন্ন দলের নেতা নেত্রীদের কাছে চলে যান, সেরকমই মিডিয়া চলে গেল কমরেড সুজন চক্রবর্তীদের কাছে। এবার ওনারা তো বিধানসভাতে নেই, ফেসবুকে আছেন। কিন্তু আমরা মনে করি ওনাদের বক্তব্যও তুলে ধরা দরকার। সেই জন্য আমরাও গিয়েছিলাম। সুজন বাবু জানালেন, সবটাই নাকি নাটক চলছে। সব ‘গট-আপ গেম’। বিরোধীরা একে অন্যকে দোষারোপ করবেন, চোর বলবেন, আরও কত কিছু বলবেন – সে তো স্বাভাবিক, কিন্তু সেগুলো সব ‘গট-আপ’? তো কমরেড সুজন চক্রবর্তী খোলসা করেই জানিয়েছেন, আসলে এই দুটো দল এক, একে অন্যের পরিপূরক, মানে যাহাঁ বিজেপি তাঁহা তৃণমূল। কোনও তফাৎই নেই। কাজেই বিধানসভাতে ওনারা আসলে নাটক করছেন।
আরও পড়ুন: Aajke | গোপাল পাঁঠার ছবি দেওয়া টি-শার্ট বিক্রি করছে কলকাতার অন্যতম বড় বই প্রকাশক
কমরেড আরও জানিয়েছেন, বিজেপি চায় বিরোধী-শূন্য পার্লামেন্ট, আর তৃণমূল চায় বিরোধী-শূন্য বিধানসভা। পার্লামেন্টে বিজেপির দিকে কাগজ ছোঁড়া হয়, আর বিধানসভায় বিজেপিই কাগজ ছোঁড়ে। অতএব তৃণমূল-বিজেপি দুইই আরএসএস-এর প্রোডাক্ট। কী অসাধারণ কো-রিলেশন মাইরি! বিজেপি চায় বিরোধী শূন্য পার্লিয়ামেন্ট, ঠিক কথা, তো কে বলেছেন? কদিন আগেই সংসদের সামনে পাশে তৃণমূল নেতা কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, এসপি নেতা অখিলেশ যাদব, সিপিএম সাংসদ জন ব্রিটাসকে পাশে রেখেই কথাটা বলেছেন রাহুল গান্ধী। আর তৃণমূল চায় বিজেপি শূন্য বিধানসভা, কে বলেছেন? বিধানসভাতে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। মজার কথা হল, এই রাজ্যে সিপিএম-এর বিশেষ করে কমরেড সেলিম আর সুজনের প্রায় প্রতিটা কথাই মিলে যায় বিজেপির সঙ্গে, আর দিল্লিতে তৃণমূলের বেশিরভাগ কথাই মিলে যায় ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কথার সঙ্গে। কিন্তু এই তৃণমূল আর বিজেপি নাকি একই মায়ের পেটের সন্তান। সুজনবাবুরা রাজ্যের মানুষ দেশের মানুষকে বোকা ভাবেন, অসম্ভব বোকা ভাবেন। না হলে এইরকম উদ্ভট কথাবার্তা বলতেন না। রাজ্য সরকারে ১৪ বছর শাসন ক্ষমতায় থাকা তৃণমূল দল আর নেতাদের বিরুদ্ধে তো কতকিছুই বলা যায়, বলা উচিতও, সেসব কথা বলুন, বিজেপির বিরুদ্ধেও বলুন, দু’জনকে বাংলা থেকে বিদায় দেওয়ার কথাও বলুন। কিন্তু যখনই সেসব বলার আগেই এরা দু’টো দলই আসলে ‘গট-আপ গেম’ খেলছে দিয়ে শুরু করেন, ঠিক তখনই বক্তব্যটা হাস্যকর আর অবিশ্বাস্য হয়ে ওঠে। দিল্লিতে আপ-কে দেখুন, কী দ্রুত তাঁদের জমি হারাচ্ছেন। কারণ এই একটাই, ওনারাও বিজেপি আর কংগ্রেসের মধ্যে একটা গোপন সমঝোতার কথা বলেন। দু’টো পরস্পর প্রতিদিন লড়তে থাকা দলের মধ্যে সেটিং হওয়া সম্ভব নয়। বিভিন্ন ধরণের স্ববিরোধিতা থাকতে পারে, দুর্নীতি তো আছেই, কাজ করার ক্ষমতার তারতম্য হতেই পারে, কিন্তু সেটিং সম্ভব নয়। সেটা যতদিন সুজন চক্কোত্তিরা বুঝতে পারবেন না, ততদিন শূন্য বিধানসভার কথা সাংবাদিকদের কাছ থেকে শুনেই তাঁদেরকে বলতে হবে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, গতকাল বিধানসভায় শাসক দল আর বিরোধী দলে তুমুল ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে, একে অন্যকে ‘চোর’ বলেছেন, স্লোগান তুলেছেন, বহিস্কার করা হয়েছে বিজেপির ৫ জন নেতাকে। কিন্তু এত সবের পরে কমরেড সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, এসবই নাকি ‘গট-আপ গেম’। আপনাদের কী মনে হয়, এ রাজ্যে বিজেপি আর তৃণমূলের সত্যিই কোনও সেটিং আছে?
সিপিএম-এর সেলিম সুজনেরা রোজ স্বপ্ন দেখেন ফেলে আসা দিনের। কিন্তু সেই ফেলে আসা দিনগুলোর ধারে-কাছে যেতে হলেও যে রাস্তায় নেমে লড়তে হবে তার কথা কল্পনাতেও আনতে ভয় পান। ঠিক সেই কারণেই এক শর্টকার্ট রাস্তা বেছে নিয়েছেন। বক্তব্য ‘বিজেপি হাটাও’ এই স্লোগান তো তাঁরাই দিতে পারেন, তৃণমূলের মুখে তা বেমানান। আর এই কথা বলতে গিয়ে ভুলেই যান যে, এই মুহুর্তে দেশে তাঁরা এমন কোথাও ক্ষমতাতেই নেই, যেখানে তাঁদের সঙ্গে লড়াই সরাসরি বিজেপির। আছেন কেরলে, সেখানে লড়ছেন কংগ্রেসের সঙ্গে, স্লোগান ‘কংগ্রেস হাটাও’। এ রাজ্যে বিজেপির সঙ্গে মুখোমুখি লড়ছেন মমতা, সেই লড়াইকে সমর্থন করবেন না, আপনারা আলাদা ফ্রন্টে লড়বেন। এই পর্যন্ত তো ঠিকই আছে, কিন্তু এখানে বিজেপি আর তৃণমূল ‘গট-আপ গেম’ খেলছে – এটা যতবার বলবেন ততই ঐ শূন্যের চাপটা বেড়ে যাবে, বাড়তেই থাকবে, এটা মাথায় রাখলে ভাল হয় কমরেড সুজন বাবু।