ঘটনার পর থেকে ধর্ষণ নয়, দুটো কথা নিয়েই চর্চা চলছে মিডিয়ায়, যা চালাচালি হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপে আর সমাজমাধ্যমে। ১) মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতি: মুখ্যমন্ত্রী একবারের জন্যও যা বলেননি তাই নিয়ে কী চর্চা, কত চর্চা। মুখ্যমন্ত্রী এক বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের সাধারণ নিয়মকানুন নিয়ে যা বলেছেন তাকে মরাল পোলিসিং বলে চালিয়ে আত্মতৃপ্তি পাচ্ছেন মূলত সমাজমাধ্যমের ভয়ঙ্কর প্রগতিশীল জ্যাঠামশাইয়েরা। যাঁদের বাড়িতে আমার জানা আছে, একমাত্র কন্যা সামান্য এক পুলিশকর্মীর সঙ্গে বিয়ে করতে চাওয়ায় পুলিশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ছেলেটিকে ডেকে কড়কে দেওয়া হয়েছিল, জানা আছে সেই বিজেপি নেত্রীর কথা যার ছেলে কাজের পরিচারিকাকে ধর্ষণের অভিযোগ ঢাকতে উপরতলায় বসেই অনেক তোড়জোড় করতে হয়েছিল। জানাই আছে সেই নাট্যকারের কথা যিনি নারী ধর্ষণের দায়ে পুলিশের গ্রেফতারি এড়ানোর জন্য আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস থেকে পালিয়েছিলেন। হ্যাঁ, আজ এই এঁরাই সমাজ মাধ্যমে মরালিটির কুতুব মিনার হয়ে দাঁড়িয়েছেন। বাদ দিন এঁদের কথা। সাধারণ মানুষ আজও ঘরের মেয়েদের রাত হওয়ার আগে বাড়ি ফেরার কথা বলেন, তাঁরা এই জ্যাঠামশাইদের প্রগতিশীলতার পাঠ পড়বেন না। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গাতে। সমস্যা হল বহু মানুষ যে কোনও অপরাধকেই ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে বিচার করার চেষ্টা করেন, এবারেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। ফিসফিস চলছে, জানিস তো ধর্ষকরা সব্বাই না…। যেন ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত আশারাম বাপু বা নিত্যানন্দরা সংখ্যালঘু। আসলে সংখ্যালঘু হল সেই পাঞ্চিং ব্যাগ, যাতে যে কোনও বক্সার প্র্যাকটিস করতে পারে। কিছু ঘটলেই আঙুল উঠবে ওই যে ওই ওরা, ওদের পাঁচটা বিয়ে, ওদের প্রচুর বাচ্চাকাচ্চা, ওরা ভীষণ নোংরা, ওদের বাড়িভাড়া দেব না, ওরা সব্বাই গরু খায় ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। এই বিষয়টা নিয়েই কিছু অত্যন্ত জরুরি কথা বলে নেওয়া যাক, যা আমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত, যা আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িত, যা আমাদের সংবিধানের সঙ্গে জড়িত, যে বোধগুলো নিয়ে আমরা ৪৭ সাল থেকে নতুন ভারতের দিকে রওনা দিয়েছিলাম, যে চিন্তা চেতনা নিয়ে ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ সূর্য সেন বা আশফাকুল্লা প্রাণ দিয়েছিলেন দেশের জন্য। আজ সেই বোধ চিন্তা সেই চেতনা আদর্শ নিয়ে কথা বলার সময় এসেছে বইকী।
স্বাধীনতার সঙ্গে দেশভাগ এল আমাদের উপর, বলা ভালো ওধারে পঞ্জাব আর এধারে আমার বাংলাকে ভাগ করে এল দেশের স্বাধীনতা। দেড় কোটি মানুষ এ পার থেকে ওপারে গেল, ওপার থেকে এপারে আসল। র্যাডক্লিফ সাহেব আমার উঠোন আমার খেলার মাঠ আমার জমিন আসমানের মধ্য দিয়ে লাইন টেনে বলে দিলেন এটা ভারত ওটা পাকিস্তান। এল দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতা।
প্রশ্নগুলো নেহাতই জরুরি, কারণ স্বাধীনতার ৭২ বছর পরে দেশের ২৮-২৯ কোটি মানুষ আতঙ্কিত, ভয়ে আছে, ভয় পাচ্ছে কারণ তাদের অতীত তাদের সামনে এসে হাজির, তাদের কি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হবে? তাদের কি ঘাড় ধরে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হবে? তাদের কাছে যে কাগজ আছে তাই কি যথেষ্ট? নাকি এই কাগজগুলো থাকার পরেও তারা থাকবে তালিকার বাইরে? হিন্দু জনসংখ্যার কাছে কি কোনও option ছিল? আর কোনও জায়গা ছিল যাওয়ার, তাদের তো ভারত ছেড়ে কোথাও যাওয়ার উপায়ই ছিল না। কিন্তু যাদের কাছে ছিল? যারা তার পরেও গেল না, গেল না কারণ তারা জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বে বিশ্বাস করেনি, বিশ্বাস করেছে যে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গেই থাকা যায়, থাকতে হয়। তারা নিজেদের ভিটে ছেড়ে যাওয়ার কথাই ভাবেনি। ভাবেনি কারণ আমরা ভারতবাসীরা বলেছিলাম আমরা অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ গড়ে তুলব, সেকুলার স্টেট। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। আমরা সবাই বলেছিলাম। তারা বিশ্বাস করেছিল। আমরা কি ভুল বলেছিলাম? আমরা কি মিথ্যে বলেছিলাম?
