Saturday, December 6, 2025
HomeScrollFourth Pillar | বিকাশ উকিলের লক্ষ্যটা কি দুর্নীতি না রাজ্যের ক্ষমতা?
Fourth Pillar

Fourth Pillar | বিকাশ উকিলের লক্ষ্যটা কি দুর্নীতি না রাজ্যের ক্ষমতা?

উনি অর্জুন সিংয়ের জামিন নিয়েও লড়েন, উনি টাটা-র কারখানার জন্যও লড়েন

Written By
অনিকেত চট্টোপাধ্যায়

এটা ঘটনা যে, একজন আইনজীবী হিসেবে বেশ কিছু দুর্নীতির কথা তুলে ধরে বিকাশ ভট্টাচার্য এক ঝটকায় রাজ্যের শিক্ষা দুর্নীতির কাঠামোতে একটা বড়সড় ঘা দিতে পেরেছেন, যার ফলে সেই দুর্নীতিকে ঘিরে চোর-চোট্টা-চিটিংবাজদের এক বড় অংশকে চিহ্নিত করা গিয়েছে। কিন্তু তাঁর এই মামলাগুলো করার উদ্দেশ্যটা কী? উদ্দেশ্য কি এটা যে, মেধাবী ছাত্ররা যাতে করে আগামীদিনে মেধার ভিত্তিতে চাকরি পায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা তার কাঠামোতে দুর্নীতি না থাকে? যদি এগুলোই তাঁর লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলে তো তা নিশ্চয়ই সমর্থনযোগ্য। কিন্তু এই কাজগুলো করার পাশাপাশি তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা যেভাবে, যে ভাষায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করে চলেছেন, তাতে করে তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটাই সামনে এসে পড়ছে। একটা রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা যখন মামলার প্রতিটা ক্ষেত্রেই এক চালিকা শক্তি হয়ে ওঠে, তখন সেই মামলার প্রথম উদ্দেশ্যগুলো রাস্তা হারিয়ে ফেলে। তাঁর এই লাগাতার দুর্নীতির অভিযোগ আপাতত রাজ্যের এক দুর্বল রাজনৈতিক শক্তির কথাবার্তা হিসেবেই ধরে নিয়ে এক বড় অংশের মানুষ সেই মূল প্রশ্নগুলোতে আর গুরুত্ব দিতে রাজি নন। আর ঠিক সেই চূড়ান্ত মমতা বিরোধিতার অঙ্গ হিসেবেই তিনি যখন বলেন যে, সব্বার চাকরি যাবে, কারও চাকরি বৈধ নয়, তখন তা এক শূন্যে ঠেকে যাওয়া রাজনৈতিক দলের অক্ষম চিৎকার ছাড়া আর কোনও অর্থ বহন করেন না।

উনি বা অন্যান্য উকিলরা একটা সময় ২০১৬ সালের চাকরিপ্রার্থীদের হয়ে সওয়াল করেছেন, মেধাতালিকার কথাও বলেছেন। এমনকি ধর্ণা-টর্নাতেও গিয়েছেন। তখন বিচারক ছিলেন অভিজিৎ গাঙ্গুলী। তখন একরকম কথা বলেছেন। এখন উনি প্যানেল বাতিল করতে চান। এখন অন্য কিছু বলছেন। সবাইকেই ‘দাগি’ বলছেন। মিলে যাচ্ছে অভিজিৎ গাঙ্গুলীর সঙ্গে তাঁর কথা। ‘ঢাকি সমেত প্রত্যেককে বিসর্জন দেব’, এসব বলার পরে তিনি চলে গিয়েছেন বিজেপিতে, বিকাশবাবু কোথায় যাবেন? পৃথিবীজুড়ে যে গণতান্ত্রিক কাঠামো তার সবথেকে বড় সমস্যা হল, দেশের আইনসভা, মানে লোকসভা, বিধানসভা ইত্যাদি। মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়, মানুষ এমএলএ, এমপি নির্বাচিত করে। কিন্তু গণতন্ত্রের অন্য স্তম্ভগুলো যেমন পুলিশ, প্রশাসন, বিচারক ইত্যাদিরা নির্বাচিত নন। তাঁদের নিযুক্ত করা হয়। এবং দু’টো প্রবণতা একসঙ্গে কাজ করতে থাকে। প্রথমটা হল, নির্বাচিত শাসকদলের লেজুড়বৃত্তি করা। মানে নির্বাচিত সরকারের নির্দেশে ইশারায় নিয়ম-কানুন, নীতি, ন্যায়-অন্যায়, বাদ-বিচার না করেই সরকারের নির্দেশ মেনে চলা। অন্য প্রবণতা হল, নিজেদের ইচ্ছেখুশি মতো চলতে থাকা। পাঁচ জন চুরি করেছে, হয় সরকারের নির্দেশে তাঁদের তিনজনকে ধরা, দু’জনকে ছেড়ে দেওয়া, আর না হলে পাঁচজনকে ধরার নামে ৭০ জনকে জেলে পুরে দেওয়া। পৃথিবী জুড়েই এই সমস্যা মাঝে মধ্যেই দেখা যায়। গণতন্ত্রের এই সীমাবদ্ধতাকেই ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ বলা হয়, যেখানে আসল গণতন্ত্র কিছু সীমিত মানুষের, কিছু বড়লোকেদের, কিছু ধনী শিল্পপতিদের আসর ছাড়া আর কিছুই নয়। এ এক অসম্পূর্ণ গণতন্ত্র। সরকার পুলিশ, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, সংবাদ মাধ্যম সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে, এবং তা করা হয় সামান্য কিছু মানুষের সম্পদ বাড়ানোর জন্য, সেই মানুষের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। এরকম এক সীমাবদ্ধ গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে, মাঝেমধ্যেই বিচারব্যবস্থা অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে, খানিকটা ‘ভাত দেবার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই’-এর ভূমিকায় নেমে পড়ে তারা, সঙ্গে থাকে আইন বেচে পেট চালানো কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ। উদাহরণ প্রচুর দেওয়া যায়।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপে পিছু হটল কেন্দ্র, রয়ে গেল অনেক প্রশ্ন

