সেই রতদখলের প্রকান্ড হুজুগের সময়ে আমি এক বিপ্লবী আরজি কর আন্দোলনে মুখর নেত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কতদিন এই আন্দোলন চলবে?” তো, তখন আন্দোলনের পিক পিরিয়ড, স্বপ্ন তো নবান্নের উপরে উড়তে থাকা হেলিকপ্টার। তাই তিনি সেদিন বলেছিলেন, “রাস্তায় থাকব ততদিন, যতদিন না বিচার পাচ্ছি।” তিনি আপাতত মন দিয়ে ব্যবসা দেখাশুনো করছেন, পুজো সংখ্যা নিয়েও ভারী ব্যস্ত। এদিকে অনামিকা টুক করে ডুবে মরে গেল। না, কোনও রহস্যই খুঁজে পাননি বিপ্লবী কিঞ্জল নন্দ, অ্যাডভোকেট কাম সিপিএম নেতা বিকাশ ভট্টাচার্য, চোখ-কান বন্ধ সেই দেড়শ গ্রাম বির্যের তত্ত্ব ফেরিওয়ালা সুবর্ণ গোস্বামী কিংবা আন্দোলনের মুখ সেরা বাঙালিনির। মৃতদেহ তোলা হল, পোস্টমর্টেম হল, পোড়ানো হল, অথচ দেখা নেই মিনাক্ষী মুখার্জির, দেখানেই সোমা, সেই ‘জানিস তো সোমা বলছি’র সোমা আপাতত শীতঘুমে। ওদিকের খবর কী? মানে যিনি শিশির কুঞ্জ থেকে ৬৬, ৬৮ বছর বয়সীদের দিয়ে ছাত্রদের নবান্ন অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন? ন্যাড়ামাথা প্রতিবাদী কোথায়? এ ভাই, কোথায় সাড়ে তিনখানা শক্তির কবিতা মুখস্ত ইন্টেলেকচোয়াল রাজ্য বিজেপি সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য? কেউ নেই, বিলকুল সন্নাটা। কাজেই খবর পাঁচের পাতায়, তেনাদেরও কলতলার আলোচনাতে অনামিকা অনুপস্থিত। সূত্র থেকে খবর বার করে প্রথম পাতায় বাঙালি জীবনে হলচল আনা প্রতিবেদনও একটাও নেই। মানে এক বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ছাত্রীর রহস্যমৃত্যু আজ এনাদের কাছে ইস্যু নয়, সেদিন আরজি করের ধর্ষণ আর হত্যা ছিল বিরাট ইস্যু, যে ইস্যুতে দাবি উঠেছিল – ‘দফা এক দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ’। বছর ঘুরতেই আরেক কন্যার মৃত্যুতে তাঁরা কেউ কোনও কথাই বলছেন না কেন? সেটাই বিষয় আজকে, বিপ্লবী কিঞ্জল নন্দ, অ্যাডভোকেট বিকাশ ভট্টাচার্য, রাত দখলের সেরা বাঙালিরা কোথায়?
এ রাজ্যের সমস্যা হল, যে ইস্যুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ চাওয়া যাবে না, সেই ইস্যুতে হীরণ্ময় নীরবতা পালন করবে সিপিএম, বিজেপি, মুখ খুলবেন না বুদ্ধিজীবি, টলিগঞ্জের ঝিঙ্কু মামণি বা পাঁচিলের উপর বসে থাকা সর্ব বিষয়ে বোদ্ধা পরিচালকেরা, লেখক বুদ্ধিজীবিরা। হ্যাঁ, এরকম হাজার একটা উদাহরণ দিতে পারি। তেমন ঘটনার, যা সত্যিই রহস্যময় মৃত্যু, কলেজ ক্যাম্পাসেই মৃত্যু, চাকরি দেওয়ার নাম করে ধর্ষণ, নারী অবমাননার, যেখানে এনারা চুপ। কারণ সেই সব ঘটনাতে মমতার পদত্যাগ দাবী করা যাচ্ছে না। ধরুন যাদবপুরের স্বপ্নদীপ কুন্ডুর, র্যাগিং হয়েছিল। র্যাগিংয়ের পরে রক্তের দাগ মোছা হয়েছিল, আলু-লালু-ভুলুরা মিটিং করে পরবর্তী স্ট্রাটেজি জানিয়েছিল। কিন্তু প্রতিবাদে কলকাতা তো ছেড়েই দিন, যাদবপুরও কি ফেটে পড়েছিল? এই বিপ্লবীরা যাঁরা আরজি করের ধর্ষণ মৃত্যুর পরে কেন সিসিটিভি নেই, সেই দাবিতেই মমতার পদত্যাগ চেয়েছিলেন, তাঁরাই এখন ঠোঁটে তালা মেরে বসে আছেন, স্বপ্নদীপ কুন্ডুর সময়েও বসেই ছিলেন। যাঁরা আনিস খানের মৃত্যুর পর রাজ্যজুড়ে আন্দোলন গড়ে ওঠার ডাক দেন, সেই তাঁরাই বেআইনি পাথর খাদানে ছ’জনের মৃত্যু নিয়ে মিনমিন করে কিছু বলার পরেই চুপ। কেন? কেন এই এঁরাই চুপ ঐ আরজি করের এক ডাক্তার পড়ুয়াকে মালদহতে নৃশংসভাবে খুনের পর?