এতদিন পর সেই কথাগুলো, সেই পুরনো দলিল দস্তাবেজ আমাদের ঘেঁটে দেখতে হচ্ছে। লজ্জা। এতদিন পর সেই প্রশ্ন আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। লজ্জা। এতদিন পর আমাদের দেশের ২৮-২৯ কোটি মানুষ আমার সহনাগরিক কি না সেই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। লজ্জা। তবুও আর এক বার শেষবারের মতো এই বিষয়ের নিষ্পত্তি হয়ে যাক। শেষবারের মতো ওই বর্বর লোকগুলোর মুখের উপর পুরনো সত্যিটা আবার বলে দেওয়া যাক।
Fourth Pillar | বিজেপি ভোটার লিস্ট সংশোধনের নামে আপনার আমার নাগরিকত্ব কাড়তে চায়
মনে আছে জামাইতুল উলেমা এ হিন্দ, যারা দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধিতা করেছিল, যারা কায়েদে আজম জিন্নাহর বিরোধিতা করেছিল। এঁরা বলেছিলেন যে ভারত ভাগ করা যাবে না, বলেছিলেন আমরা একসঙ্গেই থাকবো। এখন আজ, ৭২ বছর পর সেই সংগঠনের ভিতর থেকে প্রশ্ন উঠছে, আমরা একসঙ্গে থাকতে পারব তো, আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হবে না তো? মৌলানা মহমুদ আদনি এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, প্রাণ যায় যাক এবার তো রাস্তাতেই নামতে হবে, প্রাণ গেলেও এ লড়াইয়ের শেষ দেখে ছাড়ব। কখন মানুষ প্রাণ দেওয়ার কথা বলে? শেষ ভরসাটাও চলে গেলে? দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে? কী এমন হল যে তাদের ভরসা চলে যাচ্ছে? তাদের পিঠ ঠেকে যাচ্ছে দেওয়ালে? কেন আমার দেশের সহনাগরিক মুসলমানরা এরকম ভয় পাচ্ছেন? রাজনীতি তাঁদের বিরুদ্ধে? প্রশাসন? বিচার বিভাগ? তাহলে কি আমাদের অজান্তেই ঘটে গেছে কোনও নিঃশব্দ বিপ্লব। সংবিধান কি তাহলে আর ধর্মনিরপেক্ষ নয়? সরকার কি আর ধর্মনিরপেক্ষ নয়? জামাইতুল উলেমার সমর্থকরা কোথাও কোনও বিক্ষোভ প্রদর্শনে নামলে তাদের বলা হচ্ছে আপনারা হিন্দু বিরোধী দেশ বিরোধী, রাস্তায় না নামলে ঘরের ভিতর থেকে আওয়াজ আসছে আমরা বিপন্ন। কোথায় যাবে তারা? আমার দেশের ২০ শতাংশ মানুষ বিপন্ন স্বাধীনতার ৭২ বছর পরে? মুসলমানদের পোশাক নিয়ে ইঙ্গিত করছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, পুলিশ অফিসার হুমকি দিচ্ছে রাস্তায় নামলে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেব। কাশ্মীর জ্বলছে এক ইস্যুতে, অসম তার ভাষা সংস্কৃতির আন্দোলনে। ওদিকে পাঞ্জাব বাংলার মানুষ চিন্তিত কী হবে এনআরসিতে? কী হবে এনপিআর-এ? কারণ তাদের ক্ষত তো সবথেকে বেশি। ক’জন গুজরাটিকে তার মাতৃভূমি