বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া একটা স্লোগান হঠাৎই ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের মাঝমাঠ দখল করে নিয়েছিল, সেই ঝিঙ্কি ঝুকুর ঝিঙ্কি ঝুকুর বাজনা আর তার তালে তালে খেলা হবে খেলা হবে। যুব নেতা দেবাংশু আরও অনেক কিছুই লিখেছিল, কিন্তু যেমনটা হয় আর কী, ক্যাচ লাইনটাই থেকে গেছে, খেলা হবে খেলা হবে। হ্যাঁ, হুইল চেয়ারে বসেও হাতে ফুটবল ছিল মমতার। এবং মাঠ দখল করেছিল তৃণমূল, অনায়াসেই। তৃণমূলের বক্তৃতাতে ওই বিবেকানন্দের ফুটবল খেলো, সেটাও দারুণ চলেছিল। একজনের মুখে শুনেছিলাম বিবেকানন্দের অনুপ্রেরণাতেই নাকি মোহনবাগান গোরা সাহেবদের হারিয়েছিল, অনুপ্রেরণায় কত কিছুই তো হয়। তো যাই হোক এতদিন পরে হাফ ইন্টেলেকচুয়াল শমীক ভট্টাচার্য দায়িত্ব নেওয়ার পরে রবি ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র ইত্যাদির সঙ্গে ফুটবল এবং বিবেকানন্দ এসে হাজির। কেউ সম্ভবত বলেছে অত শক্তি শক্তি করবেন না, ওসব মানুষ খাবে না, কাজেই এখন সেই খেলা হবে স্লোগান বিজেপির মুখে। শমীক ভট্টাচার্য নিজে ফুটবলে লাথি মেরে বিবেকানন্দ কাপের ফুটবল টুর্নামেন্টের শুরুয়াত করলেন গতকাল, বিধানসভা নির্বাচনের ছ’ মাস আগে দখল হওয়া মাঠের খানিকটা যদি ফেরত পাওয়া যায় সেই আশায়। কিন্তু সেখানেও ভারি ক্যাচাল, প্রথম মাঠে যে এত সমস্যা তা তো শমীকবাবুর জানা ছিল না। প্রথম কথা হল এত বড় প্রোগ্রাম যা শুরু হল স্বামীজির শিকাগো বক্তৃতার দিনে ১১ সেপ্টেম্বরে, যা নাকি শেষ হবে আর এক নরেনের জন্মদিনে, ১৭ সেপ্টেম্বরে, মানে নরেন টু নরেন, কিন্তু প্রথম মাঠ ছিল আরতি কটন মিল গ্রাউন্ড, যে কটন মিলের মালিক ওনাদের শুভানুধ্যায়ী কিন্তু কটন মিলের শ্রমিকদের মাইনে আর বোনাস নিয়ে বিস্তর সমস্যা রয়েছে, কাজেই খেলার আগে সেই শ্রমিকেরাও খেলতে নামলেন। সেটাই বিষয় আজকে। খেলা হবে স্লোগান দিয়ে তৃণমূলের মাঠ দখলের এতদিন পরে মাঠে নামার চেষ্টা করছে বিজেপি।
নরেন টু নরেন গল্পটা আগে বলে নিই। বিজেপি, আরএসএস, হিন্দু মহাসভা ইত্যাদিদের দেখলে মাঝেমধ্যে খানিক করুণাই হয়, এনাদের অতীতে এমন কেউ নেই যাকে এঁরা আইডল বলতে পারেন, এক চেহারা যার অতীত খ্যাতি আর কর্ম নিয়ে গর্ব করা যায়। ধরুন কংগ্রেসের হাতে আছে তো গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল, আবুল কালাম আজাদ আরও কত বিরাট মানুষজন। বলতেই পারেন যে সুভাষ বসু বা আম্বেদকরের সঙ্গে তো কংগ্রেসের মতভেদ ছিল, সমস্যা হল সেটা তো মতভেদ, আর তাঁদের সঙ্গে আরএসএস বা হিন্দু মহাসভার সম্পর্ক তো কহতব্য নয়। নেতাজির সমর্থকেরা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভাষণ আর জমায়েত বানচাল করেছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মাথা ফেটেছিল।
আরও পড়ুন: Aajke | এ রাজ্যে ভোটার তালিকার সংশোধনে বিজেপিরই মুখ আর হাত পুড়বে