মনে আছে, বছরে একবার বইমেলা হত, শহরের মাঝখানে, প্রচুর মানুষ যেতেন, ঘুরতেও যেতেন অনেকে, তারই ফাঁকে হঠাৎ একটা বই কিনে নিতেন। চলছিল, বছরের পর বছর, বইপ্রেমী মানুষের দুগগা পুজো বলাই যায়। তা হঠাৎ পরিবেশের প্রশ্ন চলে এল, আইনের কচকচি, কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের ধান্দাবাজী, আদালতের নির্দেশে বইমেলা চলে গেল তেপান্তরে। তারপর থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে গড়ের মাঠে গেলে অক্সিজেন ভর্তি করে আনা যাচ্ছে! যে কোনও বিষয়ে আদালত ঢুকে যাচ্ছে। কোন আদালত? যাদের কাছে মামলার পাহাড় জমে আছে। তারিখ, তারিখ, তারিখ, বিচারাধীন বন্দি জেলেই থেকে যাচ্ছে ৭-৮-৯ বছর, ১২-১৪ বছর পরে জানা যাচ্ছে, যিনি এতদিন জেলে ছিলেন, তিনি নির্দোষ। সেই আদালতের কাছে অনাবশ্যক মামলার পাহাড় তৈরি হচ্ছে, আদালত সেগুলো গ্রহণও করছেন। সেবারে চতুর্থীর দিন, কমরেড বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য আদালতে গিয়ে রায় বের করে এনেছিলেন, তাতে রাজ্যের সমস্ত পুজো প্যান্ডেলে দর্শকদের ঢোকার ক্ষেত্রে, নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল কলকাতা হাইকোর্ট। অতিমারি পরিস্থিতিতে আদৌ পুজো করার অনুমতি দেওয়া সঙ্গত কী না, তা নিয়ে হাইকোর্টে মামলা দায়ের হয়েছিল। সেই মামলায়, হাইকোর্ট রাজ্যের সমস্ত পুজো প্যান্ডেলকে ‘নো এন্ট্রি জোন’ হিসাবে ঘোষণা করার নির্দেশ দিয়েছিল। তাই যদি রায় হয়, তাহলে টেকনিক্যালি এই রায় পালন করতে হলে কী কী করতে হত? ছোট-বড় সমস্ত মণ্ডপের চারপাশে, ৫ থেকে ১০ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত ব্যারিকেড করে দিতে হত। ‘নো এন্ট্রি’ ঘোষণা করতে হত সেই ব্যারিকেড করা অংশকে, সেখানে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবেই না। পুজোর প্রয়োজনে যাদের ঢুকতে হবে, মণ্ডপের বাইরে তাঁদের নামের তালিকা টাঙিয়ে রাখতে হত। মণ্ডপের ভেতর, ১৫ থেকে ২৫ জনের বেশি ঢুকতে দেওয়া হবে না, ওই তালিকার বাইরেও কাউকে, তার ব্যবস্থা করতে হত। কে করতেন? বিকাশ ভট্টাচার্য? তিনি তো মামলা করে খালাস! এবার? এসব ছেঁদো ব্যাপারে, মানে এই লাইন করে ঠাকুর দেখতে যাওয়া ইত্যাদিতে তিনি থাকেন না। পুজোর ছুটিতে সাদা ময়দার লুচি, আলুর ছেঁচকি খেয়ে নেটফ্লিক্স-এ সিনেমা দেখবেন, বা পূজাবার্ষিকী নিয়ে বসবেন। এদিকে মানুষ জন সেই আকালেও, একটা নতুন জামা প্যান্ট কিনে দিয়েছিল তাঁদের সন্তানকে, রেখেছিল মাস্ক, স্যানিটাইজার, ক্লাবগুলোও মাস্ক, স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করেছিল। ভিড় বাঁচিয়ে দু’চারটে ঠাকুর দেখা, এনারা বিপ্লবী নন, চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বিকাশবাবুর মতো গোমাংস খেয়ে, অসাম্প্রদায়িক ঘোষণা করার মত ধক এনাদের নেই, এনাদেরও মৃত্যুভয় আছে, এনারাও জানতেন মহামারী কাকে বলে, এদের ঘরের বাবা-মা’রা ভিড় বাসে উঠে চাকরি করতে যাচ্ছেন প্রতিদিন। ওই ভিড় বাসের পাশ দিয়েই, বিকাশবাবুর বিলাশবহুল এয়ার কন্ডিশন্ড গাড়ি তখন হুস করে চলে যায়। বিকাশবাবু এদের কাছে তখনই যান, যখন ভোট ভিক্ষে করতে হয়, আপাতত সে দায়ও মুক্ত, বার কয়েক হেরে আপাতত পতলি-গলি দিয়ে রাজ্যসভার টিকিট পাওয়া গিয়েছে। কংগ্রেসের বদান্যতায় এমপি, যে কংগ্রেসের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দেবার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন এই বিকাশ ভট্টাচার্য। ওবশ্য সেই সুযোগ আর নেই, সেই তিনি আদালতে গিয়েছিলেন, রায় নিয়ে এসেছিলেন। তিনি জানতেন, আদালতও ভালো করেই জানে যে, এই রায় মান না মানাতে কিচ্ছুটি এসে যায় না। রাস্তায় ঢল নামবে, ফুচকা থেকে মোগলাই পরোটা হয়ে প্যান্ডেলের সামনে একটা ব্যারিকেডে ভিড় থামবে, সেলফিতে ছবি উঠবে, সেখান থেকে আবার অন্য কোনও প্যান্ডেলে হাঁটা দেবেন মানুষ। হ্যাঁ, দলে দলে এই মানুষ দেখে নেবেন।