ছাড়তে হয়েছে। সব থেকে বিপন্ন বাংলা, এখানেই সব থেকে বেশি বিষ ছড়াচ্ছে। আন্দামানে সেলুলার জেলে চলে যান, কালাপানির সাজা কারা পেয়েছিল, কারা শহীদ হয়েছিল? তালিকা দেখুন। সে তালিকার ৭০ শতাংশ বাঙালি, হ্যাঁ ৭০ শতাংশ, সেই বাঙালির দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলছে কারা? যাঁরা স্বাধীনতার প্রশ্নে ছিলেন গান্ধীর সঙ্গে, তাঁরা আজ গান্ধী হত্যাকারীদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। কী আশ্চর্যভাবে ইতিহাস তার গতিপথ পাল্টাচ্ছে।
দেশের সংখ্যালঘু মানুষজন আজ যে সংশয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে, যে বিপন্নতা বোধ তাঁদের ভিতরে কাজ করছে, আসুন তাঁদের দিকে চোখ ফেরাই। আম্বেদকর সংবিধান সভার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, রাজেন্দ্র প্রসাদ সেই বিবরণী লিখছিলেন, প্যাটেল, নেহরু, শ্যামাপ্রসাদ, আবুল কালাম আজাদরা ছিলেন, সদস্য ২৯৯ জন ছিলেন। ২৮৪ জন এই খসড়ায় সই করেছিলেন তার মধ্যে ৩০ জন মুসলমানও ছিলেন। তাঁদের মধ্যে চারজনের পরিবার সন্তান-সন্ততি ঠিক এই সময় রাস্তায়, সিএএ-এনআরসি-র বিরোধিতা করছেন। তাঁদের একজন জেলে। মহম্মদ ইসমাইল সাদিব, কেটিএন আহমদ ইব্রাহিম, মেহবুব আলি বেগ মাদ্রাজ থেকে বোম্বে থেকে আবদুল কাদের মহম্মদ শেখ, আফতাব আহমদ খান ছিলেন, বাংলা থেকে জশুদ্দিন আহমদ, নজরুদ্দিন আহমদ আব্দুল আলিম গজনভি, রাদিভ এহসান, আবদুল হামিদ এই ৫ জন ছিলেন। সংযুক্ত প্রান্ত মানে ইউপি-এমপি মিলিয়ে যে অঞ্চল সেখান থেকে বেগম এজাজ রসুল, হায়দর হুসেন, হজরত মোহানি, মহ ইসমাইল খান, রফি আহমদ কিদোয়াই, মহ হাফিজুর রহমান এর মতো স্কলাররাও ছিলেন, সংবিধান কেবল হিন্দুরা লেখেননি। বিহার থেকে ইমাম হোসেন, সৈয়দ জাফর ইসলাম লুৎফুর রহমান মহ তাহেব,তাজমুল হোসেন, আসাম থেকে আবদুর রউফের মতো প্রাজ্ঞ মানুষ ছিলেন, জম্মু কাশ্মীর থেকে শেখ আবদুল্লাও ছিলেন।এই দেশের সংবিধান বানানোর ইতিহাএ এঁরাও ছিলেন। একসঙ্গে দেখেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রর স্বপ্ন। সেই জন্যই একবার সংসদে অটল বিহারী বাজপেয়ী বলেছিলেন যে দেশ তার সংবিধানকে নিয়ে চলবে, ধর্ম নিয়ে নয়। কিন্তু আজ সেই দেশ ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার আইনও এনে ফেলেছে।
কারা রাস্তায়? কারা সংশয়ে? কাদের জামাকাপড় দেখে প্রধানমন্ত্রী চিনে ফেলছেন? মুসলমানরা। অথচ তারা চিৎকার করে বলছেন “সভি কা খুন শামিল হ্যায় ইস মিট্টি মে, কিসিকা বাপকা হিন্দুস্তান থোড়ি হ্যায়,” সব্বার রক্তে রাঙা এই দেশের মাটি, কারও বাপের সম্পত্তি নয়।