আরও পড়ুন: Aajke | খেলা হবে স্লোগান দিয়ে তৃণমূলের মাঠ দখলের এতদিন পরে মাঠে নামার চেষ্টা করছে বিজেপি
কারণ এই সবকটা ঘটনাতে ঐ ‘দফা এক দাবি এক – মমতার পদত্যাগ’টা বলা যাচ্ছে না বলে? ঐ বেআইনি খাদানের মালিক কোন কোন নেতাকে কত টাকা দিয়েছিলেন, সেটা বেরিয়ে আসবে বলেই কি চুপ সবাই? একজন মহিলাকে চাকরি দেওয়ার নাম করে দীর্ঘ সময় ধরে তার উপর যৌন অত্যাচার চালিয়েছেন বিপ্লবী কমরেড সুশান্ত ঘোষ, কই সেই মহিলার জাস্টিসের জন্য তো রাস্তায় নেই তো অম্বিকেশ মহাপাত্র? এক সিলেকটিভ প্রতিবাদের রাস্তা বেছে নিয়েছেন তাঁরা, রাজনৈতিক প্রতিবাদের আগুন জ্বালাতে চান যে আগুনে তাঁদের পছন্দ মতো রুটি সেঁকা যাবে। যদি তা না সম্ভব হয়? তাহলে কই, কোথায়? মুখে তালা বিপ্লবী কিঞ্জল নন্দের যিনি এখন সিনেমা নিয়েই ব্যস্ত, সময় কোথায় অনামিকার ডুবে মরার পিছনে রহস্য নিয়ে রাস্তায় নামার? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, আরজি কর ধর্ষণ হত্যা নিয়ে যাঁরা সেদিন রাস্তায় ছিলেন তাঁরা প্রত্যেকে, সিপিএম, বিজেপি সব্বাই আজ যাদবপুরে এক ছাত্রীর এমন রহস্যময় মৃত্যুর পর মুখে তালা দিয়ে বসে আছেন?
বিরোধী রাজনৈতিক দল তো সর্বদাই সরকারের বিরোধিতায় সরব হবে, যেখানে সেই রসদ নেই, সেখানে থম মেরে বসে থাকা ছাড়া আর কোনও প্রতিক্রিয়াই দেবে না। তারা একেক জায়গাতে একেক ধরণের কথা বলবেন, তাঁরা আরজি করে সিসিটিভি চাইবেন নজরদারি বাড়ানোর জন্য, আবার যাদবপুরে সিসিটিভির বিরোধিতার করবেন, ব্যক্তিগত স্পেস, গোপনীয়তা রক্ষার জন্য। সেসব বোঝা গেল, কিন্তু কেন চুপ বুদ্ধিজীবিরাও? সেই সব গায়ক-নায়করাও? যাঁরা ক’দিন আগে এক রহস্যময় ধর্ষণ হত্যা নিয়ে এত কথা বললেন, তাঁরাই আজ চুপ কেন? তার মানে কি এটাই যে এ রাজ্যে স্বাধীন কন্ঠ নেই, মারা গিয়েছে বহুকাল আগেই? যাঁরা আছেন তাঁরা কেবল দলদাস?