আলিমুদ্দিন, কালীঘাট বা মুরলিধর সেন লেন কারও সাধ্য নেই, ক্ষমতা নেই, এই জনউচ্ছ্বাসকে আটকানোর। তাহলে বিকাশবাবু আদালতে গেলেন কেন? ওই যে, আমি যে গান গেয়েছিলেম, মনে রেখো। আমি যে কেস করেছিলেম, মনে রেখো। উনি অর্জুন সিংয়ের জামিন নিয়েও লড়েন, উনি টাটা-র কারখানার জন্যও লড়েন, উনি পুজোতে যাতে মানুষ প্যান্ডেলে না ঢুকতে পারে, সে জন্যও আদালতেই লড়েন। এবং আদালত, সে সব শুনে রায় দেন। এবারে সেই তিনিই জানিয়েছেন, একটারও চাকরি থাকতে দেব না। কতটা অমানবিক হলে এমন কথা বলা যায়? কিন্তু তিনি বলেছেন, কারণ তাঁর আদত লক্ষ্য হল, রাজ্যের প্রতিটা মানুষকে বিপদে ফেলে, অসুবিধেতে ফেলে এক ধরণের রাগের জন্ম দেওয়া, যে রাগ থেকেই তাঁর হিসেবে মানুষ ফেলে দেবে এই সরকারকে, আবার অষ্টম বামফ্রন্ট হবে। কে ওনাকে বোঝাবে যে, ওনার ইচ্ছের প্রথম পার্ট শক্ত হলেও হতেই পারে, কিন্তু আজ যদি এই সরকার যায়, আমি নিশ্চিত যে, উনি এরকম কোনও বিষয় নিয়ে আদালতে যাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারবেন না। অবাক লাগছে? ত্রিপুরার কমরেডদের কাছে জেনে নিন।

দেখুন ভিডিও:

Read More

Latest News