৪৭ এর পর থেকে একটু মুসলমানদের অবস্থা ওইটা দেখে নেওয়া যাক। মুসলমান সম্প্রদায়ের ৪০ শতাংশ মানুষ গরিব সীমার নীচে। মাসে রোজগার ৫৫০ টাকার ও কম। এমনিতেই দেশে ১০ শতাংশ মানুষের কাছে ৭৫ শতাংশ সম্পদ রাখা আছে আর ৬০ শতাংশ মানুষের কাছে ৪ শতাংশের কম সেই দেশে এই আয় এমনিতেই কম, সংখ্যালঘুদের অবস্থা আরও খারাপ। মুসলমান একটি মানুষের প্রতিদিন এর আয় ৩২ টাকা ৭০ পয়সা। অথচ মুসলিম জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ আমাদের দেশের শ্রমশক্তি, তাঁদের শ্রম মূলত কন্সট্রাক্সন , বেকারি, সেলাই, কুকিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখে। তাঁদের কে সব দল কখনও না কখনও ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করেছে, কখনো এই মসজিদের ইমাম, কখনও ঐ মসজিদের ইমাম কে সামনে দাঁড় করিয়ে রাজনীতির বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, কখনো তাঁদের বিরুদ্ধে মেরুকরণ তাঁদের দিকে ঘৃণা ছড়িয়ে মেরুকরণের রাজনীতি হয়েছে। ব্যবস্যায়িরা তাঁদের সস্তা সুপারি কিলার হিসেবে ব্যবহার করেছে, ধর্মগুরুরা তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছে এ কে ৪৭, তারা টেররিস্ট হয়েছে। তারপর আপামর মানুষের মনে একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করা হয়েছে যে মুসলমান মানে ৮ টা বৌ, ২০ টা ছেলেপিলে, মুসলমান মানে নোংরা বস্তি, মুসলমান মানে সমাজবিরোধি ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ন্যারেটিভ বহু মানুষ খেয়েছেন, বমি করেছেন। আরও ঘৃণা আরও বিচ্ছিন্ন করেছে তাঁদের। সাংঘাতিক এক কৃষ্ণ গহ্বরে ঢুকে গেছে মুসলমান সমাজ। ওদিকে তাঁদের ভেতর থেকে যে একটা রাজা রাম মোহন রায়, বা বিদ্যাসাগর বা বিবেকানন্দ বেরিয়ে আসেনি, এটাও দুর্ভাগ্য।
ঠিক এই সময়েই রাজনীতির কারবারিরা এবার সরাসরি সক্রিয়, আরও বড় মেরুকরণের দিকে তারা, ছাঁকনিতে ছেঁকে নিয়ে ডিটেনশন সেন্টারে ফেলে রাখা কিম্বা বাইরে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক। আর এস এস এর সরসংঘচালক তো বলেই দিয়েছেন ১৩০ কোটিই হিন্দু। তারা হিন্দু আচরণ নিয়েই থাকবে। অন্তত দু জন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী বলেই দিয়েছেন হিন্দু দের তো আর রাষ্ট্র নেই তাই…… তাই কী? সংবিধানের শপথ নিয়ে সংবিধান কেই শেষ করার খেলা?