স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনও পর্যায়ে না থাকা আরএসএস-এর উত্তরসূরি বিজেপির একজনও স্বাধীনতা সংগ্রামী নেই। আর ধর্ম? সেখানে সবথেকে বড় আইডল বিবেকানন্দ, যিনি বলেছিলেন গর্বের সঙ্গে বলো আমি হিন্দু, তাঁর গুরুদেব ইসলাম সাধনা করেছেন, বলেছেন যত মত তত পথ। যেদিন জন্ম সেদিন থেকেই তীব্র মুসলমান, সংখ্যালঘু বিরোধী আরএসএস-বিজেপির সেখানেও সমস্যা। তাই এক নরেনের সঙ্গে আরেক নরেনকে জুড়ে একটা খেলা দেখাতে চায়, যা যে কোনও বাঙালির কাছেই লজ্জার, অপমানের। বিবেকানন্দ দেখেছিলেন হিন্দু, মুসলমান, মুচি, মেথরদের নিয়ে এক গৌরবময় ভারতের স্বপ্ন। তিনি বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামিক দেহের সমন্বয়ে এক মহান ভারত গড়ার কথা বলে গেছেন। শুধু তা-ই নয়, বিবেকানন্দ প্রথম কুমারীপুজো করেছিলেন মুসলিম মহিলাকে। যা খুব পরিষ্কার করেই বুঝিয়ে দেয় বিবেকানন্দের হিন্দুত্ব ছিল মানবতাবাদী হিন্দুত্ব, তার সঙ্গে আরএসএস–বিজেপির রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ছিঁটেফোঁটা মিলও নেই। কিন্তু বাংলা বিজেপির হাফ ইন্টেলেকচুয়াল সভাপতি নরেন টু নরেন করে দুই নরেনকে জোড়ার এক কুৎসিত চেষ্টা করছেন। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম ১২ সেপ্টেম্বর স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনের সঙ্গে ১৭ সেপ্টেম্বর নরেন্দ্র মোদির জন্মদিনকে জুড়ে বঙ্গ বিজেপি যে নোংরা খেলাটা খেলছে তা নিয়ে আপনাদের মতামত কী? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
যে বিবেকবাণী আমরা বাঙালিরা শুনেছি, ঠিক তার বিপরীত কথাগুলো বলে ওই বিজেপি আরএসএস-এর দল। শেষ করার আগে তাই বিবেকানন্দের কিছু কথা দিয়েই শেষ করব। উনি বিভিন্ন সময়ে ইসলাম ধর্ম নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন। ওনার কথায়, আমাদের নিজস্ব মাতৃভূমির জন্য, হিন্দুধর্ম এবং ইসলাম- বেদান্ত মস্তিষ্ক এবং ইসলাম দেহ, এই দুটি মহান ব্যবস্থার মিলনস্থলই একমাত্র আশা। আমি আমার মনের চোখে দেখতে পাচ্ছি ভবিষ্যতের নিখুঁত ভারতবর্ষ এই বিশৃঙ্খলা এবং দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসছে, গৌরবময় এবং অজেয়, বেদান্ত মস্তিষ্ক এবং ইসলাম দেহের সাথে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ব্যবহারিক ইসলামের সাহায্য ছাড়া, বেদান্তবাদের তত্ত্বগুলি, যতই সূক্ষ্ম এবং বিস্ময়কর হোক না কেন, মানবজাতির বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে সম্পূর্ণ মূল্যহীন। ইসলাম তার সকল অনুসারীদের সমান করে- তাই, আপনি দেখতে পাচ্ছেন, এটিই হল মুসলিম ধর্মের অদ্ভুত উৎকর্ষ। কোরানের অনেক জায়গায় আপনি জীবনের অত্যন্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ধারণা খুঁজে পান। কোনও ব্যাপার না। মুসলিম ধর্ম বিশ্বকে যা প্রচার করতে আসে তা হল তাদের ধর্মের সকলের ব্যবহারিক ভ্রাতৃত্ব। এটি মুসলিম ধর্মের অপরিহার্য অংশ। হ্যাঁ, বিবেকানন্দ এই কথাগুলোই বলে গিয়েছিলেন, আর ওই নরেন মোদি? মনে করেন মুসলমানেরা হিন্দু নারীদের মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেবে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের বিবেক নরেন যদি চাঁদ হয়, তাহলে ওই বিজেপি নরেন কী? আপনারাই বলুন।