একবার শাসক দলের ছবি টা দেখুন, ২৪০ জন সাংসদ। ২৪০ জনের একজন ও মুসলমান নয়। দেশের সংবিধান সভায় ৩০ জন ছিলেন, দেশের শাসক দলে ১ জন সংখ্যালঘু সাংসদ নেই। দেশের বিরাট এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, বিজেপি একজন কে টিকিট ই দেয় নি, জেতার প্রশ্নই নেই। মানে ইউ পি তে শাসকদলে একজন ও এম এল এ নেই যিনি ধর্মে মুসলমান। সে রাজ্যের দারোগা প্রকাশ্যে বিক্ষোভকারী দের পাকিস্তানে পাঠানোর কথা বলবে না তো কোথায় বলবে? ঘরে ঢুকে পুলিশ বিক্ষোভকারী দের মারছে, বলছে বল “জয় শ্রী রাম”। বলবেই তো, কারণ তাঁদের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, তাঁদের প্রধানমন্ত্রী পোষাকের দিকে আঙুল তুলছেন। তার মানে যে রাজনীতি দেশের আইন, অর্থনীতি, দেশের শিল্পনীতি, স্বাস্থনীতি, সমস্ত ব্যয়বরাদ্দ নির্ধারণ করে সেই দেশের শাসকদলের রাজনোইতিক ভাবে মুসলমান দের দরকার নেই। পরিস্কার, দরকার নেই। কেবলমাত্র গরিষ্ঠ হিন্দুদের নিয়েই তারা দেশ চালাবে। যদিও দেশ চালানোর জন্য যে সংবিধান রচনা হয়েছিল সেই সংবিধান সভায় ৩০ জন মুসলমান ছিলেন। এবার সেই মুসলমান সম্প্রদায় যদি নিজেদের অসুরক্ষিত মনে করে, সংশয়ে ভোগে তাহলে কি সেটা একেবারেই অমুলক? আবুল কালাম আজাদ ১৯৪০এ কংগ্রেস দলের সভাপতি, তার ভাষণে বার বার পাওয়া যাচ্ছে যে ভারতবর্ষে মুসলমান দের অস্ত্বিত্ব কেবল সংখ্যালঘু হিসেবে থাকতেই পারে না, তারা দেশের মূল স্রোতের অভিন্ন অঙ্গ, তিনি বলছেন যে সমুদায় হিসেবে মুসলমান রা এখানেই সুরক্ষিত জিন্নাহ র সংগে নয়। দেশ স্বাধীন হবার পর জহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধি, মোরারজি দেশাই, জগজীবন রাম, চরণ সিং বা সংসদের বিশিষ্ট নেতাদের কথা শুনে তো মনে হয় নি মুসলমান রা আমাদের রাজনোইতিক সামাজিক জীবনে কোনও বিচ্ছিন্ন অঙ্গ।
অথচ আজ সে সমস্ত ধারণাগুলোই বদলে যাচ্ছে। পাশের মানুষটার মাথায় ফেজ থাকলে দৃষ্টি পালটে যাচ্ছে, পরনের পোশাক দেখে চেনার চেষ্টা হচ্ছে পড়শি কে, কে কোন খাবার খাবে বা না খাবে তাই নিয়ে কাজিয়া হচ্ছে, পিটিয়ে মানুষ মারা হচ্ছে কারণ সে মুসলমান? থানায় পুলিশ পেটাচ্ছে বলছে বল জয় শ্রী রাম? এই বাংলায় প্রোমোটার গর্বের সঙ্গে জানাচ্ছেন যে এই কমপ্লেক্সে কোনও মুসলমান নেই, তিনি মুসলমানকে ফ্ল্যাট বিক্রি করেন না। এই বাংলায় মুসলমান অধ্যাপক কলকাতার মতো শহরে ভাড়া বাড়ি পান না। কী হয়ে গেল আমাদের? ৪৭ থেকে আমরা এগিয়েছিলাম ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান নিয়ে, এগিয়েছিলাম আরও উন্নত দিন আনার জন্য, কোথায় কোন বাঁকে ভুল পথে নেমে পড়লাম আমরা। বিজেপি সরকার তো একটা বিল এনেছে, তারা তো তাঁদের ঘোষণা মতোই এগোচ্ছে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার দিকে। কিন্তু আমরা? বৃহত্তর সমাজ, উদার তার্কিক ভারতীয়? Argumentative Indians? কোথায়? রবি ঠাকুর আমাদেরই রাজ্যে রাস্তায় নেমে রাখি পরালেন, সম্প্রীতির কথা বললেন, বিদ্যাসাগর ধর্মের উপরে জ্ঞান, শিক্ষাকে স্থান দিলেন, রামমোহন এই মাটিতে দাঁড়িয়েই হিন্দু ধর্মের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়লেন, এই ভারতেই বিবেকানন্দ বললেন, “I am proud to belong to a religion which has taught the world both tolerance and universal acceptance. We believe not only in universal toleration, but we accept all religions as true. I am proud to belong to a nation which has sheltered the persecuted and the refugees of all religions and all nations of the earth.” সেখানে আমার দেশের ১৮-২০ কোটি মানুষ নিজেদেরকে অসুরক্ষিত মনে করছেন, সংশয়ে আছেন, যদিও তাঁদের ৩০ জন আমার দেশের সংবিধান তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন। আজ গোটা দেশে একটা সামান্য অপরাধ ঘটলেই আঙুল উঠছে, হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার। আমরা ভুলে যাব রবি ঠাকুর, নজরুল ইসলাম?